ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫ পৌষ ১৪৩১

সোনার বালা

নুশরাত রুমু

প্রকাশিত: ১৮:২৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

সোনার বালা

ধানখেতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আজিজ উল্ল্যাহ। পেশায় সে একজন চাষি। তার নিজের জমি নেই। অন্যের জমিতে চাষ করে তার সংসার চলে। অনেক পরিশ্রম করে সে কিছু টাকা জমিয়েছে। ভাবছে সেই টাকায় এই জমিটা কিনবে। পুরো টাকা অবশ্য একসঙ্গে দিতে পারবে না। মাসে মাসে বাকি টাকা শোধ দেবে। একই গ্রামের মেয়ে রুবিকে সে ভালোবাসে। রুবির বাবাকে রাজি করাতে হলে নিজের জমি থাকা দরকার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে  ধীরে সে  বাড়ি ফিরল। মা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত। আজিজ মাকে ডেকে বারান্দার মেঝেতেই বসে পড়ল।
ভাবছি উত্তরপাড়ার জমিটা কিনে ফেলব। তুমি কী বলো, মা?
তুই যেটা ভালো বুঝিস সেটাই কর। আমি আর কি বলব।
একটু আগে রুবি এসেছিল। কেঁদে কেঁদে অস্থির। ওর বাবা নাকি ঘটক ধরেছে। তোকে কিছু করতে বলল।
সে জন্যই তো এত তাড়াহুড়া করছি। দেখি বিকেলে শহিদ মোল্লার সঙ্গে দেখা করব। দিন গড়িয়ে চলে।
কঠোর পরিশ্রমী আজিজ কাজের দক্ষতা দেখিয়ে রুবিকে বিয়ে করে।
খুশিতে ভরে ওঠে আজিজের ছোট্ট সংসার। কিন্তু আজিজের মন দুঃখ ভারাক্রান্ত। বউকে সে কোনো সোনার গয়না দিতে পারেনি। বাসরঘরে রুবির হাত ধরে সে কথা দিলো এবার নবান্নের সময় ধান বিক্রি করে সোনার বালা কিনে দেবে।
আজিজ সারাদিন কাজ করে। সন্ধ্যায় তার শরীর ভেঙেচুরে আসে। রুবির ভালোবাসায় সে আগামী দিনের জন্য শক্তি ফিরে পায়। দুজনে পরিকল্পনা করে কীভাবে সংসারে উন্নতি হবে।
কিছুদিন পর হঠাৎ তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। তিন দিন ধরে পেট ব্যথায় অস্থির। অবস্থা খারাপ দেখে রুবি তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল পেটে টিউমার হয়েছে। অপারেশন করাতে হবে। মাকে সুস্থ করার জন্য আজিজ জমানো টাকা খরচ করে ফেলল। সে বছর সে আর রুবির জন্য সোনার বালা কিনতে পারে না। বাজার থেকে ইমিটেশনের চুড়ি কেনে সে। রুবিকে সেই চুড়ি দিতে গিয়ে সে কেঁদে ফেলে। রুবি কিন্তু তেমন মেয়ে নয়। ভালোবাসার মানুষকে কাঁদতে দেখে সে সান্ত্বনা দেয়। বারবার বলে আমার সোনার বালা লাগবে না তুমি এই চুড়ি এনেছ, এগুলো তো কত সুন্দর। কিন্তু আজিজের মন ভরে না। মনে মনে সে ঠিক করে যেমন করে হোক সামনের অগ্রহায়ণেই রুবির জন্য সে সোনার বালা কিনবে। সেদিনের পর থেকে আজিজ আরও পরিশ্রম শুরু করে।
গ্রামের কয়েকটা পুকুর লিজ নিয়ে সে মাছের চাষ শুরু করে। পুকুর পাড়ে মৌসুমি ফলের চারা রোপণ করে। ছোটখাটো সব রকমের ব্যবসাতে সে টাকা খাটাতে লাগল। এবারে তার জমিতে ধানের ভালো ফলন হয়েছে।
ধান বিক্রি করে কত টাকা পাবে সেই হিসাব করতে বসে সে। রুবি তাকে রাতের খাবার খেতে ডাকে কিন্তু তার হুঁশ নেই। রুবি তার পেছনে দাঁড়িয়েই থাকে। একটা আনন্দের খবর আছে, আজিজ খেয়াল না করায় সে বলতে পারছে না। সে আজিজের কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললÑ শেষ হলো হিসাব?
আজিজ অন্যমনস্ক তবু উত্তর দিল, কেন?
রুবি তার কানে কানে বলল, তুমি বাবা হতে যাচ্ছ। আচমকা খবরে বাকরুদ্ধ হয় আজিজ। খুশির ঝিলিক বয়ে যায় দুজনের মাঝে। আজিজ আবার খাতার দিকে তাকায় কিন্তু রুবি তাকে সেই সুযোগ দেয় না। জোর করে খেতে বসিয়ে দেয়।
পরদিন সকালে গঞ্জে গিয়ে ধান বিক্রি করে আজিজ। সব কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। পকেটে এতগুলো টাকা নিয়ে আসতে ভয় ভয় লাগে তার। টাকাগুলো আলমারিতে সামলে রেখে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করে কবে সোনার বালা কিনতে পারবে। স্বপ্ন বুনতে বুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ একটা শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। একি! দরজাটা খুলল কে? রুবি তো পাশেই শুয়ে আছে। ভাবল মা বোধহয় বেরিয়েছে। মায়ের রুমে উঁকি মেরে দেখল মা ঘুমে অচেতন। সর্বনাশ! চোর এলো নাকি। রুবি, মা... চোর এসেছে বলতে বলতে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেখল আলমারিটা খোলা। ততক্ষণে রুবি ও মা জেগে উঠেছে। পাগলের মতো আলমারিতে টাকা খুঁজতে লাগল আজিজ। মা কান্নাকাটি শুরু করেছে। ঘুম চোখে রুবি হতবাক। কি করবে প্রথমে বুঝতে পারল না। টাকার জন্য গত দুবছরে কি কষ্টই না করেছে আজিজ। আলমারিতে টাকা নেই বুঝতে পেরে আজিজকে থামাল রুবি। আজিজ চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। আমার টাকা...  ভেবেছি এই টাকায় সোনার বালা কিনব...
রুবি একটু কঠিন হয়ে বলল, সোনার বালা আমি চাই না। আমরা সুখে আছি, দুবেলা খেতে পাচ্ছি এই তো অনেক। সোনার বালা হাতে না পরলে কি হয় বলো তো? ক’দিন পরে সংসারে মানুষ বাড়বে, সেটা না ভেবে তুমি এখনো বালা নিয়ে পড়ে আছ। ওই বালা অপয়া! ওর নাম নিলেই আমাদের কাছ থেকে টাকা হারিয়ে যায়। ওই স্বপ্ন তুমি মুছে ফেলো... বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে রুবি। আজিজ ভাবল, সত্যিই তো সোনার বালা না পরলে কি হয়? সোনার ধান তো আছে। এটাই বড় নিয়ামত।

×