কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ- আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখা অসময়ে ছেড়ে যাওয়া কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আকাশের ঠিকানায় পৌঁছে ভালো আছেন কি না তা জানা নেই পাঠক সমাজের। তবে কবির শব্দবাণী যে পাঠক সমাজকে চিরদীপ্ত করে রেখেছে সে কথা নিশ্চিত। বেঁচে থাকার মাত্র ৩৫টি বছরেই যেন কবিতা দিয়ে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, কবিতা দিয়ে প্রেম গেঁথেছিলেন। স্বচোক্ষে স্বাধীনতা দেখেছিলেন এবং ভালোবেসেছিলেন বলেই তাঁর কবিতায় এসেছে মুক্তির কথা।
ক্ষণজন্মা কবিরা সব সময়ই এক অতৃপ্তি রেখে যায় পাঠকের মাঝে। যেমনটা রেখে গেছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য অথবা জন কিটস। সুসুপ্ত পাঠকের খুব জানার ইচ্ছা থাকে যদি কবি আর দশজনের মতো একটু দীর্ঘায়ু হতেন তবে আর কত কবিতা উপহার দিতেন। তবে তা পূরণ হয় না, হবেও না। কবি রুদ্রর জন্ম হয় একবারই, রুদ্রর মতো কবিরা একবারই জন্মান। কবির দর্শন সব উঠেছে কবিতায় ফসল হয়ে। কবির ঘাম ছড়িয়েছে কলমের কালিতে। স্বাধীনতা পূববর্তী আন্দোলন, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ, অভাব আর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, দুর্ভিক্ষ, গণতন্ত্রের উত্থান-পতন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন ইত্যাদি ছিল কবিতার দর্শন এবং এসবের মধ্যেও প্রেম।
‘স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন/স্বাধীনতা-আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল/ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।’Ñ স্বাধীনতা নিয়ে এমন সত্য, সুন্দর, আবেগী কবিতার পঙ্ক্তি ক্ষণজন্মা তুমুল জনপ্রিয় কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর পাঠকপ্রিয় কবিতা ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতার। আবার তার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প কবিতার শেষ দিকে দেখি,’ সে এখন মৃত/তার শরীর ঘিরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো/ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত/তার থ্যাঁতলানো একখানা হাত/পড়ে আছে এ দেশের মানচিত্রের ওপর/আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা।’
কবিতার শব্দমালা কখনো অস্ত্র, আঘাত করে শোষকদের ক্ষমতার অন্তমূলে, কখনো তা প্রেমাবেগ-আঘাত করে হৃদয়ে। ছুঁয়ে যায় পাঠকের মন। কবিতা কখনো ব্যর্থতার অভিযান। পাওয়া না পাওয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্ব। কবি নতুন নতুন শব্দমালার জন্য অপেক্ষা করে। সাহিত্যে আজ পাঠক সংকট চলছে। কবিতার পাঠকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কবিতা থেকে পাঠকরা দূরে সরে যাচ্ছে না কবিতাই পাঠককে টানতে পারছে না সেটা একটা প্রশ্ন। তবুও যে অল্প সংখ্যক কবি কবিতার শক্তি দ্বারা পাঠকের হৃদয়ে মিশে আছে তাদেরই একজন কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা, কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন পাঠককে টেনেছিল এবং এখনো তার দিকেই টানছে। স্বল্পায়ু নিয়ে পৃথিবীতে আরও অনেক কবি সাহিত্য জগতে পদচারণা করেছেন। যাদের মৃত্যুর পর এক অতৃপ্তি পাঠকের হৃদয়ে আজও রয়েছে। যদি আরও দিন বেঁচে থাকতেন কবি! এমনই এক অতৃপ্তি রয়েছে কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ক্ষেত্রেও। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার কবিতায় স্বকীয় এবং ভিন্ন। কবিতায় যেমন খুঁজে পাওয়া যায় প্রেম, তেমনি পাওয়া যায় দ্রোহ। পাওয়া যায় স্বাধীনতাকে নিজের স্বজনরূপে।
এমন আপন করে স্বাধীনতাকে কত জন ভেবেছে? কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতায় সমাজ জীবনের ঘূর্ণাবর্ত এবং এই ঘূর্ণাবর্তে প্রেম-বিরহ উঠে এসেছে। কবির প্রেমের কবিতাগুলো হৃদয় নিংড়ানো আবেগের প্রকাশ হলেও কোথাও যেন শোনা গেছে হতাশার সুর। সব পেয়েও যেন অনেক না পাওয়ার আকুতি। এই পাওয়া-না পাওয়ার দ্বিধায় পাঠক একবার পড়ে আবারও শুরু করতে হয়। বোঝার চেষ্টা করে। তারপর আবার শুরু করে। অর্থাৎ বারবার পড়তে ইচ্ছা হয়। ভালোবেসেও যেন বাধা থাকতে চাননি। কবির ‘উল্টো ঘুড়ি’ কবিতায় লিখেছেন, সহজে যদিও ভালোবেসে ফেলি/সহজে থাকি না কাছে/পাছে বাঁধা পড়ে যাই/বিস্মিত তুমি যতবার টানো বন্ধন-সুতা ধরে।’ কবি তো কোনো বাঁধনে বেঁধে থাকতে চাননি।
চলেছেন যেন সব বাঁধন ছিন্ন করে। কবির ‘দূরে আছো দূরে’ কবিতায় লিখেছেন, তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে/উষ্ণ দেহ ছেনে ছেনে কুড়িয়েছি সুখ/পরস্পর খুঁড়ে খুঁড়ে নিভৃতি খুঁজেছি/ তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই। কি এক ঘোরলাগা অনুভূতি যেন কবিতার গভীরে টেনে নেয়। কবির রুদ্র আলোচনায় আসেন থাকেন এর আরও একটি কারণ সম্ভবত আলোচিত-সমালোচিত নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে প্রেম এবং জুটিবদ্ধ হওয়া এবং পরবর্তীতে ভাঙন।
পাওয়া-না পাওয়ার এই দ্বিধান্বিত অনুভূতি, ছোঁয়া আর না ছোঁয়ার এই বিপরীতমুখী প্রেমের গভীরতায় পাঠক সহজেই কবিতার প্রেমে পড়ে যায়। কবির ‘এ কেমন ভ্রান্তি’Ñ আমার কবিতায় লিখেছেন, এ কেমন ভ্রান্তি আমার/এলে মনে হয় দূরে সরে আছো, বহুদূরে/দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে আকাশ/এলে মনে হয় অন্যরকম জল হাওয়া, প্রকৃতি/অন্য ভূগোল, বিষুবরেখা সব অন্য অর্থবহ/তুমি এলে মনে হয় আকাশে জলের ঘ্রাণ। প্রেম-বিরহের বাইরেও কবির হৃদয় ভেবেছে একটি সুন্দর, বৈষম্যহীন পৃথিবীর কথা।
ভেবেছে মানুষের অধিকারের কথা। কথা ছিল সুবিনয় কবিতায় তাই কবি বলেছেন, কথা ছিল- রক্ত প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত/রাখালেরা পুনর্বার বাঁশিতে আঙুল রেখে রাখালিয়া বাজাকে বিশদ/কথা ছিল বৃক্ষের সমাজে কেউ কাঠের বিপণি খুলে বোসবে না/চিত্রর তরুণ হরিণেরা সহসাই হয়ে উঠবে না/রপ্তানিযোগ্য চামড়ার প্যাকেট/কথা ছিল শিশু হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পদের নাম। সত্যি তো এমনটাই সভ্য সমাজের মানুষের কাছে পাওনা ছিল। পৃথিবীজুড়ে এই হানাহানি, বৈষম্য, অস্থিরতা কবির হৃদয়কে বেদনার্ত করে। কবির কবিতায় পৃথিবীকে সত্যি মানুষের জন্য ভেদাভেদহীন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন। এই কবিতায়ই কবি লিখেছেন, আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বণ্টন।
কবির কবিতায় চারপাশের অসঙ্গতি, যুদ্ধ, শোষণ-নিপীড়ন, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, দলাদলি এসব উঠে আসবে এটাই স্বাভাবিক। পাঠক সেটাই প্রত্যাশা করে। যদি সেই প্রত্যাশা কবি পূরণ করতে পারেন তবে তিনিই সার্থক কবি। তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। কবিতার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সব সময়ই মানবতার প্রতি, মানুষের মুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল কবি ছিলেন। সমাজের নানা বিষয় তিনি তুলে এনেছেন। মানুষের প্রতি মানুষের এই ব্যবধান কবিকে কষ্ট দিত।
কবির ‘ইশতেহার’ কবিতায়, দুর্বল মানুষেরা হয়ে উঠল আমাদের সেবার সামগ্রী/ আমাদের কারও কারও তর্জনী জীবন ও মত্যুর নির্ধারণ হলো/ভারি জিনিস টানার জন্য আমরা যে চাকা তৈরি করেছিলাম/তাকে ব্যবহার করলাম আমাদের পায়ের পেশীর আরামের জন্য।- কবিতার কথায় কত সহজে অথচ আজকের সমাজের এই অসহায় মানুষের জীবনের চিত্র তুলে এনেছেন সহজভাবে।
জীবনবোধ ছিল অত্যন্ত গভীর। অনুভূতির তীব্রতা ছিল প্রখর। কবির চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় কবিতায় বলেছেন, চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়-বিচ্ছেদ নয়/চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন- করা আর্দ্র রজনী/চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থকে যাবে/আমার না থাকা জুড়ে/জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে। একাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে কবিতায় গুরুত্বপূর্ণদের মধ্যে অন্যতম একজন কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তার মতো করে এমন স্পষ্ট কণ্ঠে মানুষের অধিকারের জন্য, মানবতার জন্য, সভ্যতার বৈষম্য ধারার জন্য এমন প্রতিবাদ আর খুব বেশি নেই। সে কারণেই তিনি পাঠকের রুদ্র হতে পেরেছেন।
এস ডি সুব্রত