ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

অন্ধকারের রাজা

বিচিত্র কুমার

প্রকাশিত: ০১:০৮, ১ নভেম্বর ২০২৪

অন্ধকারের রাজা

রুদ্র

রাতের শেষ প্রহর। একটি ক্ষীণ হলুদ আলো গলির মোড়ে ঝুলে আছে। দৃষ্টি যতদূর যায়, চারপাশে শুধুই গভীর অন্ধকার। পুরো এলাকা যেন নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছে। এখানেই বাস করে রুদ্র। শহরের এই নির্জন এলাকা, যেখানে আলো এড়ায়, মানুষ এড়িয়ে চলে, সেখানেই যেন রুদ্র তার রাজত্ব গড়ে তুলেছে। স্থানীয়রা তাকে ‘অন্ধকারের রাজা’ নামে ডাকে, যদিও কেউ কখনও তার সঠিক পরিচয় জানে না। মানুষের চোখ এড়িয়ে, রুদ্র তার জীবনযাপন করে অদৃশ্য অন্ধকারে।
রুদ্রের জন্ম হয়েছিল এই অন্ধকারের গলিতে। মা-বাবা কখনও ছিল না তার জীবনে, অথবা থাকলেও তার কোনো স্মৃতি নেই। কচি বয়স থেকেই বাঁচার তাগিদে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে, হাত পেতে ক্ষুধার শান্তি খুঁজেছে। এক সময় অন্যদের মতো সেও বুঝে গেল, এই পৃথিবীতে ভালোবাসা কেবল একটি শব্দ, কিন্তু বাঁচতে হলে শক্তি আর বুুদ্ধির প্রয়োজন। আর তাই, রুদ্রের পথ হয়ে উঠল শক্তির অন্ধকার রাজত্ব।
ছোটবেলায় রুদ্রের একমাত্র বন্ধু ছিল তার ছায়া। রাত্রির গভীরে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, রুদ্র তখন একা একা ছায়ার সঙ্গে কথা বলত। ছায়া তাকে বুঝতে পারত, তার কষ্ট, তার রাগ, তার ভালোবাসাহীন জীবন সব কিছু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সেই ছায়া যেন বাস্তব হয়ে উঠল। রুদ্র বুঝতে পারল, এই অন্ধকারই তার সত্যিকারের আশ্রয়। মানুষ তাকে ছেঁটে ফেলেছিল, কিন্তু অন্ধকার তাকে নিজের কোলের মধ্যে ঢেকে রেখেছিল। রুদ্র তার ছায়ার সঙ্গেই বাঁচতে শিখল, অন্ধকারেই নিজের পৃথিবী গড়ে তুলল।
রুদ্রের রাজত্ব ছিল মানুষের চোখের আড়ালে, কিন্তু তার প্রভাব ছিল শহরের প্রতিটি কোনে। ছোটখাটো গ্যাং, অপরাধী চক্র, সবকিছুই তার নজরে। কেউ জানত না যে, এই রহস্যময় ‘অন্ধকারের রাজা’ হলো সেই ছেলেটি, যে এক সময় পথে পথে ভিক্ষা করত। রুদ্র নিজের বুদ্ধি আর সাহস দিয়ে অপরাধের জগতের এক প্রভাবশালী নাম হয়ে উঠল। তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, ছিল কেবল ভয়। এই ভয়ই তাকে অদম্য করে তুলেছিল। শহরের অপরাধ জগতে তার নাম উচ্চারণ করতেই সবার গা শিউরে উঠত।
কিন্তু অন্ধকারের রাজাও কি কখনও সত্যিকারের আলো দেখতে পায়? এই প্রশ্নই বারবার রুদ্রকে তাড়া করে বেড়ায়। এক সময়, তার মধ্যে সন্দেহ জন্মায়। সে নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখে, অন্ধকারের এই রাজত্ব কি সত্যিই তাকে শান্তি দিয়েছে? নাকি আরও গভীর অন্ধকারে টেনে নিয়ে গেছে? রুদ্রের ভেতরে এক ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়। সে বুঝতে পারে, সে এই অন্ধকার থেকে পালাতে চায়। কিন্তু কিভাবে পালাবে?
একদিন, রুদ্র সিদ্ধান্ত নেয়, সে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এত সহজ নয়। তার ছায়া, তার সেই একমাত্র সঙ্গী, তাকে ছাড়তে চায় না। ছায়া বলে, ‘তুই আমার সঙ্গে থাকবি, তুই কখনও আলোতে যেতে পারবি না। তুই অন্ধকারের রাজা, আর তোর জায়গা এটাই।’
রুদ্র ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। বাস্তব জীবনের লড়াইয়ের চেয়ে এই লড়াই আরও কঠিন। এ লড়াই নিজেকে হারিয়ে ফেলার। অন্ধকারের গভীরে ডুবে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া সহজ নয়।
এরপর একদিন, একটি ঘটনা ঘটে যা সবকিছু বদলে দেয়। শহরের এক ছোট ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়। সেই ছেলেটির মা রুদ্রের কাছে আসে সাহায্যের জন্য। তিনি জানেন, রুদ্র অন্ধকারের রাজা, কিন্তু হয়তো তার মধ্যে কোথাও একটু মানবিকতা আছে। রুদ্র প্রথমে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। কিন্তু ছেলেটির মায়ের কান্না, তার বাচ্চাটিকে ফিরে পাওয়ার আকুতি, রুদ্রকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়।
এই ঘটনাই রুদ্রের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার তাকে পরিবর্তন করতে হবে। সে বুঝতে পারে, অন্ধকারের রাজা হয়েও তার ভেতরে এখনো কিছু আলো বাকি আছে, যা তাকে আবার মানুষ হিসেবে বাঁচার সুযোগ দিতে পারে।
রুদ্র তার সব শক্তি দিয়ে ছেলেটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে রুদ্রের পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে। অন্ধকার জগতের সবাই জেনে গেছে, রুদ্র তাদের সঙ্গে আর নেই।
এই গল্পের শেষে, রুদ্র অন্ধকারের রাজ্য ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু ছায়া তাকে শেষ মুহূর্তেও ছাড়তে চায় না। ছায়া তার পিছু নেয়, বারবার তাকে অন্ধকারে টেনে নিতে চায়। কিন্তু রুদ্র এবার জানে, সে কোন্ পথে যাবে। সে নিজের ছায়াকে ছাড়িয়ে, সেই অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে পা বাড়ায়।
গল্পের শেষ দৃশ্য। রুদ্র হেঁটে যাচ্ছে শহরের আলোকিত পথে। তার পেছনে ছায়া আছে, কিন্তু এবার রুদ্রের ভেতরে সেই অন্ধকারের ভয় নেই।

×