কবি মতিন বৈরাগী ঊনআশি-তে পা ফেলেছেন। মাথা থেকে চুল অপসৃত প্রায় এবং যা কিছু অবশিষ্ট, এখনও অশেষ, সাদা রঙের শুভ্রতায় অমলিন। ততোধিক তিনি তরুণপ্রাণ এবং তরুণাভিমুখী, নিরহংকার এবং হৃদয়াবেগে পরিপূর্ণ একজন মানুষ; সহসা সাক্ষাৎ থেকে একান্ত আপন করে নিতে পারেন নিমিষেই। কোনো অনুরোধ ব্যতিরেকে, নিজস্ব তাগিদে হঠাৎ কোনো তরুণের কবিতা নিয়ে লিখে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন সেই তরুণ কবিকেই; কেননা তিনি জানেন কবিতা এক প্রবাহ যাকে সঞ্চারিত করে দিতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আজীবন মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে, দেশের নানাবিধ সংকট ও উত্থান-পতনের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছেন এবং সম্পৃক্ত থেকেছেন। যে পথে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে বলে বহুকালব্যাপী পৃথিবীর একটা আদর্শ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এসেছে, আজ পরিবর্তিত সময় ও পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এখনও আস্থা রাখেন তাতে। তাঁর কবিতা তাই ব্যক্তিদীর্ণ অনুভবের থেকে এসে সামষ্টিকতায় ছড়িয়ে যায় এবং তা কোনোভাবেই নয় স্লোগানের সাময়িকতায়; বরং এক অন্তর্লীন কাব্যবোধের বোঝাপড়ায়, অনেক নিরাভরণ কিন্তু গভীরতায় লীন। কবি বৈরাগী লিখছেন তাঁর ‘আজকের বিপন্ন দিনে’ কবিতায় :
আজকের এই বিপন্ন দিনে সীমাহীন সমুদ্র-তীরে
যখন দাঁড়িয়ে খুঁজছো কখন হারিয়েছে দিনের সূর্য
তখন উচ্ছ্বসিত জলরাশির ক্রুদ্ধ গর্জন পাতালের শতকোটি নাগ
দিচ্ছে ছোবল তটরেখায় তোমার দু’পায়ে
নিস্তরঙ্গ জীবনে বুঝি দিতে চায় অন্য এক ভাষা আবেগ সৌরভ
তখন শতাব্দীর অন্ধকারে তুমি নৈঃশব্দের ঘরে দাঁড়িয়ে
তোমার সমুখে অথৈ সাগর-জলের ক্রুদ্ধ গর্জন, ভাবছো
দেখছো আকাশ!
‘উচ্ছ্বসিত জলরাশির ক্রুদ্ধ গর্জন পাতালের শতকোটি নাগ’-এর ফণায় এই বিপন্ন সময়কে তিনি উপমিত করছেন, যখন বিপন্নতার বোধ সংক্রামিত হওয়ার আগে প্রকৃতির এক ভয়ংকর সুন্দর রূপকেও আমরা প্রত্যক্ষ করি বিস্ময়ে। অবশ্য তিনি আর রূপকের মধ্যে থাকেন না শুধু আরো বেশি স্পষ্টতায় চলে আসেন যখন একই কবিতায় বলেন :
এমনো দিনের অন্ধকারে কতো জলজ প্রাণীর কঙ্কাল শামুকের মাছেদের
কিংবা হাঙরের, পাখিদের মানুষের আদিতম উৎসের
ধরিত্রি মাতার পাঁজরে
চেয়ে চেয়ে দেখো বুঝি! দেখিবারে পাও!
[...]
মানুষের সময় কাটে শাসক-শোষকের লোভ আর লুটমত্ত মচ্ছবে
প্রতারণায় ক্ষত-বিক্ষত হয় জোৎস্নার মিহিন শরীর
কালের দুষ্ট-চক্র রাষ্ট্র প্রতিদিন কাড়ে মানুষের ভালোবাসা, ভালো সে আশা
আলো ফোটে না যে
পৃথিবী কাঁদে হৃদয় ফাটানো চিৎকারে
মানুষ জাগে না
‘জলজ প্রাণীর কঙ্কাল’ চিত্রবন্ধে যে অনুক্ত হিংসা ও আক্রমন চিহ্নিত হয়, তা স্পষ্ট হয়ে যায় শাসক-শোষকের লোভ আর লুটমত্ত মচ্ছবে ক্ষতবিক্ষত জ্যোস্নার মিহিন শরীরের রূপকল্পে এসে। এভাবে প্রাকৃতিক সম্মোহনের মধ্য দিয়ে তিনি আজকের বিপন্ন দিনের গল্প শোনান পাঠককে।
এর থেকে তিনি মানুষের মুক্তি চান। মানুষের অন্তরে যে ভাষ্যগুলো অবরুদ্ধ হয়ে আছে তার মুক্তি চান তিনি। বলেন তিনি ‘ভাষ্যগুলো ভাষা হোক’ কবিতায় :
কান্নাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দাও, আত্মা হয়ে উঠুক,
বজ্র হোক বিক্রমে,
মেঘ হোক আকাশের, তুমুল তুফান উঠুক করোটির ভাঁজে,
অনন্ত এক ইচ্ছে ডানা মেলুক সপ্তরথের চাকা
জাগরণ জাগরণ বলে চিৎকার উঠুক তারস্বরে,
আর আবদ্ধ হৃদয় মুক্ত হোক
এই মুক্তি শুধু জাগতিক অর্থেই নয়, সামাজিক-রাষ্ট্রিক শোষণ বঞ্চনা থেকেই শুধু নয়; আরো বৃহত্তর পরিসরে মানুষের আত্মিক মুক্তির কথাও বলেন তিনি যখন উল্লেখ করেন একই কবিতায় পৃথিবীর পরম মানবসত্তা, মহাপ্রাণ বুদ্ধকে :
অনন্ত এক ইচ্ছের মতো
একই লোহুরং একই প্রাণমন থেকে
আবার জন্মাক মহাবুদ্ধ এক রাতে
পৃথিবীর সকল ক্রন্দন হোক জাগরণ সঙ্গীত
ভেসে যাক কপট মুখগুলো আলোর বন্যায়
১৬ নভেম্বর ছিল কবি মতিন বৈরাগীর জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে, তাঁর একান্ত প্রার্থনার মত আমরাও বলি কপট মুখগুলো আলোর বন্যায় ভেসে যাক এবং অন্ধকার ভেদ করে জেগে উঠুক করুণালেখন মহামতি বুদ্ধের মুখ। ওম শান্তি!
ভাষ্যগুলো ভাষা হোক
শীর্ষ সংবাদ: