নারীকণ্ঠের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে রাতের শরীর
নারীকণ্ঠের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে রাতের শরীর। অন্ধকার ঘোরতর হচ্ছে, ভারী হয়ে নেমে আসছে রেখার চোখে। যদিও আকাশে পূর্ণ জোছনা, ঝোপঝাড়ে আছে জোনাকিদের সরব সমাবেশ। তবুও আজ অন্ধকারের ঘনঘটা চারদিকে। চারপাশে নিঝুম নিশুতি রাত। ডোবার ওপাশে এক সুরে ডাকছে হুতুম পেঁচা। পিচ ডালা ওই কালো রাস্তায় হচ্ছে আনন্দ মিছিল মানুষের।
গৃহকর্তী মায়মুনা বেগম চটপট করে আক্ষেপ স্বরে বিলাপ করে। তার বিলাপ শোনার কেউ নেই আজ, কেইবা শুনবে। পাড়াপড়শিরা কেউ আছে সুখের নিদ্রায়, কেউবা আনন্দ মিছিলে। বাইরের উল্লাস এখনও থামেনি। থামবেই বা কেন? এই যে স্বাধীনতার উল্লাস, মুক্তির আনন্দ। মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষা আজ পূর্ণতা পেলো। একটি কালো ছায়া, অতি কালো ছায়া যেন হঠাৎ সরে গেলো। অভিশপ্ত ঘন-কালো আত্মা, হিংস্র কালবৈশাখীর কালো মেঘ উড়ে গেছে। এখন পখর নীল আকাশ মানুষের মাথার উপর, অভিশপ্ত আর কোন ছায়া নেই। শুধু কালো হলো কালোছায়া পূজারিদের আকাশ। তাদের মাথায় নেমে এলো কালো মেঘ। সেই অভিশাপে জ্বলছে বাড়িঘর। সেই ছায়া পড়েছে রেখা আর তার অনাগত শিশুর উপরও। ধাত্রীরা মাথায় হাত দেয়, বৃদ্ধা মায়মুনাকে বলে,
-হবে না। আমাদের দ্বারা হবে না, খালা। অবস্থা ভালা না। হাসপাতালে নিতে পারলে হয়তো বাঁচবে।
বৃদ্ধা হুহু করে কাঁদে। ধাত্রীরাও চোখ মুচে নীরবে। রেখার মাথায় হাত রাখে বৃদ্ধা, -মারে আল্লাহরে ডাক।
রেখা আল্লারে ডাকে, চিৎকার করে। সেই স্বরে আকাশ কাঁপে, আর্তনাদ ছুটে আরশের দিকে। চোখে তার অশ্রুর স্রোতে ঢেউ উঠে, শরীর থেকে ধারা নামে রক্তের। সে রক্ত গড়ায় মাটিতে, ঢেউ খেলে। মৃতপ্রায় মায়ের কষ্ট দেখে হাউমাউ করে পাঁচ বছরের ছেলেটা। আব্বা আব্বা করে চিৎকার করে। কিন্তু কেউ নেই, কেউ আসে না। কালোছায়ার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে ছায়ার পূজারিরা। ধাত্রীরা চেষ্টার ত্রুটি করে না, কিন্তু কিছুতেই পারছে না তারা। এদিকে রক্ত ক্ষরণ বাড়ছেই। অসহায়ের মতো চটপট করছে সবাই। চোখের সামনে মরছে মেয়েটা।
এখনি হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু কে নিবে, কে আছে? সবই ছিল, সবাই ছিল, এখন নেই। আছে শুধু পোড়া গন্ধ, ছাই। ছাইয়ের স্তূপ থেকে এখনও কু-লী পাকিয়ে অসীম আকাশে ছুটছে সাদাকালো ধোঁয়ারা। সেই ধোঁয়ার দিকে চায় বৃদ্ধা, চিৎকার করে কাঁদে। বুকে আঘাত করে বলে,
-ও সুমন কই গেলি বাপ, তোর বউটা যে মরে যায়।
সে কান্না সে আর্তনাদ সুমনের কানে যায় না। সুমন শোনে না, ছুটেও আসে না। সুমন নেই। ছিল। বীর বিক্রমে ছিল সুমন। আশপাশে কত বন্ধু ছিল? বড় ভাই ছিল। আর্ত উজাড় করা ছোট ভাইয়ের দল ছিল। প্রিয় অভিভাবকরা ছিল। প্রিয় নেতা ছিল। এইতো আজ দুপুরেও ছিল। সব ছিল। কিন্তু এখন কেউ নেই, কিছু নেই। কালোছায়ার সাথে হারিয়ে গেছে সব, হারিয়ে গেছে সবাই। আছে শুধু এই পুড়ে যাওয়া বাড়ি, যা এখনও পুড়ছে। আর তার ভ্যাপসা পোড়া গন্ধ। চোখের পলকে সব শেষ, সাজানো বাড়ি পুড়ে ছাই। প্রতাপশালী সুমনও নেই। পালিয়েছে, প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে? ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছে।
প্রিয়জন থেকে পালিয়েছে। হাতের মোবাইলটাও নেয়ার সুযোগ হয়নি। রেখার আর্তনাদে রাত কাঁপে, আঁধারের শরীর নেচে উঠে, কোনো এক গাছের ডালে মাতম করছে ওই বৃদ্ধা পেঁচাটা। জোছনারা নিবে যেতে থাকে, চাঁদটাও কাঁতর হয় রেখার ব্যথায়। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছেই। আর সহ্য হয় না। বৃদ্ধা ধাত্রী কেঁদে উঠে, অপরজনকে বলে, -মেয়েটা মরছে মরিয়ম। আশপাশে কি কোনো মানুষ নাই। যা মরিয়ম যা, কাউরে ডাক। পৃথিবীতে মানুষতো কেউ আছে।
মরিয়ম ছুটে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে। অন্ধকারের জমাট শরীর ভেদ করে ছুটে। কোন্দিকে ছুটে জানে না। রাস্তার দিকে ছুটে। কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই। নির্জন সব। ঘুমন্ত পৃথিবীর নিথর শরীর, শুধু চাঁদটা জেগে আছে। আনন্দ মিছিল শেষে, ক্লান্ত মানুষ সুখনিদ্রায় ডুব। স্বাধীন দেশের ঘুমে মুক্তির স্বাদ, স্বপ্নময়। কাকে ডাকবে মরিয়ম? কে আসবে এত রাতে? পাড়াপড়শিরা কেউতো আসার নয়। বিরূপ সবাই। তবুও মরিয়ম ছুটে করিম মিয়ার বাড়ির দিকে। তার একটা রিক্সা আছে জানে মরিয়ম। যদিও করিম মিয়া আসার নয়, তবুও মরিয়ম দরজায় কড়া নাড়ে।
-কে?
-আমি। আমি কাকা, মরিয়ম। সুমনের বউটা পড়ে আছে, মরছে। রক্তে ভেসে গেছে সব। এখনই হাসপাতালে না নিলে বাঁচবে না। ঢুকরে কেঁদে উঠে মরিয়ম। সুমনতো নেই, কেউ নেই। কিছু একটা করেন কাকা।
বৃদ্ধ করিম মিয়া নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখে কথা আসে না। চোখ দুটোতে ঝাপসা দেখে, কাঁদতে পারলে হয়তো পরিষ্কার হতো। কিন্তু অশ্রু যে নেই, সব ঝরে গেছে। হৃদয়টা পুড়ে পুড়ে অকেজো প্রায়। ছেলের সোনা মুখ তিনি ভুলতে পারেন না। মানসúটে শুধু ভাসে আর ভাসে। স্মৃতি হয়ে গেছে তার ছেলেটা। জীবনের মতো স্মৃতি হয়ে গেছে শান্ত। অটোচালক করিম মিয়ার স্কুল পড়ুয়া চটপটে ছেলেটা। এইতো গত কালই মরেছে মিছিলে, মুক্তির মিছিলে। সুমনদের গুলিতে।
-কোন্ মুখে এলিরে মরিয়ম? চোখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে করিম মিয়ার বউ। আমার ছেলেটার কবর এখনও শুকায়নিরে। হুহু করে কেঁদে উঠে বৃদ্ধা।
-অনাগত শিশুটাতো কোনো দোষ করেনি চাচি। অন্তত তার জন্য হলেও
-বৃদ্ধা কিছু বলতে পারে না। মাটিতে বসে বিলাপ করে। বুকে আঘাত করে। অচেতন হয়ে যায়। করিম মিয়া ধরে উঠায় তারে। ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয় বিছানায়।
সুমন স্ত্রী রেখার রক্তে ভিজে যাচ্ছে পিচ ডালা পুরো পথ। করিম মিয়া প্রাণপণে টানে রিকশা। মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা মরে গেছে তাও বুঝা যায় না। হুঁশ নেই। বৃদ্ধা শাশুড়ি আর ধাত্রীরা গুনগুন করে কাঁদে। সেই কান্নার শব্দ রাতের আঁধার শরীরে হোঁচট খায়, বনে বনে প্রতিধ্বনি তোলে? ঝিঁঝি পোকারা চুপ করে শোনে সেই ধ্বনি। পাখিদেরও বুঝি ঘুম ভেঙে যায়, ডাকে না।
জোনাকি দলের মিটমিট করে চোখ, দুঃখে। চাঁদটা কিরণ দেয়, পথ দেখায়। গাঁয়ের সব জোর দিয়ে রিকশা টানে করিম মিয়া। কবরস্থানের পাশ দিয়ে যেতে বুকটা আরো ভারী হয় তার। ছেলেটা তার এখানেই শুয়ে আছে, মাটির নিচে। মাত্র তিন হাত মাটির নিচে। অনন্ত কালের মতো ঘুমিয়ে আছে, নিশ্চুপ। অথচ একদিন আগেও ছিল প্রাণবন্ত। তার মুখের মুক্তির স্লোগান এখনও যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আকাশে। ছেলের স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে ছুটাছুটি করে। চোখের ফোঁটা ফোঁটা জলে ভিজে যায় মলিন জামাটা? আহ্ নিষ্ঠুর মানুষ, নির্মম পৃথিবী?
হাসপাতালের বারান্দায় কাঁদে বৃদ্ধা মায়মুনা বেগম। রাত প্রায় শেষের পথে। এখনি কেটে যাবে অন্ধকার। মিম্বারের আজানের সাথে কেটে গেছে অন্ধকারও। নতুন প্রভাত দেখা দিয়েছে দিগন্তে। নতুন দিনের হলো আগমন। রাত কেটে গেছে। কিন্তু সবার কাটে না। কিছু রাত রাতই থেকে যায়। যেমন থেকে গেছে রেখারও। তারও রাত কাটেনি। ডাক্তার চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু ভাগ্যের লিখন, বদলাবে কে। খেলার ঘুঁটি যার হাতে সে ছাড়া বদলানোর আর সাধ্য কার? সবই তার ইশারায়, তার ইচ্ছে যেমন। কেউ আসে, কেউ যায়। যে মানুষ কাল ছিল, আজ নেই।
ক্ষমতার দর্পে যে রাজা পাখির মতো মারছিল মানুষ, সেও আজ নিঃস্ব, পলাতক। এই বিধাতার খেলা। এটাই পৃথিবীর এক মহান নিয়ম। এটাই মানুষের নিয়তি। সুমনের বউ রেখার নিয়তিও ছিল এমন, অতি রক্তক্ষরণে মরেছে সে। অন্ধকার ছায়া থেকে তারও হয়েছে মুক্তি। জীবনে সে ছায়ার পূজারি ছিল না। পতিভক্তি ছিল অগাধ, তারই দাম দিল মরে। কিন্তু মরার আগে সেও রেখে গেছে অস্তিত্ব, নতুন দিনের মতো, পুবের আকাশের ওই নব সূর্যের মতো ফুটফুটে এক শিশু। এখনও বেঁচে আছে। তবে শঙ্কা কাটেনি, লাইফ সাপোর্টে যুদ্ধ করছে পৃথিবীর জন্য। পৃথিবীর মায়া এক মোহজাল। পৃথিবী এক মায়াবিনীর মতো, তার অগাধ চলনা, পরতে পরতে মাদকতা। সেই চলনা সবাই বুঝে, কিন্তু এই মোহ কাটানো যায় না। যারা কাটে তারা মানব নয়, মহামানব।
মাঝরাত, রেখার কবরের পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি। পুরুষ মানুষের মূর্তি। চাদরে ডাকা অবয়ব, সেই মূর্তি নড়ে না। যেন জমে গেছে। হয়তো ভুলে গেছে নড়তে, হয়তো শোকে নয়তো অনুশোচনায়। মন খুলে কাঁদতেও পারে সেই অভিশপ্ত ছায়া। ঘুমন্ত পৃথিবীর নিথর শরীর। নিশুতি রাতের নির্জন কবরস্থানে সেই ছায়া কাঁদতে পারে না। কেউ যদি টের পায়, এই ভয়। যে মানুষের পদচারণে কাঁপতো চারদিক, জয়ধ্বনি উঠতো মুখে মুখে? সে মানুষ আজ স্ত্রী করবে আসতেও ভয় পায়, ঘুমন্ত পৃথিবীর নির্জন গোরস্তানেও। যে ছিল মানুষের নেতা, মানুষই আজ তার ভয়। যে ছায়াটি দাঁড়িয়ে আছে, কালো রাতের অন্ধকারে চাদর জড়িয়ে।
সে এক মহান প্রভাবশালী নেতা, গণমানুষের বন্ধুখ্যাত সুমন তালুকদার। গতকালও তার জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল। শত হাজার কর্মী ছিল, দাস ছিল, পূজারি ছিল। আজ কেউ নেই। যেসব মানুষরা তার ভয়ে তটস্থ থাকতো প্রতিদিন, ইচ্ছে অনিচ্ছায় জোর গলায় স্লোগান দিত। তারাই আগুন দিয়েছে কাল সুমনের অট্টালিকায়। লুটে নিয়েছে সোনা দানা টাকা কড়ি সব। বিছানা বালিশও ছাড়েনি। সেসবে জনতার রক্তের গন্ধ ছিল। জনরক্ত চুষে গড়েছিল সেই প্রাসাদ। জনতাই তাই লুটে নিয়েছে, আগুনে ভষ্ম করে দিয়েছে অট্টালিকা। ভষ্ম হয়ে গেছে সব প্রতাপ প্রতিপত্তি, পুড়ে গেছে অত্যাচারের আদেশ শালা, নিভে গেছে অসুর ক্ষমতার আস্ফালন। ক্ষমতার দম্ভ গুঁড়িয়ে গেছে, দাম্ভিকতার হয়েছে চূড়ান্ত পরিণতি। সেই পরিণতির এক ফল এই সদ্য কাঁচা কবর।
কবরের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে সুমন। তার পাষা- চোখ থেকেও নামে অশ্রু। এই প্রথম পরম ভক্তিতে ডাকে, রেখা। দশ বছরের দাম্পত্য জীবনে এই প্রথম মাথার কাছে রাখে মমতার হাত। বেঁচে থাকতে যে হাত রাখেনি কখনো রেখার কপালে। মৃত্যুর পর তিন হাত মাটির ওপরই সে হাত রাখে সুমন, উদ্বেলিত মমতায়।
ক্ষমতার দম্ভ, প্রতাপ প্রতিপত্তি মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে নিজের ভিতর থেকে। স্ত্রীর কবরে হাত রেখে সেসবই মনে হয় সুমনের। কত টাকা, কত ঐশ্বর্য, আর কত কুমারী নারী। কত ধর্ষণ, খুন, গুম, হত্যা। কত অন্যায় অবিচার। চোখ ছিঁড়ে বের হয় অশ্রু। অস্ফুট স্বরে আবার ডাকে সুমন,
-রেখা। আমাকে মাপ করে দিও।
দীর্ঘ সংসার জীবনে অব্যাহত অবহেলা ছাড়া কিছুই দিইনি সুমন। কখনো ভক্তিভরে ডাকেনি। দামি শাড়ি, দামি গহনা প্রশান্ত করেনি রেখাকে কখনো। অগাধ প্রতিক্ষায় শুধু স্বামীর একটু মমতাই চেয়েছে। পায়নি কখনো। আজ সুমন এসেছে। এইতো এসেছে। অন্যদিনের মতো কোনো পর নারীর বিছানা থেকে আসেনি আজ। মাতাল হয়েও আসিনি। পরমপতি হয়ে এসেছে। সুমন রেখাকে ডাকে,
-উঠো রেখা। ফিরে এসো।
রেখা আসার নয়। যে রেখা মুছে গেছে দিগন্ত থেকে, সে রেখা আর স্ফুটিত হবে না। নিশ্চুপ কবরে জীবনের মতো সে আছে পরম নিদ্রায়। হাজার সুমনও সে নিদ্রা ভাঙাতে পারে না। পৃথিবীর মোহ যার কেটে গেছে, তাকে ফেরায় সাধ্য কার।
আকাশে শুকতারা জ্বলছে। নিজ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় সুমন। বাড়ি নয়, পুড়ে যাওয়া এক ধ্বংসস্তূপ। তার শখের অট্টালিকা। কোটি কোটি টাকার প্রাসাদ। আজ কালচে ইটের দেয়াল ছাড়া কিছু নয়, যে বাড়ির গেটে গেটে থাকতো কড়া নিরাপত্তা, আর অতন্দ্র প্রহরীর দল। সেখানে আজ গেটও নেই, না আছে দরজা। মানুষের জমিয়ে রাখা ক্ষোভ এতটা ভয়ংকর হতে পারে, কখনো ভাবেনি সুমন। একটা ঘরে মোমবাতি জ্বলছে, ছাইয়ের স্তূপ মাড়িয়ে সেই দিকেই হাঁটলো সুমন।
পুড়ে যাওয়া ঘরের এককোনে মাদুর বিছিয়ে মেঝেতেই শুয়ে আছে সুমনের মা মায়মুনা বেগম। পাশে সুমনের পাঁচ বছরের ছেলে শাওন। আত্মীয়স্বজনরা চেষ্টা করেছে বৃদ্ধাকে নিতে। বৃদ্ধা যায়নি, এটা তার স্বামীর ভিটা। দুদিন আগেও যে ভিটা প্রাণবন্ত ছিল, রাজকীয় জৌলুস ছিল, সে ভিটায় শকুন চরতে ছেড়ে দেয়া যায় না। রেখার মা বাবা চেয়েছিল শাওনকে নিয়ে যেতে, মায়মুনা বেগম দেয়নি। শাওনই এখন ভরসা, বেঁচে থাকার আশা তার।
মায়ের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় সুমন। ডাকে
-মা মা
-বৃদ্ধা জেগে উঠে, আঁৎকে ওঠে।
কান্নার ঢেউ ভাঙে তার। বিলাপের মৃদু স্বরে দেয় সব বর্ণনা। তার নিশ্বাস আঁটকে আসে বারংবার, তবুও বৃদ্ধা থামে না। বলে যায়, এভাবেই-
মিছিল। এক অন্য রকম মিছিল ছিল কাল। এ মিছিল ছিল উল্লাসের, এই মিছিল ছিল আনন্দের, এই মিছিল ছিল মুক্তি আর স্বাধীনতার। এ যেন সেসব মানুষের মিছিল, যারা রাজপথে মরেছে গুলি খেয়ে। মনে হলো শান্তও ছিল ওদের মাঝে। মানুষের মুখ ফুটলো কতকাল পর। সব দরজা খুলে গেল। সব মানুষ বেরিয়ে এলো, যেন শিকল ভেঙে এলো। ছুটে এলো রাজপথে। দলে দলে। স্লোগান দিল, গণমানুষের স্লোগানে প্রাসাদ কাঁপলো। গেটের প্রহরীরা পালালো, যে যেদিকে পারলো পালালো। তালা দিলাম গেটে। কিন্তু মানুষ প্রাচীর ভাঙলো।
ভাঙবেইতো এই মহলতো অত্যাচারের আদেশ শালা। বাধা দিলাম। বললাম, ছেলে বাড়ি নেই চলে যাও। তারা যায়নি। লুট করেছে, ঠিক লুট নয়। হয়তো অধিকার বুঝে নিয়েছে। যা কিছু ছিল সবই মানুষের রক্ত চোষা, তাই তারা নিয়েছে। এমনটাই বলতে শুনেছি মানুষকে। টাকা পয়সা, গহনা, খাটপালং, জামা-কাপড়, এমনকি হাঁড়ি পাতিলও ছেড়ে যায়নি। চোখের সামনেই হয়েছে সব। তারপর দাউদাউ আগুনে জ্বললো প্রাসাদ। এমনটাইতো হওয়ার কথা ছিল, তাই না?
বৃদ্ধা থামে। নিশ্বাস আঁটকে আসে তার। সুমন বোবার মতো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। মায়ের প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারে না। বৃদ্ধা আবার বলে,
রেখার ব্যাথা উঠে মাঝরাতে। গোয়ালঘরটা পুড়েনি। সেখানেই রাখি, ধাত্রীরা আসে। কিন্তু তাদের সাধ্যে ছিল না, প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। শেষ রাতে করিম মিয়া, যারা ছেলেকে গুলি করে মেরেছ, সেই নিয়ে যায় হসপিটালে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। খুব দেরি। বাচ্চাটা বেঁচে আছে, তোমার শশুররা সেখানে।
মায়মুনা বেগম থামে। আকাশের দিকে চায়। আকাশ ফর্সা হচ্ছে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
-আঁধার কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কালো আত্মাদের পালানোর সময় হয়ে গেছে। পালিয়ে যা, অনেক নিষেধ করেছিলাম। কিছুই শোনোনি। অপক্ষমতার দম্ভে উন্মাদ হয়ে গেয়েছিলে। এখন কোথায় সেই ক্ষমতা। কোথায় সেই প্রিয় অভিভাবকের দল। প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। আর তোমাদের ডুবিয়ে দিয়েছে জলে। জাহান্নামের জলে। মানুষের অভিশাপ নিয়ে এখন ছুটার পালা। মানুষ থেকে পালাবে। যেমন বনের জানোয়ার পালায়।
-সুমন আর থাকতে পারে না। মায়ের পায়ের কাছে এসে কাঁদে। বৃদ্ধা চোখে জলের ঢেউ উঠে। কান্নারও ভাঙে বাঁধ, জড়িয়ে ধরে ছেলেকে। বলে,
-যা, পালিয়ে যা। সকাল হয়ে যাচ্ছে। ছেলে দুটো আমি দেখব। আমার নামে যে জমি আছে, তাতেই চলে যাবে দিন। তোমার ব্যাংকের শত কোটি টাকা, হিরা জহরত পরে তুমি ভোগ করো, যদি কোনদিন আবার ত্রাসের রাজত্ব ফিরে পাও। যদি বর্ডার পেরিয়ে বেঁচে থাকতে পারো।
হুম। সকল আঁধার কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আঁধার পূজারিদের সময় নেই একেবারেই। এখনই ছুটতে হবে। দিনের আলোয় দেশের মাটি আর হিংস্রদের সহ্য করবে না। তাই ছেলের কপালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় সুমন। ফেরারি আসামির মতো উঠে দাঁড়ায় হেলে পড়া মস্তকে। এক দুই কদম করে সরে যায় সেই আসামি। অন্ধকারে মিশে গেলে গলা ছেড়ে বিলাপ করে বৃদ্ধা। জোয়ান ছেলে মারা গেলে যেমন কাঁদে জননী, ঠিক তেমনই। সেই আর্তনাদে সুবহে সাদিকের আকাশ কেঁপে উঠে, পা জড়িয়ে আসে সুমনের। তবুও ছুটতে হবে, ছুটে সুমন।
ফেরারি আসামির মতো ছুটে। কাঁটাতারের দেয়াল যে পেরুতেই হবে। ওটাই যে একমাত্র ভরসা, নিরাপদ আশ্রয়। আসলেই কি আশ্রয় দেবে তারা, খুলে দিবে তারকাঁটার গেট? ভাবে সুমন। যদি না দেয়। দিবে না কেন, কি না দিয়েছি তাদের। উজাড় করে দিয়েছি সর্বস্ব, অন্যায় আনাগোনা, মাদক ব্যবসা, অস্ত্রের বাণিজ্য। কি না দিয়েছে, প্রতিদানে যদি গেট না খুলে দেয় কাঁটাতারের। দিবে, খুলে দিবে তারা। তাদের খুলতেই হবে গেট।
রাত নেমে আসে। জোনাকিরা জ্বলে উঠে কাঁটাতারের ধারে ধারে। সুমন আবার চেষ্টা করে কাঁটাতার পেরোনোর। কিন্তু পারে না, দ্বাররক্ষী লোভাতুর। সুমন স্মরণ করিয়ে দিতে চায়, পূর্বের দেয়া সব বর। রক্ষীরা বিদ্রুপ হাসে। একসময় বাধে গোলযোগ। তারপর, তারপর একটি শব্দ হয় সুমনের বুকের কাছে, খুব কাছেই, একেবারে বুকের ভিতর। বুকের গভীর গহীনে, মেরুদ- বরাবর। সেই শব্দ প্রতিধ্বনি হতে হতে সীমান্তেই মিশে যায়। মানুষের কানে পৌঁছে না।
পৃথিবীর মানুষরাও জানে না সে খবর, এভাবেই সীমান্তের অজ্ঞাত মাটির নিচে চাপা পড়ে মানুষ নিত্যদিন। সুমনতো ছিল তাদেরই পূজারি। তবুও, হুম তবুও চাপা পড়ে সুমনরাও। এভাবেই ডুবে যায় কালোদের সূর্য, বিলীন হয়ে যায় তাদের ইতিহাস। সুমনের খবর এভাবেই চিরকালের তরে চাপা পড়ে সীমান্তে।