ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ট্রাক সেল

অনার্য মামুন

প্রকাশিত: ১৮:৫৪, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্রাক সেল

সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে তত দীর্ঘ হচ্ছে ক্রেতাদের লাইন। নারী এবং পুরুষদের আলাদা আলাদা লাইন। পিছনের অনেকে আশঙ্কায় ভুগছে এই ভেবে যে, তারা হয়তো শেষমেষ কিচ্ছু পাবে না, হয়তো তাদের শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরে যেতে হবে। হেমন্তের রোদ তত কড়া নয়। তবুও অনেকে ঘামছে। মাঝে মাঝে দু-একজন মাঝখান থেকে লাইনের ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইছে আর তখনই একটা হট্টগোল তৈরি হয়। পিছন থেকে চিৎকার ওঠে দুই ঘণ্টা ধইরা দাঁড়ায়া আছি, লাইনের মাঝখানে কেউ ঢুকবেন না। থেকে থেকে ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি। নারী কন্ঠে চিৎকার। ট্রাকের ওপর থেকে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে, কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে তাকে পণ্য দেওয়া হবে না। নানা বয়সের নারী পুরুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লাইন এগুচ্ছে না বলে কারও কারও মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। পিছন থেকে সবুজ শাড়ি পরা এক কিশোরী চিৎকার করে উঠল ‘আর কয় ঘণ্টা দাঁড়ামু’। কারও কানেই গেল না এই কথা। ট্রাকের ওপর বিক্রেতারা বিড়ি ফুঁকছে। বেলা বাড়ছে লাইন আরও দীর্ঘ হচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, যত লোক দাঁড়াইছে হক্কলেরে মাল দিতে হইলে এই রকম তিন ট্যারাক মাল লাগব। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে পণ্য পাবার আশায় মানুষের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর লাইন। ইঠাৎ ট্রাকের মুখে চেচামেচি শুরু হলো। মধ্যবয়স্ক এক নারী প্রতিবাদের সুরে চিৎকার করে বলছে, আগের জনরে দুটা তেল দিলেন আমারে একটা তেল দেন ক্যান? ট্রাক থেকে পুরুষ কণ্ঠে ভেসে এলো- ‘দুইটা কইরা আর দেওন যাইব না’। যানজট লেগে গেছে। মানুষের আহাজারি আর যানবাহনের শব্দ যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে। যারা পণ্য পাচ্ছে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর যারা অপেক্ষায় আছে তাদের চোখেমুখে আশঙ্কার ছাপ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ট্রাকের ওপর থেকে ঘোষনা এলো, তেল শেষ! অনেকের চোখেমুখে কালো মেঘের ছায়া পড়লো। লম্বা পাতলা একটি মেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে সস্তা আলুর চিপস্ খাচ্ছে। এই পাশে দাড়িওয়ালা একজন বিড়ি ফুকছে। পিছন থেকে দুতিন জন আপত্তি জানাল এই যে ভাই লাইন ছাইড়া দিয়া বিড়ি টানেন! তার কিছুক্ষণ পরে সামনে থেকে সংবাদ এলো ডাল শেষ। পিছনে দাঁড়ানো লাইনের মধ্যে গুঞ্জন উঠলো আমরা কি কিছুই পামু না? খালি হাত পাও লইয়া বাড়ি যামু?
অনেকের চেহারায় হতাশার ছাপ। কেউ বলছে তিন ঘণ্টা, কেউ বলছে চার ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নারী এবং পুরুষদের পাশাপাশি লাইন। সকলেরই উদ্দেশ্য এক।
কখন পাবো পণ্য। আঁচলের গিঠ থেকে মোচড়ানো এক পুটুলি পান মুখে পুড়ে বয়স্কা নারীটি বলল-আমাগো সাইধ্য আছে বাজার থন কিন্না খাওনের। বাসা বাড়িতে কাম করি, বকা হুনি, কতো কষ্ট করি, তাইতেও সংসার চলে না। আগমো হইছে পোড়া কপাল! অহন যদি চাইল ডাইল না পাই, মনডা কেমন লাগব।
একটি নেড়ি কুকুর পা খোঁড়াতে খোঁড়াতে পণ্য প্রার্থীদের লাইনের পাশ দিয়ে গেল। কেউ হয়তো তাকে মেরেছে, কুকুরটির পিছনের বাপাশের পাটি সামান্য উঁচু করে খোঁড়াচ্ছিল। লাল সেলোয়ার কামিজ পরা মেয়েটি কুকুরটিকে লক্ষ্য করল। তার ভেতরে যন্ত্রণা বোধ হচ্ছিল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কুকুরটি দূরে চলে যাবার পরেও মেয়েটি বারবার ফিরে দেখছিল কুকুরটিকে। পাশের নারীটি ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল-কী দেহস? মেয়িটি কিছু বলে না। শুধু তার মনে পড়ে ঘরে রেখে আসা সাত বছরের সুমাইয়ার কথা। তার এই সাত বছরের মেয়েটি পলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে চলৎশক্তি হারায়। একজন অথর্ব ভিখারি ফুটপাত দিয়ে কুঁজো হয়ে দুই হাতে ভর দিয়ে নিজের শরীরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এ্যালুমুনিয়মের থালাটি সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যখন থালাটি সামনের দিকে ঠেলে দেয় তার মধ্যে জমে থাকা কাঁচা পয়সাগুলো ঝন্ঝন্ করে উঠে। ভিখিরিটি একবার পণ্য প্রার্থীদের লাইনের দিতে তাকায় পরক্ষণেই সে তার ক্ষুন্নিবৃত্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ফুটপাতের ধারঘেঁষে দুটি চায়ের স্টল। যেখানে পলিথিল ব্যাগে নানা ধরনের বিস্কুট রুটি এবং কলার ফানা ঝুলছে। ওদিকটায় ভ্যান গাড়িতে সবজি, অন্য আরেকটা ভ্যানে আমড়া, আনারস বিক্রি হচ্ছে। পথচারীরা ফুটপাত দিয়ে দ্রুত হেঁটে যায়। কেউ কেউ লাইনে দাঁড়ি থাকা মানুষগুলোর দিকে একটু তাকায়। ট্রাকের ওপর সেলস্ম্যানরা ভীষণ ব্যস্ত। প্রাইভেট কার গুলো হর্ন বাজিয়ে দ্রুত চলে যায়। রিকশার বেলের টুংটাং শব্দ। রিক্শার আরোহীরা আগ্রহ নিয়ে লম্বা লাইনের দিকে তাকায়। অনেকের চোখে মুখে অধৈর্যের ছাপ প্রকট হয়ে ওঠে। পুরুষদের লাইনে হঠাৎ  ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। কারণ বোঝা গেল না। সম্ভবত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় অধৈর্যের কারণে কারও গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিক্রিয়ার পরিণতিতে এরকম হতে পারে। একটু একটু করে লাইন এগিয়ে যায়। বেলা বাড়ে। হেমন্তের বাতাসে শহরের ধুলো। উড়াল সেতুর কারণে যানবাহনের চিৎকার আরও বেড়েছে। কমেছে শহরের গাছপালা। কমেছে অক্সিজেনের মাত্রা।
কেউ কেউ মালামাল নিয়ে রিকশা ভাড়া করছে, আবার কেউ কেউ হেঁটেই গন্তব্যে ছুটছে। মাঝ বয়সী এক খালা পান চিবুতে চিবুতে বলছে- মনড়া কয় বেডাগো মাথায় একটা বারি দেই। এখনো লম্বা লাইন লোকজন দাঁড়িয়ে আছে আশায়। লাইন ছেড়ে একজন তরুণী ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল। ফিরে এসে বলল- মনে অইতাছে আমরা পামু না, মাল প্যারায় শ্যাষ। হতাশার গুঞ্জন ওঠলো দুই পাশেই। সারাদিনের শ্রম কি বৃথা যাবে? ছুডু একটা টেরাক ভইরা মাল আনছে, আর মানুষ কত্তোগুলা! কথাগুলো হতাশার সুরে বলে লাল জামা পরা একজন নারী।
ট্রাকের ওপরে দাঁড়িয়ে প্রধান বিক্রয় কর্তা ঘোষণা করলো-আজকের মতো মাল শেষ। সঙ্গে সঙ্গে একটা চিৎকার চেচামেচি শুধু হয়ে গেল। কেউ কেউ রুক্ষ্ম ভাষায় বকাঝকা দিতে লাগলো। আর কেউ কেউ নীরবে চলে গেল। গুঞ্জন ধ্বনি থামছে না। কেউ কেউ আফসোসে ফেটে পড়ছে। বৃদ্ধা এক নারী একটু দূরে ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে বলছে-
মাল নাই বালো কতা, তয়, বাজারের মালের দাম ট্রাকের মালের দামের হমান করলে আমগো আর এই কষ্ট করন লাগে না।

মোহাম্মদ আলী

×