বাংলা সাহিত্যে সর্পবিষয়ক নানা ধরনের লেখা
বাংলা সাহিত্যে সর্পবিষয়ক নানা ধরনের লেখা দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য এবং ‘লোকসাহিত্য’ বলে কথিত সাহিত্যধারার একটি উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে রয়েছে সাপনির্ভর আখ্যান বা উপকথা-রূপকথা। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্য বলে বিবেচিত উপন্যাস বা ছোটগল্পেও সাপ প্রসঙ্গ আছে, কখনো চরিত্র বা প্রতিকরূপে, কখনো আখ্যানের শাখা-প্রশাখায়, কখনো আবার প্রতিবেশ-পরিবেশের উপাদানরূপে। তবে একটি বিশেষ সাপ চন্দ্রবোড়া নিয়ে খুব বেশি কথাসাহিত্য খোঁজে পাওয়া যাবে না এবং বিস্তারিত অনুসন্ধানে রীতিমতো গবেষণার প্রয়োজন হবে বলেই বিশ্বাস। আমরা এক্ষেত্রে অন্তত তিনটি কথাসাহিত্য থেকে পাঠ নিতে পারি, যেখানে চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি রয়েছে।
প্রথমেই আমরা বিবেচনায় নিতে পারি প্রখ্যাত কথাকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত হাঁসুলী বাঁকের উপকথা। রাঢ় অঞ্চলের যে অংশে পাহাড়িয়া কোপাই নদী মেয়েদের অলংকার হাঁসুলীর মতো বাঁক নিয়েছে, সেই অংশে বাঁশবনে ঘেরা আড়াইশো বিঘা জমি নিয়ে পালকিবাহক কাহার জনগোষ্ঠীর বাস, নাম বাঁশবাঁদি। এই জনগোষ্ঠীর জীবনাচার, উপকথা, বিশ^াস-পুরাণ, বঞ্চনা-অবহেলা নিয়ে রচিত উপন্যাসটি। শুরুতেই একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা দিয়ে আখ্যানটি শুরু।
ঔপন্যাসিকের ভাষায়, ‘রাত্রে কে যেন শিস দিচ্ছে। দিনকয়েক শিস উঠেছিল জাঙাল এবং বাঁশবাঁদির ঠিক মাঝখানে ওই হাঁসুলী বাঁকের পশ্চিম দিকের প্রথম বাঁকিতে- বেলগাছ এবং শ্যাওড়া ঝোপে ভর্তি, জনসাধারণের কাছে মহাÑআশঙ্কার স্থান ব্রহ্মদৈত্যতলা থেকে। তারপর কয়েকদিন উঠেছে জাঙালের পূর্ব গায়ে কোপাইয়ের তীরের কুলকাঁটার জঙ্গল থেকে। তারপর কয়েকদিন শিস উঠেছিল আরও খানিকটা দূরে- ওই হাঁসুলী বাঁকের দিকে সরে। এখন শিস উঠেছে বাঁশবাঁদির বাঁশবনের মধ্যে কোনোখান থেকে।’
বাঁশবাঁদির কাছাকাছি জাঙাল গ্রামে বসবাস করা ভদ্র বাবুরা বন্দুকে আওয়াজ করে, পুলিশ ডেকেও শব্দের উৎসের কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। কাহাররা শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে ব্রহ্মতলার ‘কর্তা’ কোনো কারণে রুষ্ট হয়েছেন বলেই তিনি এ কা- ঘটাচ্ছেন। কাহারদের বয়োজ্যেষ্ঠা বৃদ্ধা- কালা বুড়ি সুচাঁদ কাহারনী এর প্রতিকারে ‘কর্তা’কে সন্তুষ্ট করতে সুস্থ-সবল পাঁঠা বলি দিয়ে ‘পিতিবিধেন’ করতে হবে বলে প্রস্তাব করেন। কাহারদের মাতব্বর বনওয়ারীসহ সকলে তাতে সম্মতি প্রদান করেন। চন্দপুরের রেলের কারখানায় কাজ করা, কথা-বার্তায়, চাল-চলনে কাহারদের থেকে আলাদা এ-গাঁয়েরই ছেলে করালীর মনে অন্য ভাবনা। সে বিশ^াস করে না যে, এ কোনো অলৌকিক ঘটনা। সে নিজের কামাইয়ে নিজে চলে, গায়ের কাউকে মানে-গণে না, কাউকে গ্রাহ্যও করে না।
গাঁয়ের সবাই যখন পাঁঠাবলি আয়োজনের টাকা-পয়সা জোগাড়ে ব্যস্ত, তখনই একদিন সবার অগোচরে বাঁশবনের একাংশে আগুন লাগিয়ে দেয় করালী। গ্রামের সবাই উদ্বেগ নিয়ে ছুটে আসে বাঁশবনে। মাতব্বর বনওয়ারী রেগে যান এবং তার সঙ্গে একচোট ধস্তাধস্তিও হয়ে যায় করালীর। অবশেষে ‘বাঁশের ঝাড়ের মাথা থেকে আগুনের উত্তাপে ধোঁয়ায় ক্লিষ্ট অবসন্ন হয়ে এলিয়ে নিচে পড়ছে একটা প্রচণ্ড সাপ। পাহাড়ে চিতির মতো মোটা, তেমনই বিচিত্র তার বর্ণ, কিন্তু লম্বা খুব বেশি নয়। পাহাড়ে চিতির সঙ্গে ওইখানে সেটার পার্থক্য।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে বনওয়ারী বললে- পে-ক-- চন্দ্রবোড়া! হ্যাঁ, ওদের গর্জন খুব বটে।’
করালী বলে উঠে, ‘এটা কত বড় দেখছ না? তাতেই শিসের শব্দ হয়। শালা!’
এ ঘটনার পর করালী রীতিমত হিরো বনে যায় কাহারদের মধ্যে। সে সাপটিকে কয়েকজন মিলে বাঁশে চ্যাংদোলা করে বেঁধে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। ভদ্র সমাজ থেকে মেজ ঘোষ সেটি দেখতে এসে করালীর বীরত্বতে খাটো করতে গিয়ে বলেন, ‘নাঃ, খুব বড় না। এর চেয়ে অনেক বড় পাহাড়ে চিতি চিড়িয়াখানাতেই আছে। আসামের জঙ্গলে তো কথাই নাই। সেখানে এত বড় সাপ আছে যে, বাঘের সঙ্গে লড়াই হলে বাঘ মেরে ফেলে। রেললাইনের উপর যদি কোনো ট্রেন যাবার সময় পড়ে তো ট্রেন আটকে যায়।’
করালী আঘাতটি বুঝতে পেরে উদ্ধতভাবে এগিয়ে আসে সাপটি তুলে নিতে। সে সায়েব-বাবুদের দেখাতে সেটি চন্ননপুর রেল স্টেশনে নিয়ে যাবে। কারণ, এর কদর তারাই বুঝবে। ঠিক তখনই এক ভদ্রলোকের ছেলে বলে উঠে, ‘কিন্তু এ তো পাহাড়ে চিতি নয়- এ হলো চন্দ্রবোড়া। চন্দ্রবোড়া এত বড় কিন্তু কেউ কখনও দেখেনি। আর সাপও ভীষণ সাপ।’
এভাবেই বিশাল আকৃতি ও আয়োজনের হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় চন্দ্রবোড়া সাপের এই আখ্যানের মধ্যদিয়ে কাহারদের বিশ^াস আর উপকথার বিপরীতে কাহারদেরই সন্তান তরুণ করালীর সংস্কারমুক্ত জীবনের জয়গান গাওয়া হয়েছে।
জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের আধা ফ্যান্টাসি-আধা সায়েন্স ফিকশনধর্মী উপন্যাস নি। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় এটি। এই উপন্যাসেও আছে চন্দ্রবোড়া সাপের কথা। গল্পের নায়ক মবিনুর রহমান খানিকটা তার হিমু বা মিসির আলীদের মতো চরিত্রেরই অধিকারী। তিনি বি, এস, সি (সম্মান) এবং এম, এস, সি’তে প্রথম শ্রেণি পেয়েও কিছুটা খ্যাপাটে স্বভাবের জন্য ভাইভা বোর্ডকে সন্তুষ্ট করে ভালো চাকরি জুটাতে পারেননি। অবশেষে নীলগঞ্জ মডেল হাইস্কুলে সায়েন্সের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি সিরিয়াস ধরনের মানুষ, বয়স ছত্রিশ বা সাঁইত্রিশ, দেখতে রোগা-লম্বা।
নিয়মিত ক্লাস নেন, রূপা নামের এক ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ান আর বাকিটা সময় নিজের দুরবিন দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্র দেখে সময় কাটান। তিনি স্কুল থেকে প্রায় দু’মাইল দূরে দুকামরার একটি পাকা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকেন, একাই যা কিছু একটা রান্নাবারা করে খান। জরাজীর্ণ ঘর, যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। বাড়িটি সাপের আড্ডাখানা। বর্ষাকালে যেখানে-সেখানে সাপ দেখা যায়। স্কুলের দপ্তরি কালিপদ বাড়ির মালিক। সাপের ভয়েই সে তার বাড়িতে বাস না করে আলাভোলা মানুষটিকে ভাড়া দিয়েছে। কালিপদের প্রথম পক্ষের স্ত্রী আর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর প্রথম সন্তান সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল।
মবিনুর রহমান অদ্ভুত ধরনের মানুষ; অদ্ভুত ক্ষমতারও অধিকারী কিন্তু তিনি তা বুঝেন না। তিনি আধোঘুম-আধো জাগরণে স্বপ্নের মধ্যে কিছু অদ্ভুত অবয়বের মানুষের মুখ দেখতে পান, যারা তাকে তার ক্ষমতাকে পূর্ণ ব্যবহার করতে বলেন। জেগে উঠে তিনি সেসব আর মনে করতে পারেন না। বর্ষাকালে বাড়িটির কাছের নদী পানিতে ভরে ওঠে। তিনি একটি ছইঅলা নৌকা কিনেছেন। প্রায়ই তিনি নৌকাতে রাত কাটান। ছাদে উঠে দুরবিনে তারকারাজি দেখেন।
একদিন রূপা তার মেজো ভাইয়ের বন্ধু তানভিরকে নিয়ে টিচারের ডেরায় আসে। তানভির সাপ আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই মবিনুর রহমান সহজ গলায় বলেন, ‘সাপ আছে ঠিকই। দুটো চন্দ্রবোড়া সাপ। পাশের ঘরে থাকে।’ তানভির প্রশ্ন করে যে তিনি সাপ দেখেছেন কিনা আর চন্দ্রবোড়াই যে বুঝলেন কীভাবে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘অনুমানে বলছি। সব সাপ ডিম দেয়। এই সাপটা সরাসরি বাচ্চা দিয়েছে। শুধুমাত্র চন্দ্রবোড়াই সরাসরি বাচ্চা দেয়। একত্রিশটা বাচ্চা দিয়েছে।’
‘আপনি বসে বসে গুনেছেন?’ তানভিরের এ কথার উত্তরে বলেন, ‘জি¦ না। একদিন বারান্দায় বসে ছিলাম। দেখলাম, সাপটা বাচ্চাগুলি নিয়ে বের হচ্ছে। তখন গুনলাম।’
তানভির বিস্ময় নিয়ে আবার প্রশ্ন করে, একত্রিশটা সাপের বাচ্চা এবং দুটা সাপ নিয়ে বাস করতে আপনার ভয় লাগে না?
মবিন সাহেবের উত্তর: একটু লাগে। রাতে আমি ঘরে থাকি না। নৌকায় ঘুমাই। তবে আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। আমরা সহাবস্থান নীতি গ্রহণ করেছি। আমি ওদের কিছু বলি না। ওরাও আমাকে কিছু বলে না। ওরা আমার গায়ের গন্ধ চেনে। আমিও ওদের গায়ের গন্ধ চিনি। আগেভাগেই সাবধান হয়ে যাই।
এহেন সহজ-সরল মানুষটিও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তার বিরুদ্ধে স্কুলের জন্য বরাদ্দকৃত গম আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ওসি তাকে হাতকড়া পরিয়ে তার ডেরায় নিয়ে যান, বলেন, ‘আপনার ঘরও সার্চ হবে। সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। পাশের ঘরে কি আছে?’
তিনি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেন, ‘দুটা চন্দ্রবোড়া সাপ আছে আর তাদের একত্রিশটা ছানা আছে। সাবধানে যাবেন।’
ওসি অবিশ^াস আর বিস্ময় নিয়ে বলেন, কি বললেন? চন্দ্রবোড়া সাপ?
‘জি¦’ স্বাভাবিক উত্তর শিক্ষকের।
‘ভেরি গুড। আমার কিছু চন্দ্রবোড়া সাপই দরকার।’Ñখানিকটা তাচ্ছিল্য করেন ওসি।
মবিন সাহেবের কথাকে অবজ্ঞা করে ওসি সাহেব নিজেই পাশের ঘরের দরজা খুলেন এবং তৎক্ষণাৎ ছিটকে বের হয়ে আসেন। দুটি চন্দ্রবোড়ার একটি দেখতে পেয়েছেন তিনি।
চন্দ্রবোড়ার সঙ্গে পাশাপাশি ঘরে থেকেও দংশনের শিকার হননি মবিনুর রহমান, অথচ এই ভালো মানুষটি তারই পরিচিত ও বিশ^স্ত মানুষের ষড়যন্ত্রের শিকার ঠিকই হয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের নি উপন্যাসের আখ্যানে এভাবেই উঠে এসেছে চন্দ্রবোড়া সাপের প্রসঙ্গ।
নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ক্লাসিক্যাল লেখা কথানাট্য চাকা। তিনি ঔপনিবেশিক শিল্পতত্ত্ব ‘শিল্পের বিভাজন’কে অস্বীকার করে বাঙালির নিজস্ব শিল্পাঙ্গিকে শিল্প রচনা করেছেন। ফলে, তার লেখা একই সঙ্গে নাটক, উপন্যাস, কাব্য, সঙ্গীত, আখ্যান বা রাগ-রাগিণীর সমাহার। চাকা’কে তিনি কথানাট্য হিসেবে অভিহিত করেছেন। এতে কথাসাহিত্যের শিল্প ও রস পূর্ণই বিদ্যমান। চাকাকে এইক্ষেত্রে আমরা কথাসাহিত্য হিসেবেই বিবেচনা করেছি। এর প্রেক্ষাপট ও আবহে রয়েছে বাংলাদেশের সামরিক শাসন।
রাজপথে অপঘাতে কিংবা বলা যায় সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে শাসকের হাতে মৃত্যুবরণকারী একজনের লাশের গন্তব্যে পৌঁছানোর মানবিক কাহিনির সমান্তরালে মূর্ত হয়ে উঠেছে সামরিক শাসনের কবলে পড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা। সামরিক শাসনের নৃশংসতা আর ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলতে তিনি চন্দ্রবোড়া সাপের প্রতিকী ব্যবহার করেছেন।
চাকা’র কাহিনিতে দেখা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের কাগেশ্বরী নদীর পাড়ের এলংজানি নামের একটি গঞ্জের হাসপাতালে ঢাকা বা বড় শহর থেকে অপঘাতে মৃত এক যুবকের লাশ এসেছে। বৈশাখের কোনো এক উজ্জ্বল সকালে দূরে মাঠে ধান কাটতে যাবে এমন একটি গরুর গাড়িতে মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেবার শর্তে উঠানো হয় লাশটি। কিন্তু যে ঠিকানায় লাশটি পাঠানো হয়, তার সঙ্গে কোনো কোনো গাঁয়ের নাম খানিকটা মিললেও, এমনকি মৃত যুবকের নামের সঙ্গে একজনের নাম মিলে গেলেও প্রকৃত ঠিকানার অভাবে কোনো গাঁয়ের কেউই লাশটির দায়দায়িত্ব নিতে চায় না।
নয়ানপুর গ্রামটাতে গাড়োয়ান ও তার সঙ্গীরা উপস্থিত হওয়ায় সে গ্রামের এক স্কুলমাস্টার লাশটিকে নবীনপুরের কেউ বলে মত দেয়। কিন্তু নবীনপুরের নিয়ে দেখা গেল বাহিত লাশটি সে গাঁয়েরও কারও নয়। রাত কেটে ভোর হয়। বহনকারী গাড়ির ষাঁড়দ্বয়ের সঙ্গে স্থানীয় ষাঁড়ের লড়াই বেঁধে যায়। গাড়োয়ানের জিতে যাওয়া ষাঁড়দ্বয়কে নবীনপুরের লোকেরা অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে আহত করে। একটি অপরিচিত বাজারে এসে ভাত রেঁধে খায় অভুক্ত গাড়োয়ান ও তার দুই সঙ্গী যুবক শুকুরচান আর জনৈক প্রৌঢ়। লাশটি তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে এক সময় তাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে। অবশেষে তারা নিজেরাই নামহীন ঠিকানাহীন এই মৃতকে দাফন করে এক শীর্ণ নদীর বালুচরে। অব্যক্ত বেদনায় অশ্রুপাত করে গাড়োয়ান। যুবকটির মৃতদেহ সমাহিত হলে তারা তিনজন ধান কাটতে চলে যায় তাদের গন্তব্য ছিল সোহাগীর বিলের পথে।
সামরিক শাসনের স্বরূপের সঙ্গে সেলিম আল দীন চন্দ্রবোড়া সাপের তুলনা করেছেন চাকায়। উত্তর বঙ্গের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে পাকা বা আধপাকা জলিধান। কৃষক ধান কাটছে; তাদের কণ্ঠে উদাস করা ভাওয়াইয়া গীত। গরুর গাড়ি চাকায় ঘ্যাঁচর ঘ্যাঁচর আওয়াজ তুলে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কাটা ধানের আঁটির বোঝা; গাড়োয়ানের মুখে চিলমারি বন্দরের গান। কৃষক-গাড়োয়ান সবার চোখে-মুখে সমৃদ্ধ আগামির স্বপ্নÑ নতুন ধানে আরাম-আয়েশে কেটে যাবে তাদের একটি বছর।
কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন বারবার ভেঙে খানখান হয় সামরিক অপশাসনে। গাড়োয়ানের গাড়িতে উঠে না ধান; সওয়ার হয় অনামি সরকারি লাশ। ঘরে ঘরে নিরন্ন কৃষকের হাহাকার। সামরিক শাসনের পরিকল্পিত অপশাসনের কুফল নিস্তরঙ্গ-নিষ্কলুষ কৃষকের হাঁড়িতেও আঘাত হানে। চাকায় তার প্রতিকায়িত বর্ণনা:
‘গাড়িতে গতির সঙ্গে পথে পথে চন্দ্রবোড়া সাপের কুঞ্চণ দেখতে পায়* চন্দ্রবোড়ার শীতল ও পরিকল্পিত নৃশংসতার কথা চাল চরিত্র উত্তরবঙ্গের কৃষকরা ভালো জানে ॥
তবে করে কি সে সাপ ॥
বলি শোন
চন্দ্রবোড়ার চরিত্র এই যে সে কেউটে প্রভৃতির মতো শিকার ছোবল প্রদান মাত্র কামড়ে ধরে না* প্রাণী দেহে প্রথমে সে তার ফ্যাং ঢুকিয়ে দেয় বিদ্যুৎ বেগে* প্রবল ঝাঁকিতে থলের ঈষৎ হরিদ্রাভ বিষ ঢুকে যায়* শিকার ছোবল খাওয়ামাত্র মুক্ত ভেবে যাক বাঁচা গেল ভেবে দৌড়ে পালায়* শিকার যদি ইঁদুর হয়, তবে বহুদূর পর্যন্ত চলে যায়* কিন্তু ক্রমে চন্দ্রহীন কি চন্দ্রালোকিত রাতে তার শরীরের রক্ত¯্রােত জমাট ও কালো হয়ে আসে* ক্রমে ঢলে পড়ে ॥ চন্দ্রবোড়া শ্লথ গতিতে প্রায় ত্রিকোণ মস্তকে তাপ আঘ্রাণ করতে করতে শিকারকে পায় গিলে খায় ॥
গাড়োয়ান বুঝতে পারে পথের শুরুতে যে দংশন করেছে গন্তব্যে পৌঁছালে সেই তাকে গিলবে॥’
সেলিম আল দীন চাকায় মানবিক কাহিনির সমান্তরালে দু’দুবার সামরিক অপশাসনে পড়া বাঙালির প্রকৃত অবস্থা প্রকাশের পাশাপাশি বরেন্দ্র্রাঞ্চলের কৃষিসম্ভূত সমাজ, নি¤œবর্গ ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠী আর প্রাকৃতিক প্রতিবেশ-পরিবেশের চিত্র তুলে ধরেছেন। আর চন্দ্রবোড়া সাপকে প্রতিকায়িত করেছেন বাংলাদেশের সামরিক শাসকের পরিকল্পিত অমানবিক আর নৃশংস ঠান্ডামাথার কর্মকা-ের সঙ্গে।
চন্দ্রবোড়া সাপ দীর্ঘদিন ধরেই বরেন্দ্র-রাঢ় অঞ্চলে বাস করছে। এ সাপ অন্যান্য সাপের মতো ডিম দেয় না, সরাসরি বাচ্চা দেয় এবং একসঙ্গে অনেক বাচ্চা প্রসব করে। প্রচ- জোরে গর্জন করে শিস দেয়া এ সর্পের একটি প্রধানতম দিক। সাপটি অজগরের মতো দেখতে হলেও তেমন বড় হয় না, মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে। এরা পরিকল্পিত ভাবে শিকার করে এবং খুবই শীতল কৌশলে।
ইঁদুর বা অন্যান্য শিকারকে বাগে পেয়েই খেয়ে ফেলে না বা সম্পূর্ণ বিষ প্রয়োগ করে না। ছোবলে সামান্য বিষ দিয়ে কাবু করে অপেক্ষা করতে থাকে। শিকার কিছুক্ষণ পর কিছুটা সুস্থ ও শংকামুক্ত মনে করে তার গর্তে ঢুকে গেলে চন্দ্রবোড়া তার পিছু নিয়ে গর্তে ঢুকে শিকারের পরিবারসহ খেয়ে ফেলে। বরেন্দ্রাঞ্চলের কৃষি-ক্ষেত্রে এ সাপটির উপস্থিতি কৃষকের মনে ভয়ের সঞ্চার করে।
উত্তরাঞ্চলের কৃষক এ সাপটি চিনে; এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে বলে মাঠে কাজ করতে গেলে সতর্ক থাকে। সাপটি প্রচ- ভয়ানক হলেও পরিবেশে সহাবস্থান করে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপাখ্যান’, ‘নি’ ও ‘চাকা’Ñএই তিনটি কথাসাহিত্য পাঠ বিবেচনায় নিলে চন্দ্রবোড়া তথা রাসেলস ভাইপার সাপ সম্পর্কে এ বিষয়গুলোই সাধারণ হয়ে ধরা দেয়।