নব্বই দশক পরবর্তী বিশেষ করে শূন্য দশকের পরে যারা কাব্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত, তাদের বেশির ভাগেরই দেখা যায় নামের আগে নিজেদের ‘কবি’ বলে সম্বোধন করতে হয়। কবি অমুক বা কবি তমুক এভাবে পরিচিতি দিতে হয়। হেলাল হাফিজদের সময়কার কবিদের এই পরিচিতি দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ, কবিত্বটা তারা বাইবর্ন পেয়েছিলেন কিংবা তাদের প্রতিভার পারদ ছিল উঁচুমানের। পরবর্তী যারা কাব্যচর্চা করেছে বা এখনো করে, তাদের অনেকেরই বছর বছর কবিতার বই বের হয় কিন্তু দেশের তৃণমূল পাঠকদের কাছে তাদের কবিতা কতটুকু পৌঁছায়, সেটা প্রশ্ন থেকে যায়। সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে তাদের কবিতার বই বাড়তেই থাকে কিন্তু দেশের কোনায় কোনায় থাকা পাঠকদের সঙ্গে তাদের কোনো মিথস্ক্রিয়া ঘটে না। এজন্য তারা নিজস্ব বলয়ের ভেতর আটকে কাব্যচর্চা করাকেই তাদের বাস্তবতা হিসেবে বেছে নিয়েছে। ঠিক এখানেই একজন হেলাল হাফিজ মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার কাব্যচেতনা এ গ্রন্থের মাধ্যমে এতটাই বেগবান হয়েছে যে, তিনি দিন দিন আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন এবং হবেন।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা কি দেখছি। বলা হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে যাচ্ছে কিংবা কারো কারো মতে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুই হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরাইল-ইরান, ইসরাইল-লেবানন, ইসরাইল-সিরিয়া এভাবে দিন দিন বাড়ছে যুদ্ধ। যারা মানবিকতার কথা বলছে বিশ্বজুড়ে, তারা কতটুকু মানবিকতা রক্ষা করছে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এই বাস্তবতার মাঝে দাঁড়িয়ে হেলাল হাফিজের মাত্র দুই লাইনের কবিতাটি চরমভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে-‘নিউট্রন বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না?’ (অশ্লীল সভ্যতা)। দুই লাইনের কবিতাতেই সভ্যতার সবচেয়ে বিকৃত আবিষ্কার যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং এর দ্বারা সৃষ্ট অমানবিকতা বেড়ে যায় এবং ক্রমাগতভাবে যাচ্ছেও।
হেলাল হাফিজ বলেছেন- ‘আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো আপনাকে, তোমাকে ও তোকে’ এখানে তিনি এক লাইনে সম্পর্কের ত্রিমাত্রিক আবহকে একসঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ‘আপনি’ আমরা অপেক্ষাকৃত অগ্রজদের সম্বোধন করি সম্মানার্থে, ‘তুমি’ বলি কাছের কাউকে কিংবা যাকে আমরা সমবয়সী ভাবি আর ‘তুই’ বলে থাকি একদম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের খাতিরে। এভাবে তিন সম্বোধন দিয়ে কবি তার কবিতাকে সামষ্টিকভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। এই চিন্তাটাই তো একজন বড় কবির বৈশিষ্ট্য, যিনি এককথায় সবাইকে এক ছাতার তলে নিয়ে আসতে পারেন। সামষ্টিক এই চেতনা আগামী দিনের কবিরা হেলাল হাফিজের কাছ থেকে পাবে, যার জন্য তিনি প্রাসঙ্গিক থাকবেন।
যতবার মিছিল হবে, বিপ্লব হবে ততবারই প্রজন্ম বলে উঠবে- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ (নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়) এ লাইন থেকে বের হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, বিপ্লবী চেতনা এর থেকে সৃষ্টি হয়। বিপ্লব বা প্রতিবাদের ভাষার মধ্যেও পার্থক্য থাকে শ্রেণি অনুযায়ী সেই ভাষাও হেলাল হাফিজ বলেছেন এভাবে-‘আমিও গায়ের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি’। এই ভাষা নিম্নশ্রেণির স্ল্যাং হলেও তা প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। একটা প্রজন্ম কবিতায় যেখানেই এভাবে প্রতিবাদের ভাষা বা বিপ্লবের গন্ধ পাবে, তা লুফে নেবে আর হেলাল হাফিজ সেখানে অবিসংবাদিতভাবে প্রাসঙ্গিক।
যতবার মানুষ কষ্ট পাবে, ভালোবাসা হারাবে, সমাজ-সংসারের চাপে পিষ্ট হবে, ততবার কণ্ঠে বাজবে- ‘এক মানবী কত আর কষ্ট দেবে!’ কিংবা ‘ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়’। কষ্ট, অপূর্ণতা এগুলো মানুষের জীবনের চিরন্তন অনুভূতি আর হেলাল হাফিজ সেই চিরন্তন অনুভূতিকে ছুঁয়ে সার্বজনীনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।
ব্যক্তিমানুষ দিন দিন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার চাপে। সভ্যতা যত উন্নত হচ্ছে, অন্যদিকে মানুষ ভেতর থেকে একা হয়ে যাচ্ছে। সবাই আছে চারপাশে, তারপরেও যেন কেউ নেই এমন একটা পরিস্থিতি। এভাবে ব্যক্তিমানুষের নিঃসঙ্গতার চরম বাস্তবতা হেলাল হাফিজ তার নিজের বাস্তবিক জীবনযাপন থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান সভ্যতা এবং আগামী দিনের সভ্যতায় মানুষের বাস্তবতা নিঃসঙ্গতার দিকেই যাচ্ছে, যেজন্য হেলাল হাফিজ ব্যক্তি ও সামষ্টিকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন আরো বেশি এবং তার কবিতার ভাষাতেই নিজেকে আমরা পরিচয় করাব ‘দুঃখের আরেক নাম ‘হলাল হাফিজ’।
যেজন্য প্রাসঙ্গিক থাকবেন হেলাল হাফিজ
শীর্ষ সংবাদ: