ইতিহাস জুড়ে যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকরা মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এক অমূল্য ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে, স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সামাজিক বৈষম্য ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাদের রচিত কবিতা ও গানগুলো জনগণের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। যখন জাতি শাসকগোষ্ঠীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, তখনই কবি সাহিত্যিকরা কলম ও কণ্ঠের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের এক শক্তিশালী ভাষা সৃষ্টি করে সংগ্রামী চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছে।
এমনকি ঐতিহাসিক আন্দোলন যেমন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় কবি সাহিত্যিকরা নিজেদের সৃষ্টি দিয়ে শোষিত জনগণের সাহস জুগিয়েছেন। তাদের গান ও কবিতা ছিল নীরব বিপ্লবের মন্ত্র, যা মানুষের মনোবলকে উদ্বুদ্ধ করে সংগ্রামের আগুন জ্বালিয়েছিল। শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল তাদের লেখনি, জাতিকে দিখিয়েছে এক নতুন দিশা।
কবি এবং লেখকরা স্বাধীনতার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের ক্ষুরধার লেখনী শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নিপীড়নের সময়ে, যখন জনগণের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা হয়ে যায় এবং তাদের অধিকার অস্বীকার করা হয়, তখন কবি এবং লেখকরা আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে আসে। ন্যায়বিচার, সাম্য এবং মুক্তির জন্য সম্মিলিত আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে। তাদের কবিতা, গান এবং লেখার মাধ্যমে তারা নিপীড়িতদের বিপ্লবের আহ্বানে রূপান্তরিত করে।
কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমেদ, গীতিকার গোবিন্দ হালদার এবং বিখ্যাত কবি রওশন ইজদানী আরও অগণিত কবিদের লেখনী প্রজন্মকে চেতনার সন্ধান চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে চলছে।
১৭৪১ সাল তখন সম্রাট আলীবর্দী খাঁর যুগ। খাঁ সাহেবের রাজত্বে বাংলার মানুষের অভাব হয়তো ছিল, কিন্তু অশান্তি ছিল না তেমন। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা!
কথা নেই, বার্তা নেই, একদল লুটেরার উৎপাত শুরু হয়ে গেল মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলোতে। রাতের আঁধারে একদল লোক ঘোড়া টগবগিয়ে হানা দিতে থাকল। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকল, লোকজনকে মেরে-ধরে সবকিছু কেড়ে নিতে থাকল। দোকানপাট সব তাদের অত্যাচারে বন্ধ হয়ে গেল, মানুষজন ভয়ে ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিল। শান্ত বাংলা যেন হঠাৎ করেই আতঙ্কের বাংলা হয়ে উঠল।
এই দুর্বৃত্তরাই কিন্তু এখনকার বিখ্যাত ছড়াগানের সেই বর্গি। আসলে পর্তুগিজ বর্গি হলো পঞ্চদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম। হাতে তাদের থাকত তীক্ষ্ণফলা বর্শা। মারাঠাদের আসল নিবাস ভারতের মহারাষ্ট্র শহরে হলেও দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতজুড়েই কিন্তু তারা ছড়িয়ে। আলিবর্দি খাঁ যখন বাংলার সিংহাসনে, সে সময় দিল্লির দখলে ছিল মোগলরা। সে সময় এই মারাঠাদের যোদ্ধা হিসেবে নামডাক ছিল। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মোগলদের সঙ্গে মারাঠাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। এই মারাঠাদের কিছু পথচ্যুত সেনাই একসময় পরিচিত হয়ে যায় বর্গি নামে। সারা ভারতে শুরু করে তাণ্ডব।
এভাবে ১৭৪২ থেকে শুরু করে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বর্গিদের উৎপাতে মানুষ তটস্থ ছিল।
নয় বছরে যে ত্রাস তারা চালিয়েছিল, সে জন্য তাদের নামে লেখা রওশন ইজদানীর লোকগানটা পাকাপাকিভাবে ঠাঁই পেয়ে যায় ইতিহাসে।
খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল
বর্গি এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?
গোবিন্দ হালদার এর বিখ্যাত গান ‘রক্ত লাল’ দিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামে রক্তের ঝরনার কথা উল্লেখ করেছেন, যা লাখ লাখ মানুষের আত্মবলিদানের প্রেক্ষাপটে প্রেরণাদায়ক হয়ে ওঠে।
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল ॥
বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল,
হয়েছে কাল, হয়েছে কাল ॥
‘বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল’ অংশে লেখক স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্তের গুরুত্বের বলেছেন, যেখানে সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে নতুন এক যাত্রার সূচনা ঘটে। গানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছন্দ যেন জনগণের অন্তরে স্বাধীনতা ও প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়ের জন্ম দেয়।
শেষে রক্তের হরফে আগাম বিজয়ের ঘোষণা রাখলেন বিপ্লবী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
‘শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী তাকিয়ে রয় :
জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’
চল্লিশ দশকের শেষ দিকে কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন মার্কসবাদী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ভবিতব্যের মতো।
দুই দশক পরে সত্তরে এসে জ্বলে পুড়ে ছারখার হওয়া বাংলাদেশের মাঠ থেকে আমরা তুলেছি স্বাধীনতার ফসল। আর সেই ফসল ছিল রক্তধোঁয়া।
কারণ ত্রিশ লাখ শহীদের খুন রাঙা ছিল আমাদের মাঠের সেই ধান।
তার কবিতাগুলো স্বাধীনতার জন্য একটি মিছিলকারী আর্তনাদ ও জনসাধারণের মধ্যে প্রতিরোধের চেতনা জাগিয়ে তোলে।
‘দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো বাংলাদেশের প্রাণ
কেনো ঘরে ঘরে গড়ে উঠলো এত রণাঙ্গন?
কেনো এত রক্ত বিসর্জন?’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী চেতনায় সমাজের দমন-পীড়ন এবং শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেগে ওঠার জন্য সাহস দিয়েছেন। কবিতার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব এবং স্বাধীনতার পিপাসা তৈরি করেছেন।
লাথি মার, ভাঙ্রে তালা! যত সব বন্দী-শালায়
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি ॥
‘লাথি মার, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দীশালায়’। এই পঙ্ক্তিতে কবি শোষণ, অবিচার এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন। বন্দী শৃঙ্খলা ভেঙে, চিরকালীন কষ্ট এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে কবি এক শক্তিশালী আহ্বান জানিয়েছেন।“আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি’। কবি প্রতিরোধের আগুনে সমস্ত পুরনো কাঠামো এবং অসত্যকে নষ্ট করে নতুন একটি সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
‘কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙ্গে ফেল্ কররে লোপাট রক্ত জমাট
শিকল পূজার পাষাণ বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ ! ধ্বংস নিশান
উঠুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি’।
২৩ জুন ১৭৫৭ সালের পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ঘষেটি বেগম ও মীর জাফরদের ষড়যন্ত্রের ফলে অস্তমিত হওয়ার ফলে বিপ্লবী কবি ফররুখ দেখেছেন ইংরেজ বেনিয়াদের শাসন ও শোষণের অবস্থা। এ দেশবাসীর জন্য স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। আরও উপলব্ধি করেছেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য সুযোগ্য নেতা প্রয়োজন। যে নেতা কোটি কোটি মজলুম মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবেন তিনিই হলেন কবির কল্পনায় সৃষ্ট আদর্শ মহানায়ক পাঞ্জেরী। এক রূপক কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করলেন :
‘জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি
জাগো অগনন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি।’
অথবা:
কবির মনে প্রশ্ন :
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?...
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাজার, ওকি
রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ওকি দরিয়ার গর্জন, ওকি বেদনা মজলুমের!
ওকি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী!
পাঞ্জেরী!
পাঞ্জেরী : সাত সাগরের মাঝি
সর্বশেষ চব্বিশ জুলাই আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী কবি মাহমুদুল হাসান নিজামীর ‘দিল্লি না ঢাকা’ শিরোনামের কবিতা লেখেন পরবর্তীতে সেটি গণ স্লোগানে পরিণত হয়।
‘দিল্লির স্বার্থটাই হেফাজতে রাখা
কোথা আছি বুঝা দায় দিল্লি না ঢাকা’
বিপ্লবী কবিদের কবিতা ও গানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে মানুষের লড়াই, বিরোধিতা, প্রতিবাদ ও পুনর্গঠনের এক শাশ্বত আহ্বান। তাদের কবিতা ও গান আজও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ, এবং এগুলি আগামীর সংগ্রামীদের কাছে একটি অমূল্য দিশা হিসেবে জীবিত থাকবে।