ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

একান্ত অবলোকন ॥ আট বছর আগের একদিন

রহমান মতি

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

একান্ত অবলোকন ॥ আট বছর আগের একদিন

অশোকানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ রচিত বিখ্যাত কবিতা ‘আট বছর আগের একদিন’ তাঁর ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা। এ কাব্যগ্রন্থটি ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়। কবিতাটির অবলোকন করা হচ্ছে। যে কোনো বিশ্লেষণই লেখকের ব্যক্তিগত, তারপর সেটার সঙ্গে অনেকের অনুভূতি মিলে গিয়ে সামষ্টিক হয়ে যায়। এই বিশ্লেষণও তার ব্যতিক্রম নয়। 
জীবনানন্দের ছোটভাই অশোকানন্দ দাশের একটি লেখা থেকে জানা যায়, তার বড়ভাই কবি জীবনানন্দ দাশসহ তিনি প্রায়ই বরিশালে একটি লাশকাটা ঘরের সামনে দিয়ে যেতেন। লাশকাটা ঘর থেকে কি ধরনের গল্প তৈরি হতে পারে, তারই একটি নমুনা মেলে ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায়।
কিছু কিছু কবিতা আছে, যেগুলো গল্প বলতে থাকে। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাকেও একটি গল্প বলা যায়। পাঠক যখন কবিতাটি পড়বেন, তিনি ভাববেন যেন কেউ তাকে পড়ে শোনাচ্ছে। এই পড়ে শোনানোর অদৃশ্য লোকটিকে বলা হয় কথক। কথক কবিতাটি বলে যাচ্ছে, যাকে কবি জীবনানন্দ দাশ সৃষ্টি করেছেন। কবিতার সেই কথক বলছেন-‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে।’ ‘শোনা গেল’ কথাটাই বলে দেয় কবিতার গল্পটা বাস্তবে ঘটেছে এমন কিছু না। কবি অনেকের জীবনের বাস্তবতাকে বরং তুলে ধরেছেন। কথক একজনের গল্পটা বলছেন। কবিতায় প্রধান চরিত্র যে লোকটি আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যা যিনি করেছেন তিনি কেন তা করেছেন, সেটাকে কবি দুইভাবে তুলে ধরেছেন। 
১. জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হওয়া
২. জীবনের দিকে আহ্বান
মূলত যে আত্মহত্যা করে, তার কোনো যুক্তি বা দর্শন থাকে কিনা জীবনানন্দ দেখিয়েছেন। আত্মহত্যা করার আগে জীবনের প্রতি তার আর কোনো আকর্ষণ থাকে না, আশা থাকে না। নিঃসঙ্গতা ব্যক্তিমানুষের চূড়ান্ত ক্ষতি করে বসে, তাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কবির বিখ্যাত সেই উপমা- ‘উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে’ নিঃসঙ্গতার বিবর্ণ রূপ তুলে ধরেছে সেই ব্যক্তির। জীবনে প্রেম, নারী, শিশু, গৃহ এত আশ্রয় থাকার পরেও ‘বিপন্ন বিস্ময়’ যাকে গভীর কোনো জীবনসত্য বলে কবি উল্লেখ করেছেন, সেই বাস্তবতাকে পাশ কাটাতে পারেনি আত্মহত্যাকারী ঐ ব্যক্তি। ‘এক গাছা দড়ি হাতে অশ্বত্থ গাছ’-এ গেছে ঝুলে পড়তে। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে এবং ‘চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে’ লাইনটি তার চূড়ান্ত পরিণতি বরণ করাকে বোঝায়।

অন্যদিকে জীবনের দিকে আহ্বানও করেছেন কবি। যখন কেউ নিজেই নিজেকে শেষ করার একক সিদ্ধান্ত নেয়, জীবন কি তাকে ডাকে না বেঁচে থাকার জন্য? সেই আহ্বান মানুষ না করলেও প্রকৃতি এবং প্রাণী বা কীটপতঙ্গরা করে তাদের জীবনের অবিরাম ছুটে চলার মাধ্যমে। সেজন্য কবি জীবনানন্দ দাশ পেঁচা, ইঁদুর, মাছি, মশা, ফড়িং, দোয়েল এসব প্রাণী, পাখি বা পতঙ্গের কথা বলেছেন, যারা অস্তিত্ব রক্ষা করতে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে আছে নিজেদের প্রয়োজনে। পেঁচা ইঁদুর শিকার করতে যায় নিজের প্রয়োজনে।

তাদের দেখেও কি আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিটি বেঁচে থাকার কোনো অনুপ্রেরণা পায়নি, সেটাই কবির প্রশ্ন। অশ্বত্থের শাখা, জোনাকি, সুপক্ব যব তারাও এসে জানতে চেয়েছে, দেখাতে চেয়েছে তাদের জীবনমুখী আয়োজন। মৃত্যু বেছে নেয়া ব্যক্তিকে কবির প্রশ্ন- ‘মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো?’ জীবনের ‘ভাঁড়ার’ বা আবর্জনাকে মাড়িয়ে সবার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়তো হয় না, তাই কেউ কেউ হয়ে ওঠে আত্মহন্তারক। 
কবিতাটি সম্পর্কে কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর নিজের ব্যাখ্যায় এককথায় বলেছেন- ‘ফৎধসধঃরপ ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ’. কবিতাটিতে নাটকীয়তা তো আছেই, সেই সঙ্গে গল্পও আছে। মতবাদের কথা বললে ‘এক্সপ্রেশনিজম’-এর কথা বলে যায় কবিতাটি, যেখানে ‘ঢ়যুংরপধষ ৎবধষরঃু’-র বর্ণনা আছে কবিতায়। ফ্রয়েড আসতে পারে মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের জন্য, যেখানে সংসার, হাড়হাভাতের গ্লানি, নারী বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করা যায়। কবিতাটি জীবনমুখী অবশ্যই। যে জীবন নিজে শেষ করে দিচ্ছে, সেটাও যেমন বাস্তব কাউকে জীবনের দিকে আহ্বান করাটাও বাস্তব। তাই কবিতাটি বাস্তববাদীও বিপরীত দিকে।
‘আট বছর আগের একদিন’ কবি জীবনানন্দ দাশের বহুল জনপ্রিয় কবিতা হয়ে থাকবে নতুন নতুন আরো বিশ্লেষণে।

×