.
একজন কবি আসলে কবি কি না? তার প্রথম পরীক্ষা দিতে হয় তার পরিবারের কাছে। কবিকে পরিবারের সদস্যরাই সন্দেহের চোখে দেখেন এবং ভাবেন সে কোনো কবি নয়। কবি তো হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দিন। এরপর তো আর কোনো কবির দরকার নাই অথবা আর কেউ কবি হবেন না। সুতরাং পরিবারের প্রধান কর্মক্ষম ব্যক্তিটি কি যেন হিজিবিজি লিখে লিখে সময় নষ্ট করেন। সংসারে অভাব ডেকে আনেন। তাই যে কোনো ভাবে তাকে এই অকাজ থেকে বিরত রাখতে যত পদ্ধতি আছে, তার সবটুকু অবলম্বন করেন পরিবারের সদস্যগণ। এ কথা সত্য, কবিতা লিখে স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চালানো যায় না। তাই কবি যদি সংসারের কর্তাব্যক্তি হন, তাহলে আসলেই অভাবের বটেরঝুরি সহজেই ওই সংসারে শিকড় গেড়ে বসে। বাইরের অনেকেই জানেন না কবিতা লিখতে প্রচুর লেখাপড়া করতে হয়। অধ্যবসায়ী হতে হয়। বৃদ্ধি করতে হয় কল্পনা শক্তির দীর্ঘলতা। শক্ত করতে হয় ছন্দের শিকড়। কিন্তু পরিবারের সদস্যগণ নিজ চোখে দেখে থাকেন সুস্থ সবল মানুষটার সময়ের অপচয়! উপার্জনের অনীহা! তাই কবিকে পরিবারের লোক পাগল বলে সম্বোধন করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। ব্যতিক্রম কিছু কবি আছেন যারা সরকারি চাকুরে। আমলা। তারা ভালো আয়রোজগার করলেও পরিবারের সদস্যদের ধারণা, তিনিও কবিতা লিখে ও বই ছেপে টাকাগুলো নষ্ট করছেন। এবং তাকে কবি বলে স্বীকার করেন না। কবিতার বইয়ের সৌজন্য কপি দিলেও গ্রহণ করতে চান না অনেকেই। যদিও তিনি একজন সফল কবি। শুধু পরিবারের লোকজন নয়। পাড়া-প্রতিবেশীরা কেমন যেন আড়চোখে তাকান। পিছনে সমালোচনা করেন। আত্মীয়স্বজনও একটু দূরে সরে থাকেন। বন্ধু-বান্ধব সতর্ক থাকে, ভাবে হয়তো টাকা পয়সা ধার চাইবে। আর কবি যদি কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। কর্তাব্যক্তিরা প্রথমে তার কবিতার অবমূল্যায়ন করবেন। নানাভাবে কাউন্সিলিং করবেন, এসব অকাজ! না করার জন্য। তিনি যে কবিতা লিখতে পারেন অথবা তিনি যে কবি, তার স্বীকৃতি তো দিবেনই না বরং পরামর্শ দিবেন ভালো কাজ করার জন্য। আজেবাজে কথা লিখে সময় এবং অর্থ অপচয় না করার জন্য। অবশেষে তাদের রেটিনায় প্রতিফলিত এই পাগল, অকর্মণ্য ব্যক্তির চাকরিটা খেয়ে ফেলবেন। আমরা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা জানি। যিনি তাঁর লিখনির মাধ্যমে ইংরেজ বেনিয়াদের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন। বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর বিশের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, চন্দ্রবিন্দু ও যুগবাণী নামের পাঁচটি বই। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা। খাটতে হয়েছিল জেল। করতে হয়েছিল অনশন।তব্ওু তাঁকে তৎকালীন সময়ের অনেক বিজ্ঞজনও কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান নাই। বরং সজনীকান্ত দাস তাঁর শনিবারের চিঠিতে নজরুলের কবিতা ব্যঙ্গ করে প্যারোডি লিখতেন। তাঁকে কটাক্ষ করে নানা সমালোচনা করতেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল সাড়ে চার বছরে মারা গেলে, দাফন করার মতো টাকা ছিল না কবির কাছে। একশ’ পঞ্চাশ টাকার প্রয়োজন ছিল। অনেক লাইব্রেরিতে লোক পাঠিয়ে দরজায় কড়া নেড়ে ছিলেন। কেউ টাকা দেননি। ডি,এম লাইব্রেরি মালিক অবশ্য পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়েছিলেন। অবশেষে এক প্রকাশককে ‘ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে / আমার গানের বুলবুলি/ করুণ চোখে চেয়ে আছে / সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি।-/কবিতাটা লিখে দিয়ে টাকা নিয়ে ছেলের দাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ত্রিশ দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশকে তো জীবিত অবস্থায় কেউ কবিই বলতেন না। ওই ক্যাম্পে কবিতাকে অশ্লীল বাক্যের বকবকানি নির্ধারণ করেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরিণামে কবিকে খুলনা মহিলা কলেজের অধ্যাপনা থেকে ইস্তফা দিয়ে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। ক্ষুধা কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। কবি সুধীন দত্ত তো তাঁকে কবি বলে গণ্যই করতেন না। জীবনানন্দ দাশের কবিতা তাঁর পত্রিকায় ছাপতেন না বললেই চলে। সুধীন দত্তের ছোট ভাইকে প্রাইভেট পড়াতেন কবি জীবনানন্দ দাশ।
কখনো একদিন পড়াতে না গেলে মাসের শেষে টাকা কেটে রাখতেন সুধীন দত্ত। কবি ফররুখ আহমেদ প্রতিষ্ঠিত কবি হওয়া সত্ত্বেও সমাজ, রাষ্ট্র তাঁকে মূল্যায়ন করেননি তাঁর জীবনকালে। কবির স্বীকৃতি বা সম্মান প্রকৃত অর্থে পাননি। দারিদ্র্যের সংগ্রামে শেষ করতে হয়েছে তাঁর প্রতিভার বারুদ। এমনকি মৃত্যুকালে দাফনের জায়গা হতো না, যদি কবি বেনজির আহমদ একটু সহানুভূতি না দেখাতেন। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার কবি সৈয়দ আশরাফ আলী ক্ষুধার জ্বালায় আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু কেউ তাঁর বই কেনেনি। কবি বলে তেমন পাত্তা দিতেন না। যদিও তাঁর মৃত্যুর পর বিএ ক্লাসের বাংলা বইতে কবির কবিতা স্থান পেয়েছিল। কবির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। নড়াইলের কবি আব্দুল গফুর সারাজীবন কষ্টের জোয়াল টেনে টেনে পরপারে চলে গেছেন। কবি হিসেবে সমাজ থেকে পান নাই তেমন সহানুভূতি বা স্বীকৃতি। এগিয়ে আসেন নাই কোনো প্রকাশক। ১৯৮৭ সালে একটা ফৌজদারি মামলায় আসামি পক্ষ কোর্টে গফুর কবিকে কবি নয় বলে অভিযোগ উপস্থাপন করেছিলেন। অথচ তখন কবি রেডিও বাংলাদেশ খুলনা কেন্দ্রে কবিতা ও গান বিষয়ক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন নিয়ে কাজ করতেন। এই মিথ্যে অভিযোগের বিপরীতে কবি ‘আসামী’ নামক একটা কবিতা লিখে পরবর্তী তারিখে আদালতে পাঠ করলে বিচারক আাসামিদের জামিন বাতিল করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছিলেন। এমনভাবে অসংখ্য কবি আছেন, কেউ তাঁদের কবি বলে স্বীকৃতি দেন না। বরং তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতার পাথর নিক্ষেপ করেন তাঁদের প্রতি। অবজ্ঞার আল্পনা আঁকেন তাঁদের কবিতার প্রতি। আবার অনেকে আছেন, তারা কবি সাজেন। নিজে কবিতার কিছু জানেন না। তবুও নিজেকে কবি বলে জাহির করেন। নিজের টাকা দিয়ে বই ছাপেন। যোগাযোগ করেন কিছু সাহিত্যপাতার কিংবা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে। কী এক জাদু বলে পত্রিকায়ও তাদের লেখা ছাপা হয়। এতে আরো বেশি বিপাকে পড়তে হয় প্রকৃত কবিকে। নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় বটে। সহ্য করতে হয় টাকাওয়ালাদের তাচ্ছিল্যতা। একজন কবিকে যেমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, একজন কথা সাহিত্যিককে বা নাট্যকারকে কিন্তু এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। পরিবার, সমাজের কাছে বরং একটু ভালো লিখতে পারলেই কেল্লা ফতে হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। ছাত্রজীবনে লেখালেখির জন্য বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। সংসার জীবনে বাড়িওয়ালার সঙ্গে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ সংক্রান্ত বিষয়ে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছিল বটে। তবে বিষয়টা সব সময়ই প্রকট ছিল কবিদের ক্ষেত্রে এবং এখনো আছে। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রশংসার বদলে কত বঞ্চনাই সহ্য করতে হয়েছিল কোলকাতাবাসীর কাছ থেকে। লালনের গান, গগন হরকরার গান ও সুর আত্মসাতের অভিযোগও আছে রবীন্দ্রনাথের ঝুলিতে। এমনিভাবে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনকে সহ্য করতে হয়েছে দীনেশচন্দ্র সেনের পক্ষপাতিত্বের! অভিযোগের মিথ্যে শূলের যন্ত্রণা। মোটকথা, সকল প্রতিষ্ঠিত কবিকে দিতে হয়েছে সংসার, সমাজ ও সমালোচকদের কাছে পরীক্ষা। সহ্য করতে হয়েছে গঞ্জনা। কবির চলার পথ মোটেই মসৃণ নয় বরং পিচ্ছিল। যত সমালোচনা একজন কবির করা হয়, তত সমালোচনা সাহিত্যের বাকি আর কোনো শাখার লেখকদেরও করা হয় না। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় কবিদের কেন এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়? তা ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনা করছি : সাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী শাখা হলো কবিতা। তবে পদ্য নয়, সেটা কবিতাই হতে হবে। একটি সার্থক কবিতা লেখা যত কঠিন, একটা সার্থক গল্প, উপন্যাস, নাটক লেখা কঠিন হলেও কবিতার মতো এত কঠিন নয়। ১) কবিতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার যোগসূত্র থাকে। তাইতো আগে গ্রীসে কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ একজন ভালো কবির কাছে ছুটে আসতেন, মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে কবিতা লেখার জন্য। অনেক অর্থ ব্যয়ে কবিতা লেখার পর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে তা পরিবেশন করা হতো তার বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য। আবার আরবেরা যুদ্ধের মাঠে কবিতা আবৃত্তি করতেন শক্তি অর্জনের জন্য। যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য। ২) কবিতা হলো ছন্দমাখানো কাল্পনিক আচার। যাদের অম্ল আছে, তারা যেমন আচার খেতে পারে না। তেমনি যাদের মেধা কম বা কবিতার প্রতি আগ্রহ কম, তারা কবিতা বুঝতে পারেন না। তাই কবিতা পড়তে চান না। কবিতার বই কেনেন না। কবির সমালোচনা করেন। উপহাস করেন। মোটকথা কবিকে কবিই বলেন না। ফলে, কবি আর্থিক দুর্দশায় ভোগেন। এতে সমাজে কবিদের মান মর্যাদা কমে যায়। ৩) আধুনিক কবিতায় পয়ার বা স্বরবৃত্ত ছন্দ তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহার করা হয়। যাতে অন্তমিল থাকে না। সাধারণ পাঠক ছন্দ, অন্তমিল বঞ্চিত হয়ে কবিতার থেকে দূরে সরে যায়। এবং কে কবি কে কবি নয়, তা অনেকে নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। ৪) আধুনিক কবিতার অজুহাতে কিছু লোক নিজের মনে যা আসে তাকেই কবিতা বলে চালিয়ে দিতে চান।
পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এতেও কবিতার পাঠক কমে যায়। আর প্রকৃত কবিকে জড়াতে হয় হাজারো প্রশ্নের বিষাক্ত লতার অস্বস্তিকর উত্তপ্ত বাঁধনে। ৫) কবিতার শ্রেণি বিন্যাসে মনোযোগী হতে হবে। ক) গবেষকদের জন্য কবিতা, খ) বিশ্ব সাহিত্য মঞ্চের জন্য কবিতা, গ) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কবিতা, ঘ) কলেজের তথা উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য কবিতা, ঙ) মাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য কবিতা, চ) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কবিতা অথবা ছ) শিশুদের জন্য ছড়া, জ) কিশোরদের জন্য কবিতা, ঞ) বয়স্কদের জন্য কবিতা, এমন ভাবে শ্রেণি বিন্যাস করা যেতে পারে ৬) জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকদের নতুন কবিদের খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতা, নবীন : প্রবীণ কবিদের কবিতা একটা আনুপাতিক হারে ছাপতে হবে। নাম দেখে বা অন্য কোনো কারণে অথবা অনুরোধে নয়, কবিতাকে মূল্যায়ন করতে হবে, ভালো কবিতা যারা লিখবেন, তারা সম্পাদক সাহেবের চেনা হোক আর না হোক, তাদের কবিতা ছাপতে হবে। পত্রিকার সামর্থ্য অনুযায়ী সম্মানি দিতে হবে। তাহলে কবিতার মান বাড়বে, কবিও প্রসংশিত হবেন। ৭) মানসম্মত লিটল ম্যাগাজিন বের করতে হবে। ৮) কবিদের আরো বেশি পড়তে হবে। বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতা পড়তে হবে। বহির্বিশ্বের কবিদের কবিতা পড়তে হবে। ছন্দজ্ঞান অর্জন করতে হবে। ছন্দের ঝংকারে পাঠককে আকৃষ্ট করতে হবে। শুধু অন্তমিল নয়, ছন্দও মানতে হবে।
এত কিছুর পরও কবিদের সমালোচনা থাকবে, কেউ কটাক্ষ করবেন। কেউ প্যারোডি লিখবেন। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করবেন। এগুলো সহ্য করতে হবে। কবিকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পাঠকের কাছে পরীক্ষা দিতে হবে। প্রকৃত কবি ও সমালোচকদের কাছেও পরীক্ষা দিতে হবে। কবি জীবনানন্দ দাশ ওই যে বলেছিলেন : সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সেই কেউ কেউ হতে হবে। প্রচুর পরিমাণে কাল্পনিক শক্তি থাকতে হবে। পরাবাস্তবতা বুঝতে হবে এবং ভালো কবিতা লিখতে হবে। পরীক্ষায় কবিকে উত্তীর্ণ হতে হবে।