ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন

দার্শনিক কাব্য মনিষা

সোহেল মাজহার

প্রকাশিত: ১৯:১৯, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

দার্শনিক কাব্য মনিষা

কবিতা আসলে কি? খুব সহজ কথায় তার উত্তর খোঁজা কঠিন। মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন্ন থেকেই কবিতা ও কাব্যিক অনুভূতির অস্তিত্ব ছিল। এমনকি বর্ণ ও লেখা আবিষ্কারের পূর্বেই মানুষ তার মনের ভাব, ভাবনা, ভালো লাগা-না লাগা ও মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার মাধ্যম ও ভাষা অন্বেষায় রত ছিল। আর এ কারণেই হয়তো গুহা গাত্রে চিত্রকর্মের উদ্ভব। প্রশ্ন উঠতে পারে গুহা গাত্রের আঁকিবুঁকি তো চিত্রকর্ম। কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক কি? বস্তুত মানুষের মনের সুন্দরতম শৈল্পিক অভিব্যক্তিরা প্রকাশে যখন লেখ্যরূপ ছিল না, তখন চিত্রকর্মই ছিল কবিতার প্রতিরূপ। কারণ দুটির মধ্যে গতি, ছন্দ ও অভিব্যক্তি ও অভিনব প্রকাশ ভঙ্গি আছে। সময়ের রূপান্তরে ভাষা ও অনুভূতি প্রকাশে একটি নির্দিষ্ট গঠন শৈলী, কাঠামো রূপই হলো কবিতা। সময়ের পরিবর্তনে কবিতার আঙ্গিক বারবার পরিবর্তন হয়েছে।
কবিতা সকল কিছুর আধার। জগতের রূপ রস গন্ধ, বিষয় -আশয়, পাওয়া না পাওয়া, প্রেম-কাম, আশা-নিরাশা, দেশকাল, সমাজ, রাজনীতি, প্রকৃতি, কাল-মহাকাল, আবেগ, অনুভূতি, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতি সকল কিছুই কবিতা ধারণ করে। একজন কবি হয়ত কোনো কোনো প্রবণতার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সে সামগ্রিকতাকেই ধারণ করে। কবি হাইকেল হাশমীও ধারণ করেন বস্তু জগতের সামগ্রিকতা।
কবির মধ্যে নীতিবোধ তীব্র। অতীত ইতিহাসের মানদণ্ডে শেষ পর্যন্ত মানুষের করুণ পরিণতি কবিকে আহত করে। তাকে সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। কবির উচ্চারণ -
‘এই উপমহাদেশে কত রাজা-মহারাজার ছিল রাজত্ব। মোরিয়া, গুপ্ত, অশোক, মুঘল, গৌরী, খিলজি আর কত রাজপরিবার কিন্তু সবাই তো আজ ইতিহাসের পাতায় একটি ঝাপসা নাম। মানুষের মনে জায়গা না করতে পারলে টিকে থাকে না কোনো নাম। দুঃখী মানুষের কল্যাণে, নিপীড়িত জনগণকে মুক্ত করতে যে মহামানবেরা দিয়েছেন তাঁদের শ্রম ও জীবনের বলিদান তারাই থাকবেন অমর, তাদেরই মৃত্যু নেই।’ (পৃষ্ঠা ১০- অমর নাম / শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন)
প্রেম কবিতার চিরন্তন ও আদি উপাদান। কবিগণ নানা ধরনের চিত্রকল্প, উপমা, প্রতীক ও রূপকল্প দিয়ে প্রেমের ভাষা নির্মাণ করেন। প্রেমাস্পদের কাছে পৌঁছে দেন অনুভূতি। সেই অনুভূতি একটি পর্যায়ে ব্যাক্তিকেন্দ্রিকতা অতিক্রম করে বহু স্তরকে স্পর্শ করে। কবির উচ্চারণ হয়ে ওঠে সার্বজনীন। কবি পৌঁছে যান উপলব্ধির উচ্চমার্গে। তার বর্ণনা ও ভাষার ভেতর যে সরল অভিব্যক্তির স্ফূরণ ঘটে, তা সকলকে ছুঁয়ে যায়। কবি উচ্চারণ করেন -

‘প্রতীক
অনুরূপ
উপমা
এইগুলি দিয়ে তোমাকে বর্ণনা করা যাবে না তাই
তোমাকে বর্ণনা করতে আমি ধার করেছি
নদী
আকাশ
সমুদ্রের
কাছ থেকে ব্যথিত হৃদয়ের মতো নীল রঙ’ (পৃষ্ঠা ১৩ তোমার খোঁজে / শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন)
পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, হানাহানি, লড়াই, পররাজ্য দখলের যুদ্ধ কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকারের জন্য যুদ্ধ করে মানুষ মরছে। প্রতিনিয়ত যুদ্ধের কারণে মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা ও কাপড়ের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করছে। পৃথিবীর বহু দেশ ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, গোত্র, আঞ্চলিক ও ভাষা পরিচয়ের কারণে সাম্র্রাজ্যবাদী শক্তি-জায়নবাদি ও উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর আগ্রাসন ও চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের শিকার হচ্ছে। কবি এই হানাহানির বাইরে তথাকথিত মানবাধিকার -পরিবেশবাদী সংস্থা সাহায্য-সাহায্য খেলাকে কটাক্ষ করেছেন। কবির সেই তীর্যক উচ্চারণ -
‘ভাবলাম হাজার শিশু ইয়ামেন, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনে মরছে
খাদ্যের অভাবে, চিকিৎসার অভাবে
কিন্তু তাতে কী আসে যায়
মানুষ হয়ে জন্মিয়েছে, মরতে তো হবেই
বিলুপ্ত তো আর হয়ে যাচ্ছে না?
বেঁচে থাকুক কোয়ালারা এই অস্ট্রেলিয়ার বুকে।
’ (পৃষ্ঠা ৫৪ আইসোলিশনের অনুধ্যান ২ / শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন)
কবি হাইকেল হাশমীর কবিতার ভাষা সহজ-সরল। কিন্তু চিন্তার খোড়াক জোগায়। আপাত সহজ-সরল ভাষাভঙ্গির ছলে তিনি মানুষের জীবনের ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ থেকে শুরু করে যাপিত জীবনের সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চান। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যত রকম অনুভূতি ব্যক্তি মানুষকে তাড়িত করে কবি তা উপমা, চিত্রকল্প ও দৃশ্যকল্প ও বক্তব্য আকারে প্রকাশ করেছেন। কবির কবিতায় ব্যক্তি মানুষের জিজ্ঞাসার সঙ্গে-দার্শনিক অন্বেষা ও বয়ান তৈরি হয়। কবিতায় একটি সামগ্রিক জীবন বোধ তৈরি করেন।

মোহাম্মদ আলী

×