১৯৭১ সালে দেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে পাক হানাদারদের দোসর আলবদর, রাজাকারদের সহায়তায় বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গণহত্যার শিকার হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্র সমাজের পাশাপাশি জাতীয়তা বোধে উন্মেষে অবদান রেখেছিলেন বুদ্ধিজীবীগণ, আর সে কারণেই ২৫ মার্চ রাতেই হানাদার বাহিনীর প্রথম শিকার হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীগণ এবং আসন্ন বিজয়ের মুহূর্তেও বুদ্ধিজীবী নিধনের প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা আমাদের গণহত্যার ভয়াবহতাকে ঢেকে রেখেছি, নিজের আঁচলে আড়াল করেছি হত্যাকারীদের। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে নতুন প্রজন্মের কাছে গণহত্যার ছবি ম্লান হয়ে গেছে। অনেকেই জানেন না কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে। এমনকি যাঁরা জানেন তারাও যুদ্ধের ও গণহত্যার রক্ত সাগর পেরিয়ে এসে এখনো উপলব্ধির সময় পেলেন না কেন বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরে।
আজকের প্রজন্মের খুব কম ছেলে-মেয়েই উত্তর দিতে পারবে কেন সেদিন গণহত্যা করা হয়েছিল? স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এত জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে কিন্তু গড়ে ওঠেনি এমন কোনো একাডেমি যেখানে বাংলাদেশের ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরকে নিয়ে গবেষণা হয়েছে। এই দিনে বাঙালি তার প্রিয় বুদ্ধিজীবীদের হারিয়ে শোকে ম্যুহমান হয়ে পড়ে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে এদেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হানাদাররা পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
বিজয়ের মাত্র ২ দিন আগে কেন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় তার মূল রহস্য আজও উদ্ঘাটন করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দু’দিন পর ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর জহির রায়হানকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের একটি বেসরকারি তদন্ত কমিটি সে’সময় গঠন করা হয়েছিল। এই তদন্ত কমিটির তৎকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন মরহুম সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন ভূতপূর্ব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, প্রবীণ শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বর্তমান বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ভূতপূর্ব সভাপতি ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম প্রমুখ। জাতীয় প্রেস ক্লাব ছিল এই তদন্ত কমিটির সদর দপ্তর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর দালাল হিসেবে যারা কাজ করেছে এবং এ দেশের নিরীহ মানুষকে হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল অধ্যাদেশ জারি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই দালাল আইনে সর্বনিম্ন ২ বছরের কারাদণ্ড থেকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
একটি জাতিকে নিস্তব্ধ করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া। ৪ ডিসেম্বর থেকে ঢাকায় নতুন করে কার্ফু জারি করা হয়। নিশ্চিন্ত পরাজয় জেনে হানাদার বাহিনী ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেয়। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে ৪০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলেন বদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনউদ্দিন (অপারেশন ইনচার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়া বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় ২০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল। চৌধুরী মঈনউদ্দিন ৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি অবজারভার ভবন থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহম্মদকে পৌঁছে দিতেন। এ ছাড়াও আরও ছিলেন এবিএম খালেক মজুমদার (শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকারী), মাওলানা আব্দুল মান্নান (ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী), আব্দুল কাদের মোল্লা (কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী) প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী।
যারা স্বাধীনতার আন্দোলনে জনগণের আবেগ ও আদর্শকে ছুঁতে পেরেছিলেন, এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক জাতীয় সংগ্রামে যারা ছিলেন ফলার মতো, সেই সব ব্যক্তিদের তারা নিশানা করেছিল।
১৯৭১ এ যুদ্ধকালীন দীর্ঘ ৯ মাস ধরেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে। তবে আজকের দিনে ১৪ ডিসেম্বরই বেশি সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল বলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর এই দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। বিজয়ের আনন্দকে সামনে রেখে জাতি আজ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা ও বেদনার সঙ্গে স্মরণ করবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন ইতিহাসের নৃশংসতম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা এই সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার এই নীল নকশা প্রণয়ন করেন সে’সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী। ১৯৭১-এ নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ডা. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, আনোয়ার পাশা, ডা. জি সি দেব, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ডাক্তার ফজলে রাব্বী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীন আহমেদ, ডা. আলীম চৌধুরী, অধ্যাপক শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, নিজামুদ্দীন আহমদ, খন্দকার আবু তালেব, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, শহীদ সাবের, বাবু নতুন চন্দ্র সিংহ, রশীদুল হাসান, রনদা প্রাসাদ সাহা, আবুল খায়ের, সিরাজুল হক খান, সেলিনা পারভীন, ড. সাদেক, ড. আমীনুদ্দিন, ড. মুক্তাদির, সাইদুল হাসান, আরও অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে আমরা এই দিনে হারিয়েছি। প্রাপ্ত তথ্য সূত্রের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধানে জানা যায় একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন আনুমানিক ৯৯৮ জন শিক্ষাবিদ, ১৫ জন সাংবাদিক, ৫২ জন চিকিৎসক, ৪৪ জন আইনজীবী এবং ২০ জন সাহিত্যিক, শিল্পী ও প্রকৌশলী।
একাত্তরের পরাজয় আসন্ন জেনে হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার নীল নকশা নিয়েই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করতে মাঠে নেমে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ বাহিনীর সদস্যরা রাতের আঁধারে কখনো ছাত্রবেশে, কখনো বন্ধুবেশে বাড়ি বাড়িতে প্রবেশ করে বুদ্ধিজীবীদের কৌশলে ডেকে নিয়ে তুলে দিত তাদের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রভুদের হাতে বা নিজেরাই হত্যা করত তাদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ ক্যাম্প বা বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো তাদের। শহরে জারিকৃত কার্ফুর সুযোগে বুদ্ধিজীবীদের সহজেই বাড়ি থেকে তুলে আনা সম্ভব হতো। হত্যার আগে চলত বীভৎস শারীরিক নির্যাতন। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হতো তাদের দেহ। বিজয়ের পর পরই ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের চিহ্নসহ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মরদেহ পাওয়া যায় রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে। ঢাকার অপর আরেকটি প্রধান বধ্যভূমি মিরপুরে ছিল লাশের স্তূপ। এই দুই জায়গাতেই ডোবা, নালা, নীচু জায়গায় ইটের ভাঁটির মধ্যে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়েছিল এই সব বধ্যভূমিতে। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা ও পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ক্ষত-বিক্ষত লাশগুলোর অধিকাংশ দেহগুলো ফুলে উঠেছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের সবচেয়ে বেশি জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায় আলবদর বাহিনীর বিরুদ্ধে। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ তাঁরা সারাদেশে প্রায় ৯৫০টি বধ্যভূমি শনাক্ত করতে পেরেছে।
বধ্যভূমিময় বাংলাদেশের মাটিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অস্থি-মজ্জা-হাড় তিরিশ লাখ শহীদের দেহাবশেষের সঙ্গে মিশে আছে। এই দেশের আকাশ তাদেরই শেষ নিঃশ্বাসের বেদনায় নীল। এই বাংলার উদিত সূর্যে তাদেরই রক্তের লালিমা। নদীতে নদীতে তাদেরই অশ্রু বেদনার প্লাবন। এই বাংলাদেশ চিরকাল সেই ঘাতকদের অভিশাপ দেবে।
এখনো রক্তাক্ত ক্ষতের মতো জাগ্রত ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর। চিহ্নিত-অচিহ্নিত বধ্যভূমির মাটিতে, ভুলে যাওয়া বন্দিশালার দেওয়ালে, স্বজনহারাদের স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো একাত্তরের সকল মৃত্যু দুঃখের প্রদীপ হয়ে জ্বলে। সেই অজস্র ব্যথার পূজা এখনো যে হয়নি সমাপন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই দিনে ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি তার প্রিয় বুদ্ধিজীবীদের হারিয়ে শোকে ম্যুহমান হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে প্রতি বছর গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মোহাম্মদ আলী