ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

প্রেম-দ্রোহে একাকার

প্রত্যয় জসীম

প্রকাশিত: ০১:১১, ১ নভেম্বর ২০২৪

প্রেম-দ্রোহে একাকার

ঘুমকন্যা ও ফিনিক্স হৃদয়

মাশুক শাহী নব্বই দশকের এক উজ্জ্বল কবি। মাশুকের প্রথম কবিতার বই ছিলো ‘খামবন্দী বায়োডাটা’ (২০০২)। দীর্ঘ ২২ বছর পর ঘুম ভেঙে জাগলেন এ কবি। এবারের বই ‘ঘুমকন্যা ও ফিনিক্স হৃদয়’। চার কর্মার এ কাব্যগ্রন্থে বায়ান্নটি কবিতা স্থান পেয়েছে। সব কবিতা আমি নিবিষ্ট মনে পাঠ করেছি। বারবার পাঠ করেছি। বিস্মিত হয়েছি। ভালো লেগেছে। মাশুকের হৃদয়ে ঘুমকন্যা নির্ঘুম থাকে। নারীর প্রেম ও বিরহ আবার দেশপ্রেমে আকুল ব্যাকুল।

সাম্যবাদে অঙ্গীকৃত রাজনৈতিক জীবনচেতনা, চিরায়ত বাংলার লোক ঐতিহ্যগন্ধী, অন্যায়, অসাম্য, শোষণ, নির্যাতন, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উচ্চকিত অথচ নান্দনিকতা ও শিল্পরূপে তুমুল নিমজ্জিত। এসবই মাশুক শাহীর কবিতার মৌল প্রত্যয়কে ধারণ করে। আমি তাকে বলি আমাদের সময়ের একলব্য। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন স্বদেশে যে নৈরাজ্য আশা ভঙ্গের তুমুল বেদনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশের সর্বগ্রাসী আয়োজন কবিকে বিচলিত করে, আর তাই তিনি লিখেন একজন মুক্তিযোদ্ধার সরল বয়ান-
‘ইতিহাস বলে
আমরা গেরিলা
আমরা গণযোদ্ধা
আমরাই মুক্তিযোদ্ধা
প্রকৃত যোদ্ধা ও জ্ঞানীর
সনদ লাগে না’।
ইতিহাসের আকাশে আমরাই ধ্রুবতারা’...
(ঘুমকন্যা ও  ফিনিক্স হৃদয় পৃষ্ঠা-৩০)

সনদের বাণিজ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও মহিমাকে ম্লান করে দিয়েছে। ক্ষমতার দাপটে প্রশাসনের শীর্ষ আমলাও মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাগিয়ে নেয়। পরে খবরের কাগজে সংবাদ আসে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার। এটা জাতি হিসেবে আমাদের সম্মিলিত লজ্জার উদাহরণ। এখন সমাজে ভুয়াদেরই দাপট বেশি। আর তাই কবির সরল উচ্চারণÑ প্রকৃত যোদ্ধা ও জ্ঞানীর সনদ লাগে না।
মা এক অক্ষরের ছোট্ট শব্দ। তবু আমাদের জীবনে মা যেন আরেকটা ভুবন। মা -বললেই কতো স্মৃতি, কতো ভালোবাসা, আদর, স্নেহ-শাসন। ভুবনের সব ভালোবাসাই যেন মা তাঁর আঁচলে জমা রাখেন। আর সন্তানের জন্য ¯েœহের মায়ার আঁচল বিছিয়ে রাখেন মা অবিরাম দিবানিশি। 
আর তাই কবি মাশুক শাহী বলেন- 
‘মা প্রেমিকা হয়, প্রেমিকা কখনো মা হয় না’। 
কি সহজ সরল উচ্চারণ। অথচ কতো গভীর ও মর্মভেদী সত্যকে প্রবিষ্ট করেছেন কবিতার পঙ্ক্তিতে।
কর্পোরেট সা¤্রাজ্যবাদ এ কবিকে বিস্মিত ও  বিচলিত করে। কর্পোরেটের একচেটিয়া বাজার সন্ত্রাস ও প্রচারণার দৌরাত্ম্যে মিথ্যা-সত্য যাচাই করার সুযোগ নেই। প্রচার মাধ্যম বলছে, সুতরাং এটিই সত্য। ‘কর্পোরেট ঋষি’ কবিতায় মাশুক শাহী বলেন-
‘প্রচারণায় প্রচারণায় অস্তিত্বহীন
অস্তিত্বময় আলো হয়ে
মৃত প্রজন্ম, মৃত সাহিত্য, মৃত শিল্প প্রসব করে।
দর্শন  মেশিনে তৈরি করে পুঁজির শকুন
নির্বিচারে মানুষ মারে-শুভ মারে- সৌন্দর্য মারে’।
(ঘুমকন্যা ও  ফিনিক্স হৃদয় পৃষ্ঠা-২৭)

লম্পট পুঁজির ধারক বাহক কর্পোরেট বাণিজ্যের কারবারিরা সব কিছুকে গ্রাস করছে। শুভ সুন্দর আর থাকছে না। কবির এই আর্তনাদ এই কান্না নির্যাতিত নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের কান্না হয়ে ওঠে।
‘পালপাড়া’ শিরোনামের কবিতায় কবি বলেন,
‘রাষ্ট্র কখনো প্রান্তজনের ইতিহাস লেখে না।
লিখলেও সে ইতিহাসে জোছনা ঝরে না’।
(ঘুমকন্যা ও  ফিনিক্স হৃদয় পৃষ্ঠা-১১)
মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। স্বাধীন মানুষেরা রাষ্ট্রের নির্মম খাঁচায় পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকে।
প্রান্তজনের ইতিহাস রাষ্ট্র কখনো লিখবে না। রাষ্ট্রেতো এখন প্রান্তজন থেকে বহু বহু দূরে সরে গেছে। একটি জনযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশতো বহু আগেই নিখোঁজ। বহু আগেই হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেনÑ ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়ে ছিলাম?’ নব্বই দশকের আরেক কবি বলছেন,
‘রাষ্ট্র প্রান্তজনের ইতিহাস লেখে না’।
এভাবেই যুগে যুগে কবিদের চিন্তা পরম্পরা একইভাবে ধরা দেয়। সমাজ কাঠামো ভেঙে নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন একমাত্র কবিরাই দেখতে পারে। মাশুক শাহী কথিত প্রেমের ভান ভনিতার বিপক্ষে। মেকি নারীবাদীদের চিত্র উন্মেচন করেছেন ‘রাধা ও নারীবাদ’ কবিতায়। যেমন শাহী লিখেছেন,

‘অন্তর পাঠে রাধার কান্নায় 
নেফারতিতির ঘুম ভেঙ্গে যায়!
একই কবিতায় পরের পঙ্ক্তিগুলো এমনÑ
‘ঘর-বর-স্বর ছেড়ে
ঘাটে যাওয়ার সাহস থাকতে হয়’।
(ঘুমকন্যা ও  ফিনিক্স হৃদয় পৃষ্ঠা-২১)

ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেমের কামের আহ্বান জানাতে ইচ্ছুক নয় এই কবি। আর তাই তার স্পষ্ট উচ্চারণ-
ঘর-বর-স্বর ত্যাগের সাহস না থাকলে মনোবাসনা পূর্ণ হবে না। সাহসটাই হচ্ছে প্রেম।

শিল্প সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে কবিতা। কবিতার চেয়ে গভীর শিল্প মাধ্যম অন্য কিছু নয়। কবিতার তুলনা কবিতাই। তবু কবিতার প্রতিচিত্র প্রকাশের তাড়নায় মাশুক লিখেছেন-অনির্বাণ আগুনের উত্তাপময় কিছু চরণ এখানে তুলে ধরছি-
‘কবিতা পৃথিবী! পৃথিবী কবিতার সন্তান।
না আছে মাতা-পিতা, কবিতাই প্রথম ঈশ^র।
কবিতার অলিগলি জীবনের চেয়েও মুগ্ধকর,
ইতিহাস গিলগামেশের চেয়েও বিস্ময়কর ’।
(ঘুমকন্যা ও  ফিনিক্স হৃদয় পৃষ্ঠা-৩৩)

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয় এ জগৎ সংসারে। ঈশ^র ও দ্রোহী খোঁজে কবিতার দু’টি চরণ-
‘স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল অন্তরীক্ষে
মানুষই মানুষের একমাত্র আশ্রয়’।
এমন সর্বজনীন আর সর্বমানবিক অসাম্প্রদায়িক সত্য কথক যিনি তিনিই তো কবি। বন্ধু কবি মাশুক শাহীর কবিতাযাত্রা অব্যাহত থাকুক এই প্রার্থনা আজ। 

×