অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর অমর স্রষ্টা। তিতাস একটি নদীর নাম ছাড়াও অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস ‘রাঙামাটি’, ‘শাদা হাওয়া’, এবং ‘দলবেঁধে’ নামে একটি গল্প গ্রন্থ প্রকাশ পায়। তবে শুধু তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটির মাধ্যমেই অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। এই তিতাস একটি নদীর নাম সারা বিশ্বের নদীমাতৃক ধীবর সম্প্রদায়ের জীবনোপাখ্যানের মহাকাব্য।
উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়ে কলকাতায় মঞ্চস্থ করেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই আরেক খ্যাতিমান নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। যা পরবর্তীতে ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন। এ ছাড়াও উপন্যাসটি নিয়ে আরও নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক ছিলেন জলমজুর, জলদাস। অদ্বৈতর নিজের ভাষায় ‘জাউলার পোলা’। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের গোকর্ণ ঘাটে তিতাস নদীর তীরের একটি দরিদ্র মালো পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম অধরচন্দ্র বর্মণ। অদ্বৈতরা ছিলেন তিন ভাই একবোন। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা অধরচন্দ্র বর্মণের সঙ্গে শৈশবে তিনি তিতাস নদীতে মাছ ধরতে যেতেন। সম্প্রদায়গতভাবেই তিনি ছিলেন অপরায়ণের নির্মম শিকার। মালোপাড়াটি উন্মাষিক ‘ভদ্র’জনদের নিকট ছিল ‘গাবর’পাড়া হিসেবে পরিচিত। ভারতবর্ষীয় ধর্ম-বর্ণ ও সমাজবাস্তবতার অপরভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে, মল্লবর্মণদের মালো বা গাবর বলে আখ্যা দিয়ে তাদের শ্রমের প্রতি ব্যঙ্গ ও তাচ্ছিল্য করে ‘ভদ্র’জনেরা এ ধরনের নামকরণ করেছেন। এ কারণে তার শৈশব-কৈশোর ছিল সঙ্কুচিত ও বিড়ম্বিত। যা তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’সহ অন্যান্য লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরম্ভ হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম মাইনর স্কুল (বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে। মাইনর স্কুলে ভর্তি হওয়ার পূর্বেই তার পিতা-মাতা উভয়ই পরলোকগমন করেন। এ সময় মালোরা চাঁদা তুলে লেখাপড়ার খরচ সংগ্রহ করেন। মাইনর স্কুলে তিনি বরাবরই প্রথম হতেন এবং বৃত্তিও পেয়েছিলেন। এরপর ভর্তি হন অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমান অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়)-এ। এ বিদ্যালয় হতে তিনি ১৯৩৩ সালে প্রথম বিভাগ পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। আই এ কøাসের পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই তিনি ক্যাপ্টেন নরেন দত্তের অনুরোধে ১৯৩৪ সালে কলকাতায় চলে যান।
বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। নেহাত ছোট বয়স হতেই তার সাহিত্যিক কৃতিত্বগুলো সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি স্কুল জীবনেই নানা পত্র-পত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা লিখে অনেক পুরস্কার ও মেডেল পেয়েছিলেন। অদ্বৈত ছাত্রজীবনে কবিতাই বেশি লিখতেন। বিদ্যালয়ে তিনি হাতে লেখা দেয়ালপত্র ‘সবুজ’-এ ‘তিতাস’ শিরোনামে কবিতা লেখেন। এটাই তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’র বীজ কবিতা। ওই সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি প্রধানত শিশুতোষ অনেক কবিতা লিখেছেন। সাহিত্যপাঠ ও অনুধাবনে তিনি ওই বয়সেই শিক্ষকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। গ্রন্থ প্রকাশে অভিলাষী সতীর্থ বা অনুজ তার মতামত লাভের জন্যে তার কাছে পাণ্ডলিপি পাঠাতেন। সেসব ক্ষেত্রে কৃত মন্তব্যে তার সৃজন ও মননের পরিচয় পাওয়া যেত। প্রথম তারুণ্যেই তিনি মৃত্তিকালগ্ন ও লোকজ সাহিত্য অনুসন্ধান ও তার রসগ্রহণে ব্রতী হন। ভাবী সাহিত্যের উপাদান হিসেবে তখনই তিনি সেগুলোকে আত্মস্থ করতে শুরু করেন।
কলকাতায় গমন করে প্রথমে ‘মাসিক ত্রিপুরা’ পত্রিকার কাজে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে ক্যাপ্টেন নরেন দত্তের মালিকানায় নবপর্যায়ে ‘নবশক্তি’ সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হলে তাতে তিনি সহকারী সম্পাদকের পদে যোগদান করেন। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এ পত্রিকায় তিনি সম্পাদকরূপে দায়িত্ব পালন করার সাত বছর পর তার স্মৃতি-বিজড়িত সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ‘আজাদ’, ‘কৃষক’, ‘মোহম্মদী’ প্রভৃতি পত্রিকাতে পার্টটাইম কাজ করে অর্থ উপর্জন ও ব্যাপকভাবে বই কেনা, পাঠ করা এবং লেখালেখি তথা গবেষণা কাজ চালিয়ে যান। নবশক্তির পাতায় নামে বেনামে তার অনেক বিচিত্র লেখা ছাপা হয়। নবশক্তি বন্ধ হলে তিনি ‘মোহম্মদী’তে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি সতীর্থ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতার ৭ নবীনকুণ্ড লেনে ‘চয়নিকা’ পাবলিশিং হাউস গঠন করেন। বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন-কালিদাস মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস চক্রবর্তী, সতীকুমার নাগ, সনৎকুমার নাগ প্রমুখ।
১৯৪০ সালে তিনি সনৎকুমার নাগের প্রকাশনায় কালিদাস মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস চক্রবর্তী ও সতীকুমার নাগের সঙ্গে যৌথভাবে ‘দলবেঁধে’ গল্প সংকলন সম্পাদনা করেন। ১৯৪২ সালে তিনি তার উপন্যাস ‘শাদা হাওয়া’ রচনা শেষ করেন। যা সোনারতরী পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯৪৮ ইংরেজি বা ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে। সেই সালে তিনি আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মনোনয়নে তারই সহ-সম্পাদকরূপে যোগদান করেন ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায়। ক্রমে মোহাম্মদী সম্পাদনার ক্ষেত্রে মূল কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হন। নামে-বেনামে মোহাম্মদীতে তার বেশকিছু রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি মোহাম্মদীতে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি যুগান্তর, নবযুগ, আজাদ, কৃষক প্রভৃতিতে কাজ করেন। লেখেন প্রধানত অর্থের অভাব পূরণের জন্য। ১৯৪৩ সালে ‘ভারতের চিঠি-পাল বাক্কে’ গ্রন্থকারে প্রকাশ করেন নিজেদের ‘চয়কিনকা পাবলিশিং হাউস’ থেকে। একই বছর তিনি ‘রাঙামাটি’ উপন্যাস রচনা করেন। যা প্রকাশিত হয় মাসিক ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় ১৯৬৪ সালে, ১৩৭১ বঙ্গাব্দে। ১৩৭১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে চৈত্র ১২ সংখ্যায় ১টি বাদ দিয়ে ১১ কিস্তিতে ছাপা হয়।
১৯৪৫ সালে তিনি সাগরময় ঘোষের সহযোগিতায় সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগদান করেন। এ সময়ে তিনি ভালো বেতন পেতেন এবং তা নিয়মিত পেতেন। অকৃতদার নিঃসঙ্গ অদ্বৈত কৃচ্ছ্রসাধন ও উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যতটুকু আয়-উপর্জন করতেন তার অধিকাংশই ব্যয় করতেন দুস্থ পরিজনদের মধ্যে। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় যাওয়া আত্মীয়পরিজনদের সাহায্য করতে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন মেটাতে সাগরময় ঘোষ প্রমুখ বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতায় বিশ^ভারতী গ্রন্থ বিভাগেও খণ্ডকালীন চাকরিপ্রাপ্তি এবং ১৯৫০ সাল পর্যন্ত (মৃত্যুর পূর্ববর্তী সক্ষম সময়কালে) এতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে মোহাম্মদীতে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর প্রাথমিক খসড়া (৭ কিস্তিতে) প্রকাশিত হয়।
১৯৪৮ সালে শারদীয়া ‘সোনারতরী’ পত্রিকায় তার ‘শাদা হাওয়া’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। যা ড. অচিন্ত্য বিশ^াসের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে ১৯৯৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বিদ্যালয় জীবনেই অদ্বৈত যতটুকু পড়ার কথা তা অপেক্ষা অনেক বেশি পড়েছিলেন। নিদারুণ কৃচ্ছ্রতার মধ্যেও তিনি সারা জীবন গ্রন্থ সংগ্রহ করে গেছেন। তার নিজের স্বীকারোক্তি, ‘যা উপার্জন করেছি প্রায় সবই তো ব্যয় করেছি বই কিনতে। সাহিত্য ছাড়াও তার গ্রন্থভাণ্ডার ছিল নৃতত্ত্ব, দর্শন ও চারুকলার এক সুচিন্তিত ও মনোজ্ঞ সংগ্রহ। মানুষ ও স্বজনদের প্রতি ছিল তার অসম্ভব ভালোবাসা। কলকাতায় নিজের সীমিত রোজগার থেকে গোকর্ণঘাটের মালোপাড়ার শিশু-কিশোরদের ঘরোয়া বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য তিনি উপেন্দ্রবাবুর স্বল্পশিক্ষিত বিধবা প্রফুল্লকে নিয়তিম অর্থ প্রেরণ করতেন। তিতাসপাড়ের যেসব মালো ও অন্যান্য পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছে কিংবা রেলের শ্রমিক পরিবার তার ওখানে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের যথাসাধ্য দায় গ্রহণ করেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। সঙ্গত কারণেই তার বন্ধুরা মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা চিরকাল অদ্বৈতকে তাহার মুষ্টি অন্ন বহুজনের সঙ্গে ভাগ করিয়া খাইতে দেখিয়াছি।’
বই ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে দীর্ঘদিন অনাহার ও অর্ধাহারে কেটেছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের। মাইনের অর্ধেকের বেশি চলে যেত বই কিনতে, বাকি অর্ধেক দিতে হতো তার উপর নির্ভরশীল স্বজন ও আশ্রিতদের। এভাবে শরীরের প্রতি অযত্ন ও অবহেলা করে এবং অপুষ্টির শিকার হয়ে ১৯৪৮ সালে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের পীড়াপীড়ি ও সহযোগিতায় কাঁচপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হন। রোগমুক্ত হয়ে তিনি ষষ্ঠীতলার বাসায় ফিরে আসেন।
১৯৪৯ সালের ১৯ মার্চ বাংলা ১৩৫৫ সালের ৫ চৈত্র সংখ্যা সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ আর্ভিং স্টোন-এর উপন্যাস Lust for life এর অনুবাদ ‘জীবন তৃষা’ প্রকাশ শুরু করেন। ৬২ কিস্তিতে ‘দেশ’-এ প্রকাশ শেষ হয় ১৯৫০ সালের ২০ মে বাংলা ১৩৫৭ সালের ৬ জ্যৈষ্ঠতে।
১৯৫০ সালে পুনরায় যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে নিতে হলো। কিন্তু সেখানে তিনি কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে এলেন। আর তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার সময় ও সুযোগ হলো না। এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিক ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল কলকাতার নারকেল ডাঙ্গার ষষ্ঠীতলার বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।