বেগম রোকেয়া জাতীয়ভাবে কোন মর্যাদায় পৌঁছেছেন তা ‘রোকেয়া দিবস’ নামে আলাদাভাবে দিবসের স্বীকৃতিতেই বোঝা যায়। তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও দর্শনের মধ্যে একটা ইউটোপিয়ান জগত আছে। এ জগতটি তিনি তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করে গেছেন।
‘ইউটোপিয়া’ মূলত গ্রিক শব্দ eutopos যার অর্থ ‘সুরম্য একটি স্থান’। টমাস ম্যুর তাঁর utopia বইতে প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন ১৫১৬ সালে। ‘কল্পরাজ্য’ বা ‘স্বপ্নরাষ্ট্র’ এর মূলকথা। বেগম রোকেয়ার মনোজগতে নারীমুক্তির জন্য যে চেতনা ছিল তার সবটা জুড়েই একটা ইউটোপিয়ান জগত তিনি নির্মাণ করেছেন। সেখানে তিনি নারীর আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ পরিচয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কাজটি আরও কিছু সাহিত্যিক করলেও তাঁদের সঙ্গে রোকেয়ার পার্থক্য হলো তিনি নারীর পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে নারীর বাধ্যগত মানসিকতাকেই দায়ী করেছেন, পুরুষতন্ত্র তো অবশ্যই বাধা কিন্তু সেটাই তিনি সর্বস্ব মনে করেননি। নারীর সীমাবদ্ধতা দিয়েই নারীকে তার মুক্তির উপায় খুঁজতে বলেছেন।
সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসিকা ১৯০৮ সালে indian ladies magayine-এ ইংরেজিতে প্রথমে প্রকাশিত হয় Suntanas Dream নামে। এ বইটির যে গল্প এটি সম্পূর্ণভাবে নারীর জন্য কল্পিত একটি রাষ্ট্রচেতনা যাকে তিনি বাইনারি হিসেবে বাস্তবের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে দেখান। পুরুষকে ঘরের ভেতরে রেখে নারীকে বাইরে এনে আরাম কেদারায় বসে সুলতানার যে স্বপ্ন রোকেয়া দেখান তৎকালীন সময়ের জন্য সেটি অভাবনীয় প্লট ছিল। সুলতানার সে স্বপ্নের সঙ্গে ইউরোপীয় ভগ্নি ‘সারা’ নতুন পালক যোগ করে। নতুন এক রাষ্ট্রে সুলতানার প্রতীকে রোকেয়া চলে যান যে রাষ্ট্রের নাম ‘নারীস্থান। সেখানে পুরুষরা গৃহবন্দি আর নারীরা সমাজের চালিকাশক্তি। সে রাষ্ট্রের মূলশক্তি ভালোবাসা ও সত্য। পাশের রাজ্য থেকে কিছু বিদ্রোহী চলে আসে নারীস্থানে কারণ তারা সে রাজ্যের দুঃশাসন মানতে পারছে না। এ রাজ্যের রাণী তাদের আশ্রয় দেওয়ায় লাগলো যুদ্ধ। দলে দলে সৈনিকরা আহত ও নিহত হতে লাগলো। রাজ্য বিপন্ন, পুরুষ প্রায় নিঃস্ব। কি করা যায়! সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ঘুম, খাওয়া কিছুই হয় না। শেষে এগিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি নারী এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র নেই, সবাই ছাত্রী। দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবিকা নিয়ে রওনা দিলেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগৃহীত সূর্যের আলো দূর থেকে দেন শত্রুপক্ষের দিকে। তারা পালিয়ে যায়। যুদ্ধজয়ের আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান বলেছিলেন পুরুষদের অন্তঃপুরে বা বাড়ির ভেতরে থাকতে হবে। সেই থেকেই পুরুষরা সবাই ঘরে থাকে, মেয়েরা থাকে বাইরে। সারার সংলাপ-এটা মেয়েদের জায়গা এখানে পুরুষপনা চলবে না। বইটির অন্তর্গত চেতনাই ছিল ইউটোপিয় যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিপরীতে নারীর নিজস্ব জগত নির্মাণের মাধ্যমে অপূর্ব এক প্রতিবাদ। রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনও এর প্রশংসা করে বলেন- ‘এ এক মধুর প্রতিশোধ’।
রোকেয়ার একমাত্র পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৪)-এও ‘সুলতানার স্বপ্ন’-র মতোই ইউটোপিয় চেতনার প্রকাশ স্পষ্ট। ঐ বইয়ের ‘নারীস্থান’-এর মতোই ‘পদ্মরাগ’-এও ‘তারিণী ভবন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দেখা মেলে। এর লক্ষ্য সম্পর্কে রোকেয়া বলছেন- ‘যে বিধবার তিন কুলে কেউ নাই, সে কোথায় আশ্রয় পাইবে?- তারিণী-ভবনে। যে বালিকার কেহ নাই, সে কোথায় শিক্ষা লাভ করিবে?- তারিণী-বিদ্যালয়ে। যে সধবা স্বামীর পাশবিক অত্যাচারে চূর্ণ-বিচূর্ণ জরাজীর্ণ হইয়া গৃহত্যাগ করিতে বাধ্য হয়, সে কোথায় আশ্রয় পাইবে?- তারিণী-কর্ম্মালয়ে। যে দরিদ্র দুরারোগ্য রোগে ভুগিতেছে তাহারও আশ্রয়স্থল ঐ তারিণী-আতুরাশ্রম।’ যত নারী নিগৃহীত হয়েছে তাদের সবার ঠিকানা বলা হয়েছে তারিণী ভবনকে। রোকেয়ার মনোজগতে এটিও একটি স্বপ্নরাজ্য হয়ে উঠেছে নারীর জন্য।
রোকেয়ার বহুল পঠিত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘অবরোধবাসিনী’-তে (১৯৩১) তৎকালীন পিছিয়ে থাকা আত্মসমর্পিত নারীর চিত্র যেভাবে উঠে এসেছে তার মধ্যে দুটি ঘটনা বলা যাক -
এক মহিলা স্বামীর মুখটিও ভালোমতো দেখেনি বিয়ের পর। একবার এক ভিড়ের মধ্যে অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে যেতে থাকে কারণ আরেকজনকে একই পোশাকে দেখেছে তার স্বামীর মতো।
আরেক মেয়ের বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়। তার মত ছিল না কারণ ছেলের বয়স বেশি আর স্বভাবেও খারাপ কিন্তু বিয়ে দেবেই পরিবার। মেয়ে কবুল বলার সময় কিছুতেই বলবে না তখন পাশ থেকে জোরে চিমটি কাটা হয় তাকে সেই চিমটির ‘উহ’ ব্যথাযুক্ত শব্দকে হ্যাঁ-সূচক মনে করে বিয়ে সম্পন্ন হয়। এমনই ছিল অবরোধ প্রথা। নারীর জন্য সেই অন্ধকার সমাজকে আলোর দিকে নিতে রোকেয়া সাহিত্যিক থেকে হয়ে ওঠেন সমাজ সংস্কারক। স্বশিক্ষিত শিক্ষা থেকে মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল গড়েছেন। স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের অঢেল সম্পত্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল, ভাগলপুর স্কুল’ তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়া অনেক নারী সংগঠন তাঁর উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করতেন, অভিভাবকদের বোঝাতেন নারীশিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে। পর্দা ঘেরা গাড়িতে করে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যেতেন তাও শিক্ষা অর্জন করুক। নারীশিক্ষার জন্য রোকেয়া সাহিত্যের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার এবং শিক্ষাকে দৃশ্যমান বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার যে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেন সেটিও ছিল তার নারীর জন্য স্বপ্নরাষ্ট্র নির্মাণের চেতনা।
ব্যক্তি রোকেয়া ও তাঁর সাহিত্য এবং প্রতিষ্ঠান সবকিছুই একটা উপরিতল কিন্তু গভীরতলে রোকেয়া সবকিছুকে তুলে ধরেছেন তাঁর কাক্সিক্ষত সেই ইউটোপিয়ান মানসিকতায়।