ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

জীবনানন্দীয় রং

আবু আফজাল সালেহ

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

জীবনানন্দীয় রং

জীবনানন্দ দাশ

বাংলার প্রকৃতিকে জীবনানন্দ দাশ (বরিশাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ কলকাতা, ২২ অক্টোবর ১৯৫৪) ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগের মধ্যের যথার্থতা প্রায় নিখুঁত। আর এ নিখুঁত প্রতিচ্ছবি (যা পূর্ববাংলার প্রতিনিধি) চমৎকারও বটে। পঞ্চইন্দ্রিয়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার পাঠককে মুগ্ধ করে। প্রকৃতি বর্ণনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো সরল কিন্তু জীবনানন্দ আরও পরিষ্কার, আরও যথার্থ বা জীবন্তÑ কিন্তু কোমল আবহে।

উপমা, অলঙ্কার মিলিয়ে সুন্দর চিত্রকল্পগুলো পূর্ববাংলার (এমনকি পশ্চিমবঙ্গের) প্রচ্ছদই বলা যেতে পারে। জীবনানন্দ দাশ কবিতায় বর্ণিল রঙের মাধ্যমে সুন্দর সুন্দর দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন। একই রঙের বিভিন্ন রূপ তাঁর কবিতায় ধরা দিয়েছে। ধরা যাক রোদের কথা। রোদের রঙের বিভিন্ন রূপ জীবনানন্দের কবিতায় নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। রং নিয়ে খ- খ- দৃশ্যকল্প নিয়ে সামগ্রিক একটা আবেদন সৃষ্টির ক্ষমতা জীবনানন্দের কবিতার গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য।  
আলো কখনো প্রখর, কখনো স্নিগ্ধ কখনো বা প্রভাময় তেজোদীপ্ত। রাত্রির রং, ভোরের রং, সকালের রং, দুপুরের রং, বিকেলের রং, গোধূলির রং কী নেই জীবনানন্দের কবিতায়। ‘সবুজ পাতার হলুদ হওয়া’, ‘হেমন্তে চিলের সোনালি ডানার খয়েরি ছোপ-ধরা’ ইত্যাদি রঙের দৃশ্যকল্প। কোনো অবস্থানকেই তিনি অবহেলা করেননি, এড়িয়ে যাননি। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির বিভিন্ন আলো দেখা যায়। যেমনÑ রোদের আলো, জ্যোৎস্নার আলো, মেঘের আলো, পাতার আলো, তারার আলো শ্মশানের চিতার আলো প্রভৃতি। কয়েকটি কবিতায় প্রয়োগ দেখা যাক-
(১) ‘শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভস্মবহ্নি জ্বলে’
[পিরামিড/ঝরাপালক]
(২) ‘এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে;
কী যে এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন’ 
[সবিতা/বনলতা সেন]
(৩) ‘এ ভোর নবীন বলে মেনে নিতে হয়;
এখন তৃতীয় অঙ্ক অতএব; আগুনে আলোয় জ্যোতির্ময়’
[উত্তর প্রদেশ/ সাতটি তারার তিমির] 
(৪) ‘বাদামি-সোনালি-শাদা-ফুটফুট ডানার ভিতরে
রাবারের বলের মতন ছোট বুকে
তাদের জীবন ছিল’
 [পাখিরা/ ধূসর পা-ুলিপি]
(৫) ‘এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন
তোমার শরীর’
[সুদর্শনা/বনলতা সেন]
(৬) ‘আরও এক আলো আছে : দেহে তার বিকাল বেলার ধূসরতা ’
[মৃত্যুর আগে/ধূসর পা-ুলিপি]
(৭) ‘...কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে- আসিয়াছে শান্ত অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে’
[আকাশে সাতটি তারা]
 
কবিতায় বর্ণিল রঙের মাধ্যমে সুন্দর সুন্দর দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন। একই রঙের বিভিন্ন রূপ তাঁর কবিতায় ধরা দিয়েছে। জোনাকীর আলো, মোমের আলো, গ্যাসলাইট, মশালের রং, রক্তিম চিতার আগুন, উল্কার আলেয়া ইত্যাদির মতো বহুমাত্রিক আলো ধরা দিয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়। তাঁর প্রিয় রং ছিল বোধহয় সবুজ। সাদা ও লাল রঙের বিচিত্র ব্যবহারও দেখা যায় জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। সূর্য হচ্ছে আলোর প্রধান উৎস।

শিশিরের বিন্দুতে পড়ে হাজার সূর্যতে পরিণত হয় আলোয়। জ্যোৎস্নার আলো নিয়ে মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছে শত শত কবি। দিনের বিভিন্ন অংশের সূর্যের বিভিন্ন রং নিয়ে কবিরা মাতোয়ারা। জীবনানন্দ দাশ রঙের খেলা খেলেছেন বিভিন্ন কবিতায়। তাঁর রোদের রং কখনো রাঙা, কখনো কমলা, কখনো স্ফটিক।

(১) ‘রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল!’
[অবসরের গান/ধূসর পাণ্ডুলিপি]
(২) ভোর;
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল’
[শিকার/ বনলতা সেন]
(৩) ‘কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা’
[ঘাস/বনলতা সেন]
(৪) ‘তোমারে ডাকিয়া লয় দূরে-কত দূরে! 
কোন সমুদ্রের পারে, বনে-মাঠে-কিংবা যে আকাশ জুড়ে
উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে!’
[সহজ/ধূসর পা-ুলিপি]

‘চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ (শিকার/বনলতা সেন)’, ‘জ্যোৎস্না রাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল/ চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ। (হাওয়ার রাত/বনলতা সেন)’, ‘রামধনুর রঙের কাচের জানালা,/ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়.../পর্দায় গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ/রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ! (নগ্ন নির্জন হাত/বনলতা সেন) ইত্যাদি পঙ্তি ব্যবহারে কবিতায় গাঢ় বা জোরালো রঙের ব্যবহার করেছেন জীবনানন্দ দাশ।

‘সাদা পাখি, মালাবার ফেনার সন্তান (সিন্ধু সারস/মহাপৃথিবী), বরফের মতো সাদা ঘোড়াদের তরে (পরিচায়ক/মহাপৃথিবী), দুধের মতন সাদা নারী (সবিতা/বনলতা সেন), স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে সাদা বকের মতো উড়ছে সে (হাওয়ার রাত/বনলতা সেন)’, ‘চেয়ে দেখি বরফের মতো সাফা ডানা দুটি আকাশের গায়/ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীর আনন্দ জানায় (সিন্ধু সারস/মহাপৃথিবী)’ ইত্যাদি কবিতাংশে বিচিত্র সাদা রঙের ব্যবহার দেখা যায়। সবুজের মতো সাদা রং প্রিয় তার। সাদা রং ‘সিন্ধু সারস’ কবিতায় ফবিজম, ইম্প্রেশনিজম ও ফিউচারিজমের অপূর্ব মেলবন্ধন হয়েছে।

আমরা দেখেছি, ফবিস্টরা রংকে প্রাধান্য দিতেন, আর ফিউচারিস্টরা প্রাধান্য দিতেন গতিকে। ইম্প্রেশনিস্টরা চলন্ত (মুভমেন্ট) ভাবকে প্রকাশ করেছেন। জীবনানন্দের কাছে সব সেন্স (সর্বোচ্চ পরিমাণে) আবার রং, গতি আর মুভমেন্ট ইত্যাদির মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন এক স্বর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। 
ইন্দ্রিয়বোধে জীবনানন্দ দাশ অতুলনীয়। পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ে নতুনত্বের চমক পাওয়া যায়। পঞ্চইন্দ্রিয়ের কাজে লাগাতে তাঁর কবিতার জুড়ি মেলা ভার। মানসীর চুলের ব্যঞ্জনা দিতে গিয়ে বললেন, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’। ‘চাঁদের আলো’কে ‘রুপালি শস্য’ বলেছেন তিনি। ‘কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব (হঠাৎ দেখা)’, ‘আমি রঞ্জনের ও-পিঠ, যে পিঠে আলো পড়ে নাÑ আমি অমাবস্যা (অমাবস্যা), ‘মলিন সবুজ’, ‘আঁখি যার গোধূলির মতো গোলাপি, রঙিন’, ‘মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন’, ‘ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো পান’, ‘পরদায় গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের স্বেদ’, ‘বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে’, শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা’, ঘাসের ওপর দিয়ে ভেসে যায় সবুজ বাতাস, আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে, আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল, পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ, পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি মদির মেয়েটির মতো ইত্যাদির মতো রং দিয়ে নির্মিত দৃশ্যকল্প। ইন্দ্রিয়ঘনত্ব জীবনানন্দ দাশের কবিতার অন্যতম প্রবণতা।

দৃশ্যচিত্রের অনেকক্ষেত্রে গন্ধ, স্পর্শ ও রসনার স্বাদও দেয়। একই কবিতায় একাধিক ইন্দ্রিয় জাগ্রত হয়। ছবি আঁকার তার এ নিপুণতা আলাদা করেছে। চমৎকারিত্ব এনেছে কবিতায়। শ্রবণ, দর্শন, স্পর্শ, ঘ্রাণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার লক্ষণীয়। রোদের রঙের বা সূর্যের রঙের বহুমাত্রিকতা এনে পাঠকে দৃশ্যকল্পকে পরিষ্কার করে দিতে সক্ষম। এখানেই জীবনানন্দ দাশের বিরাট সফলতা। রোদ নিয়ে বা বিভিন্ন প্রকারের আলোর সমাবেশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়- যা বিশ্বকবিতায় বিরল। 
জীবনানন্দ দাশের ‘সেন্স ডেভেলপিং’ ক্ষমতা দারুণ। সৌন্দর্যতত্ত্ব ও অপার মহিমার প্রকৃতি ধরা দিয়েছে জীবনের কবিতায়। দেখা যায়, কবিতায় দ্বিমুখীবোধ সক্রিয়। দৃশ্য ও মনজগত-দ্বিমুখীবোধ জাগ্রত। সব মিলিয়ে চিত্রকল্প নির্মাণে অনন্য উচ্চতায় রয়েছেন আমাদের জীবনানন্দ দাশ। তাঁর রং যেন হয়ে উঠেছে রহস্যময়- নারীর মতো। সৌন্দর্যের ফাঁদে পড়ে রং পায় বহুমাত্রিকতা- বর্ণিল, প্রেমিকার ডাকের মতোই। 
‘কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, 
বলিল, তোমারে চাই’

×