ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

পিউ ॥ নিজেই কবিতা যেন

মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

পিউ ॥ নিজেই কবিতা যেন

আমাদের দেশে শিল্প-সংস্কৃতি শাখায় যাদের বহুমুখী বিচরণ কিংবা বলা ভালো যারা বহুমাত্রিক শিল্পী, তাদের পরিচয় ও মূল্যায়নের বেলায় রসগ্রাহীদের কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। কোন পরিচয় রেখে কোনটাকে বড় করে দেখবেন! এক্ষেত্রে যেটি হয়, ওই শিল্পীর প্রতিভার প্রতি সুবিচার করা হয়ে ওঠে না। কোনো একটা শিল্পশাখার সাধক হিসেবেই তাকে পরিচয় করানোর রেওয়াজ দেখা যায়। পিউ, সুলতানা শাহরিয়া পিউয়ের বেলায়ও এমন বিভ্রাট ঘটেছে। তিনি নিভৃতে কবিতাতেই সমর্পিত ছিলেন, ছিলেন বিশ^ কবিতার নিষ্ঠ পাঠক এবং অনুবাদক; অথচ এই মৌল পরিচয়টিই যেন কিছুটা আড়ালেই পড়ে গেছে মঞ্চে ও টেলিভিশনে তাঁর বিবিধ পারফর্ম্যান্সের কারণে। পিউয়ের আকস্মিক প্রস্থানের পর প্রাথমিক শোক না কাটিয়েই আমরা, তাঁর বন্ধুরা মন্তব্য/অভিমত প্রকাশ করে চলেছি। সেসবের ভেতর সাহিত্যিক গৌরাঙ্গ মোহান্তের সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ অভিমত আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। তিনি বলছেন : ‘অসময়ে অসীম পারাবারে হারিয়ে গেলেন কবি সুলতানা শাহরিয়া পিউ। পাপিয়ার কাছে হয়তো তিনি প্রাকৃতিক সুরের দীক্ষা নিয়েছিলেন। কণ্ঠে অবলীলাক্রমে তুলে নিতেন রবিঠাকুরের গান, কবিতা আবৃত্তি করতেন আর গুণী মানুষজনকে আলোকধ্বনির উৎসের কাছে একত্রিত হতে আহ্বান জানাতেন। বেশ কিছুদিন থেকে তিনি ডায়ালিসিসে ছিলেন। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য চেন্নাই যেতে চেয়েছিলেন। বাঁচতে চেয়েছিলেন আরও ক’টা দিন। অনেক কাজ রয়েছে অসমাপ্ত। দেশের জন্য যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁদের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন। দুয়েকজনের নিয়েছেনও। সে সাক্ষাৎকার শব্দহীনতার ভেতর থেকে যেতে পারে। অনুবাদে মগ্ন থেকেছেন। তাঁর অনূদিত কর্মকে সুসজ্জিত করা সহজসাধ্য নয়। মৃত্যুর আকস্মিকতা অসহনীয়। সহসা একজন মুক্তবুদ্ধির মানুষ স্থির পটে বন্দি হবেন, মেনে নেওয়া যায় না। একটি অর্কিড বনের পথ ধরে যেতে যেতে তিনি এখন মুদ্রিত কবিতায় কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন!
শেষের বাক্যটি আমি দ্বিতীয়বার পড়ি : ‘একটি অর্কিড বনের পথ ধরে যেতে যেতে তিনি এখন মুদ্রিত কবিতায় কিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন।’ কবির বিদায়ের পর পাঠকের সামনে থাকে কবির কবিতারাজিই, আর কিছু নয়। সেখানেই কবিকে শনাক্ত করা যায়, ব্যক্তিমানুষের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়ার সারাৎসার স্পর্শ করা যায়। বহুমাত্রিক শিল্পী-লেখক ও প্রসারিত-হৃদয়া মায়াবতী ব্যক্তি পিউকে, বলা ভালো পিউয়ের শুদ্ধ সত্তাকে অবলোকন ও বিবেচনা করার জন্যে তাঁর কবিতার কাছেই আমাদের ফিরতে হবে। এবং অনুবাদকর্মের কাছেও। কেননা দান্তে বা আব্বাস কিয়োরাস্তামি, অথবা অন্য কেউ, অনুবাদের জন্য কবিকে নির্বাচন করার ভেতরেও একজন কবি বা অনুবাদকের কবিতাভাবনার সংকেত মেলে। এটা সত্য যে, অনুবাদের জন্য চিরায়ত কবির প্রতিই পিউয়ের পক্ষপাত ছিল। আর তাঁর মাতৃভাষার ক্ল্যাসিক কবির (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) গান তিনি গাইতেন বলে রবির কবিতা ও গীতিকবিতা তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। অন্যের কবিতার কথা বলছি না, নিজের কবিতা যখন পিউ আবৃত্তি করতেন, তখন কবিতা, সংলাপ ও গানের সংমিশ্রণে এমন এক ঘোরলাগা আবহ তৈরি করতেন যে, স্বদেশের ও স্বসমাজ-স্বকালের ভাঁজ সাবলীলভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়ত। পিউ গানের শিল্পী হওয়ার সুবাদেই মঞ্চে বা ঘরোয়া আয়োজনে নিজের যেসব কবিতা পরিবেশন করতেন, তা শ্রোতাদের তাঁর প্রতি অনুরাগী করে তুলত। একবার শুনলে কেউ তা ভুলত না। আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে টেলিভিশনে তাঁর গুরুত্ব ছিল। যদিও টিভিতে তিনি আবৃত্তি করতেন সব বিশিষ্ট কবিদেরই কবিতা।
পুড়িও না তোমার ঘর শিরোনামে পিউয়ের একটি ছোট কবিতা তুলে দিচ্ছি নবীন পাঠকদের জন্যে।

হিম হাওয়ার কাছে বিছিয়ে দিয়ে হাত
উড়িয়ে নিয়ে যাবে সে আশায় জলপাই বনে
অপেক্ষমাণ এই প্রাণ- জুড়াতে চায় যেমন
প্রথিত শেকড় জলকণার ভরসায় এক ঠায়Ñ
প্রেমের খামারে লাগিয়ে আগুন কি নির্বিকার
অবোধ মানুষ ঘরে তুলতে চায় সোনালী ফসল!
হায় মানুষ মজুতদারের অদৃশ্য ইশারায় ভুলে যাওÑ
সাঁওতালি গ্রাম পোড়াও অজান্তে পোড়ে তোমার মন!
ওদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট হলে মুখ থুবড়ে পড়বে
তোমার অঘ্রান, তোমাদের নবান্ন উৎসব।
সুলতানা শাহরিয়া পিউয়ের কবিতা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের প্রথমেই বলতে হবে তাঁর দেশপ্রেমের কথা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির এ দুটি চিরকালীন গৌরব তাঁর কবিসত্তার গভীরে ছিল প্রোথিত। আমরা দিঘি দেখি, তার ওপর ভাসমান ডিঙি দেখি, দেখি আরোহীর উচ্ছলতা, কিন্তু দিঘির দেহ জুড়ে ও তার সুগভীর সত্তায় যে জলজ প্রাণ আছে, তা হোক উদ্ভিদ কিংবা মীন, সেটি স্মরণে রাখি না। পিউয়ের কবিতার প্রকৃত রসাস্বাদনের জন্যে তাই উপরিস্থিত অনুষঙ্গ নয়, বরং লুকোনো সুর ও বাজনাকে বুঝতে হবে, অনুভব করতে হবে। বিশ^ কবিতার পাঠমগ্ন হলেও তাঁর কবিতা ছিল শতভাগ ‘স্বদেশি’। সুরুচি, সুশোভনতা, আদর্শবাদিতা এবং মানবপ্রেম তাঁর কবিতাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। ঝরাপাতার ধ্বনির মতোই তার কবিতায় পাওয়া যায় প্রেম-মর্মর সৌরভ ও কষ্টের গহনা। নর-নারীর সম্পর্ক ও আবেগের বহু বর্ণিলতাকে এমন পরোক্ষভাবে পিউ তাঁর কবিতায় জড়িয়ে দিয়েছেন যে, ডুবুরির মতোই সেসব পরম নিষ্ঠায় তুলে আনতে হয়। প্রেম, প্রকৃতি ও প্রার্থনা পিউয়ের আপাত সরল  কবিতায় রয়েছে পাশাপাশি ও সমান্তরাল।
পিউয়ের বিদায় সংবাদ শুনে প্রথমেই যে কথা মনে হয়েছে, সেটি হলো, অন্যদের কল্যাণে যারা নিবেদিত থাকে, নিভৃতে অবদান রাখে, তারা বুঝি এভাবেই আগেভাগে চলে যায়। সত্যিকারের গুণী ও ভালো মানুষদের আমরা ধরে রাখতে পারি না। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, শত শত নারী-পুরুষের উপকার করেছেন পিউ; টাকাপয়সা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে পারে অনেকেই, সেসব তো ছিলোই, কিন্তু প্রেরণা দিয়ে, অন্তর্শক্তি জাগিয়ে দিয়ে, মুষড়ে পড়া বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষকে আত্মগৌরব ফিরিয়ে দিয়ে সুখ-স্বস্তির সন্ধান দিতে পারে কয়জন? এমন গূঢ়-গভীর কাজটি স্বপ্নময়ী শান্তিদায়িনী পিউরাই পারেন। আমাদের পিউ ছিলেন এক অসামান্য নারী; আদ্যোপান্ত সৃষ্টিশীল শিল্পী। অজস্র ব্যক্তি তার  স্নেহ-ভালোবাসা-মমতা পেয়েছেন।  যদিও প্রতিদানের প্রত্যাশা তার ছিল না একরত্তিও।
বলতেই হবে, পিউ ছিলেন সুদর্শনা; আর মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজেরই ডিজাইনকৃত পোশাকে জড়াতেন বলে বাঙালি নারীর চিরন্তন সৌন্দর্যের সঙ্গে কোনো এক অব্যাখ্যাত নান্দনিকতা যুক্ত হয়ে যেত প্রায়শই। খানিকটা আদিখ্যেতার মতোই শোনাবে, যদি বলি, পিউ ছিলেন স্বয়ং কবিতা যেন। যদিও তাঁর কবিতাস্পন্দিত জীবনধারা, কবিতায় সমর্পিত মন এবং বহিরঙ্গের রূপসুষমা যুগপৎভাবে প্রত্যক্ষ এবং অনুধাবন-অবলোকন যাঁরা করেছেন, সেই তাঁদের কাছে আমার কথাটি বাড়াবাড়ি মনে হবে না। আসুন, এই মহীয়সীর জন্যে প্রার্থনা করি।

২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
[email protected]

×