ভোরবেলা। সূর্য্য সবে উঠি উঠি করছে। লন্ডনে ভোর হয় কিছুটা দেরিতে। মানুষ, বিশেষত বাঙালিরা বিছানা ছেড়ে ওঠে আরো দেরিতে। এ দেশবাসী যখন ওঠার প্রয়োজন হয়, তখনি ওঠে। হাড় কাঁপানো শীতেও তাদের ভোরে উঠবার অভ্যেস আছে। তাদের জন্মই তো শীতের দেশে। তারা ভোরে উঠে নিজেদের কার নিয়ে অফিসে চলে যায়। তাদের কাছে শীত-গ্রীষ্ম দুটোই সমান। বাঙালিদের কাছে লন্ডনে যখন তুষার পড়ে তখন মনে হয় শুধুই বিছানা। বিছানা ছাড়া সুখের স্থান আর কিছুই যেন নয়। গভীর রাত পর্যন্ত রেস্তরাঁয় কাজ করে গভীর রাতে বাসায় ফিরে কোনোরকমে কাপড় বদলিয়ে বিছানায় গেলেই পরম প্রশান্তি। বেশিরভাগ ডিনার রেস্তরাঁয়ই সেরে আসে। একইভাবে বাঙালি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর রেস্তরাঁগুলো একটু দেরিতে খোলে। যারা বিলেতি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে বা ভোরে উঠে বিশ^বিদ্যালয়ে যায় তারা ব্রিটিশ রেস্টুরেন্টেই হয়ত একটি স্যান্ডউইচ গলধঃধারণ করে এক কাপ কফি খেয়েই ক্লাসে ঢুকে পড়ে। পরে হয়ত এগারোটায় একটি ফুল লাঞ্চ করে। এখানে এগারোটাতেই বাঙালিদের লাঞ্চের পর্ব শুরু হয়। ইংরেজরা একটা বা দেড়টাতে লাঞ্চ করে তা সে শীতেই হোক বা বসন্তে।
আজ সে একটু সকাল সকাল ঘুম ছেড়ে বিছানা থেকে উঠেছে। কিচেনে এসে খাঁটি ব্রাজেলিয়ান কফিপট থেকে দুই চামচ কফি নিয়ে কুকারের গরম পানিতে ছেড়ে দিল। তারপর তিন মিনিট পর নামালো। ফ্রিজ থেকে কিছুটা লিকুইড দুধ নিয়ে কাপে ছেড়ে দিয়ে দেড় চামচ চিনি নিয়ে চামুচ দিয়ে চিনিটা নাড়তে নাড়তে সোফায় এসে বসল।
তার বিছানায় সাব্রিনা ঘুমুচ্ছে। দু’জনেই গতরাতে এক বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। বাসায় একটি শোবার ঘর ছাড়া কিচেন আর এই বসবার ঘর। শোবার ঘরে এ্যটাচ্ড বাথরুম রয়েছে। এছাড়া আলাদা আর কোনো ঘর নেই। সদ্য বিয়েওয়ালা এক ব্রিটিশ কর্মজীবী পরিবারের একটি সেমি-ডুপ্লেক্সের দোতলায় সে এই বাসাটি ভাড়া নিয়েছে। পড়াশুনার পাট চুকিয়ে সে এখন একটি ব্রিটিশ মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। বেতন মোটামুটি ভালো। ইচ্ছে করেই এখনো বড় বাড়ি নেয়নি। আগের বাসাতেই থেকে গেছে।
সাব্রিনাকে সে প্রথম দেখে বাংলা থিয়েটারে। সেদিন বিকেল চারটায় বাংলা থিয়েটার মঞ্চে কাজী নজরুলের নারী কবিতাটি আবৃত্তি করছিল সাব্রিনা। খুবই সুন্দর আবৃত্তির কণ্ঠ। আবৃত্তিও করছিল খুবই সুন্দর। মুখস্থ ছিল। আবৃত্তি যখন করছিল, তখন দুই হাত, শরীরও আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছিল। আর মঞ্চের গ্যালারি থেকে বিভিন্ন রঙের আলো প্রক্ষেপ হচ্ছিল। সে কাজী নজরুলের ওপর লিখে নিয়ে যাওয়া একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিল। সেদিনই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। সামান্য হাই, হ্যালো হয়।
এরও প্রায় সাত দিন পর লন্ডনের বাংলা মার্কেটের চিংড়ি দোপেঁয়াজা হোটেলে আলাপটা যেন একটু জমে। সে রাত দশটার দিকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া চিংড়িতে বেশ মজা করে ভাত খাচ্ছিল। এমন সময় হাই শুনে মাথা তুলে তাকাতেই দেখল সেদিনের তরুণী। হাই! আমি সাব্রিনা! মনে আছে সেদিনের বাংলা থিয়েটারে?
সে বলে ওঠে, ইয়েস ইয়েস মিস . . .
সাব্রিনা!
-এন্ড আই অ্যাম জুয়েল। জুয়েল আহমেদ।
-থ্যাংক ইউ মিস্টার জুয়েল আহমেদ। ক্যান আই সিট হিয়ার অন দিস এম্পটি চেয়ার?
-ইয়েস। সিয়োর। প্লিজ।
-আমি রাতের ডিনার করব। আজ কেন যেন রাঁধতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটিতে থার্ডইয়ার অনার্সে কম্প্যারেটিভ লিটারেচার পড়ছি। বলেই সে দুই চেয়ারের বাঙালি রেস্টুরেন্টটির ছোট টেবিলটায় জুয়েলের সম্মুখে বসল।
-বান্ধবীরা মিলে এসেছিলাম এদিকটায়। ওরা বন্ধুদের নিয়ে পাশের ইংরেজি রেস্টুরেন্টে চলে গেল। আমার ইংরেজি খাবার এখনো অভ্যেস হয়নি। সামনে চিংড়ি দোপেঁয়াজা হোটেল নাম পড়েই ঝটপট ঢুকে পড়লাম। ‘ও মাগো! কী শীত!’ বলে সাব্রিনা দুই হাতে তালু ঘষা শুরু করল। এমন সময় অর্ডার নিতে আসা মেয়েটিকে সে বলল, সেম লাইক দিস। চিংড়ি কারি এন্ড রাইস। বেয়ারার চলে যেতেই সাব্রিনা বলল, ইদানীং লন্ডনে শীতে আর্লী ইভিনিংয়েই তুষার পড়া শুরু হয় দেখছি। আগে তো মিডনাইট বা লেটনাইটে তুষার পড়ত।
তারা দু’জনেই খাবার শেষ করে ধুমায়িত কফি নিয়ে বসল। সাব্রিনা বলল, বাইরে তো এই সাত সন্ধ্যায় রীতিমতো তুষার পড়ছে। বাসায় যেতে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে আমাকে রীতিমতো হাঁপিয়ে যেতে হবে এই তুষারের ভেতর। ঠিক আছে, অসুবিধে নেই, আমি আপনাকে আমার গাড়িতে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড বা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেব, ডোন্ট ওরি।
-গ্রান্ড থ্যাংকস।
সে রাতে এর পরে আর খুব বেশি কথা হয়নি। কিন্তু গত সন্ধ্যেয় আবার যখন সাব্রিনার সঙ্গে ট্রাফালগার স্কয়ারে দেখা হয় দুজনের সেদিন যেন অন্যরকম লাগছিল তাকে। জিনসের লং প্যান্ট, সোয়েটার, সোয়েটারের ওপর লম্বা একটি ওভারকোর্ট। পায়ে জুতো। বলতে গেলে ঠান্ডাকে বাধা দেওয়ার কোনো কার্পণ্যই রাখেনি সাব্রিনা। কপালে ছোট্ট একটি সবুজ টিপ মনে হচ্ছিল সারা রেস্টুরেন্টতে একটি বিশাল বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে রেখেছে। তবু সে মাঝে-মধ্যেই দুই হাতের তালু ঘষছিল। জুয়েল ভাবল, আশপাশে মার্কেট থেকে উলেন এক জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস্ কিনে এনে তাকে দেবে কী না। কিন্তু তার আগেই সাব্রিনা বলে ওঠে,
বসতে পারি এই খালি চেয়ারটায়? কোন বন্ধু আসবে বুঝি?
আপাতত আমার কোন বন্ধু হয়নি।
তুমি আমার বন্ধু হবে? এক নিশ^াসে সাব্রিনা বলে ফেলে।
-বন্ধু?
হ্যাঁ বন্ধু। কেন, ছেলেবেলায় স্কুলে তোমার কোনো বন্ধু ছিল না?
-ছিল। তবে এই প্রবাসে ... জুয়েল সাব্রিনার এতোগুলো কথায় হকচকিয়ে যায়।
-এই প্রবাসে আমিই না হয় তোমার বন্ধু হলাম, তুমি আমার বন্ধু হবে। খুবই স্বাভাবিকভাবে বলে সাব্রিনা। এতো শান্ত, নির্বিগ্ন-চিত্তে সাব্রিনা কথা বলতে থাকে যে জুয়েলও কোনো কিছুতে না বলতে পারে না, হ্যাঁ-ও বলতে পারে না।
-এই তিন বছরে লন্ডনে বন্ধু পাতাবার একজনকেও বুঝি খুঁজে পাওনি?
-বছর তিনেক পড়াশুনা, লাইব্রেরি আর এক্সাম নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। ওদিকে তাকাবার কোনো সময়ই পাইনি। তাছাড়া এসব দেশে বন্ধু করা মানেই রিস্ক।
-কেন, কিসের রিস্ক?
-পুরুষদের রিস্ক না থাকলেও মেয়েদের পুরুষবন্ধু বানানো আসলেই রিস্ক, যদি সে বিশ^াসী বন্ধু না হয়।
-অথচ মাত্র এই কয় মাসে আমাকে বিশ^াসী বন্ধু মনে করে ফেললে?
-আমার মন-প্রাণ তোমাকে বিশ^াস করতে চাইছে যে!
-বেশ।
-থ্যাংক ইউ। আজ থেকে আমরা এই লন্ডন শহরে বন্ধু হলাম। স্রেফ বন্ধু, আর কিছু না। তুমি আমাকে বিশ^াস করে বন্ধু ডাকবে। আমিও তোমাকে বন্ধু বলে যা মনে আসবে, সে গল্পই শোনাব তোমাকে।
জুয়েল তাকিয়ে থাকে সাব্রিনার দিকে। কি সুন্দর সহজ-সরল কথা। কি সুন্দর সাবলীল ব্যবহার। কি সুন্দর টানা টানা চোখ। আর সেই চোখে বসে আছে এক বাঙালির বিশ^াসভরা দৃষ্টি।
হঠাৎ জুয়েলের চিন্তা থামিয়ে দিয়ে সাব্রিনা বলে, আচ্ছা ডিয়ার, কী খেলে শরীরটা একটু গরম গরম লাগবে? শীতে আমরা বাড়িতে হাঁসের গোশ খেতাম। এখানে কোথাও হাঁসের গোশ রান্না হয় তা তো জানিনে। ল্যাম্বের গোশ পাওয়া যায় ? ...
-আছে, ওয়ারউইক রোডে, মিউজিয়াম রোডে, থেমসের তীরের একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, সড়কেও তুষার জমতে শুরু করেছে, আর একদিন নিয়ে যাব।
-আচ্ছা জুয়েল, আজ আমি একটু স্কচ হুইস্কি খাই, কিচ্ছু হবে না।
-সাব্রিনা, তুমি মানে হুইস্কি ...
-আরে কিচ্ছু হবে না। আর মাথা যদি একটু ঘোরেও, তুমি তো আমার বিশ^াসী বন্ধু আছো, আমার রেসিডেন্টে পৌঁছে দেবে। আমার হোস্টেলের মেয়েরা কতো খায় এসব!
-না না। তোমাকে আমি ওটি খেতে অনুমতি দেব না।
-আরে ধেৎ! আমি কি নেশা করার জন্য পান করছি, না কী উল্লাস করার জন্য? আমি তো কিছুই করছিনে, সামান্য একটু টেস্ট করছি মাত্র।
জুয়েল বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। কিছু পরে ওয়েটারকে ডেকে মিডিয়াম এক বোতল স্কচ হুইস্কি আনতে বলে রেস্টুরেন্টের ভেতর কেবিনের মতো ঘেরা একটি রুমে আসে সাব্রিনাকে নিয়ে।
-এখানে কেন? এটা বাঙালি হোটেল কাম রেস্টুরেন্ট। এখানে এ দেশে সব বাঙালি ক্লায়েন্ট আসে। বিদেশীরাও আসে। বাঙালিরা যদি দেখে ওপেনলী ওয়াইন খাওয়া হচ্ছে তাহলে তারা এখানে আসা ছেড়ে দেবে। তাই কিছুটা আড়ালে এখানেই বিক্রি ও পানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জানোই তো এ দেশ সেক্যুলার দেশ।
হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে জোরে ‘জুয়েল’ ডাক শুনে তার চিন্তার সূত্র কেটে যায়। কখন যে তার কফি শেষ হয়ে গেছে খেয়ালও করেনি। ঘরে ঢুকেই দেখে সাব্রিনা ব্ল্যাংকেটটি বুক পর্যন্ত ডেকে রেখে বিছানায় বসে আছে। সে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সাব্রিনা ভয়ার্ত চোখে বলে উঠল, কাল রাতে কী হয়েছিল জুয়েল?
-ও কিছু না, তুমি সামান্য বেশি পান করেছিলে তো, তাই?
-ঠিক ঠিক বলো জুয়েল!
-কী আর হবে? যা হবার তা-ই হয়েছে। বলে মুচকি হেসে সে বিছানায় পাশে বসে ওর কাঁধদুটো দুই হাত দিয়ে ধরে। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, না। তুমি ঠিক ঠিক বলো।
-যা হবার তা-ই হয়েছে সাব্রিনা। বিধির বিধান কে খণ্ডাতে পারে?
-না। তুমি মিথ্যে বলছ, ঠিক ঠিক বলো, গর্জে ওঠে সাব্রিনা।
সাব্রিনা যখন উন্মাদের মতো বলল, তুমি ঠিক ঠিক বলো জুয়েল, তখন জুয়েল তার দু’হাত দিয়ে সাব্রিনার দুই কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, কাল রাতে কিচ্ছু হয়নি। কোন কিছুই হয়নি। আমি গাড়ি থেকে তোমাকে ধরে এনে কেবল ওভারকোর্টটি খুলে, জুতোগুলো খুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি। রাতে তুমি জেগে উঠলে যেন তোমাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে পারি তাই সারারাত এ বিছানায়ই কাটিয়ে দিয়েছি। আর কিচ্ছু হয়নি। এবার সে সাব্রিনার চুই চিবুক ধরে হিস্ হিস্ করে বলে উঠল, আমি জানি একটি মুসলিম মেয়ের কাছে তার সতীত্ব কতো মূল্যবান সম্পদ। কাল রাতে কোনো কিছুই হয়নি। তুমি আমার ঘরে অতিথি। আমি স্বপ্নেও আমার ঘরে আসা মেহমানের সঙ্গে কখনো এমনটি করতে পারি না তুমি যা শঙ্কা করছো। আমি ফান করছিলাম মাত্র।
প্রায় ক্রুদ্ধস্বরে সাব্রিনা বলল, আর কখনো আমার সঙ্গে তুমি এরকম ফান করবে না।
-ঠিক আছে, আর করবো না। তুমি আমার বন্ধু। তুমি আমাকে বিশ^াস করবে, আমিও তোমাকে বিশ^াস করব, এটাই আমাদের সম্পর্ক। অন্য কিছু নয়।
সাব্রিনা অচমকা জুয়েলকে জড়িয়ে ধরে। মুখে বলে, কখনো তুমি আমার সঙ্গে আর এমন ফান করবে না।
-আচ্ছা বেশ, আর কখনো করবো না।
কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ একইভাবে বসে রইল।
বোধহয় লন্ডন যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন এ বন্ধুত্বও বেঁচে থাকবে।
বন্ধু
শীর্ষ সংবাদ: