ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১

এশিয়ায় এলো সাহিত্যে নোবেল

দ্য ভেজিটেরিয়ান

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

দ্য ভেজিটেরিয়ান

প্রফেসর হ্যান কাং

শুধু একটি ছোটগল্প এবং এ একই গল্পের ভাবকাঠামোর পরিশীলিত উপন্যাসেরুপর একজন লেখকের ভাগ্যকে কতটা সুপ্রসন্ন করতে পারে, তার এক বিরল দৃষ্টান্ত দক্ষিণ কোরিয়ার কবি ও কথাশিল্পী সিউল ইনস্টিটিউট অব আর্টসের ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিভাগের সাবেক প্রফেসর হ্যান কাং। তার সে ছোট গল্পটির নাম ‘দ্য ফরুটু অব মাই ওম্যান’ আর পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসটি হলো ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’।

অবশ্য তার এই প্রধানতম উপন্যাসের বাইরে আরও কিছু গ্রন্থও পুরস্কার প্রাপ্তিতে যে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে হান কাংয়ের লেখালেখির বড় সাফল্য আসে আসলে তার এই ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর।
‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ একটি মাস্টার পিস। এটি মূলত ১৯৯৭ সালে কোরীয় ভাষায় লিখিত তার ছোটগল্প ‘দ্য ফরুটু অব মাই ওম্যান’-এর ভাবকাঠামোর পরিশীলিত রূপ। দীর্ঘ দশ বছর পর ২০০৭ সালে এই গল্পটিকেই তিনি উপন্যাসে রূপ দেন। এটিই তার সুবিখ্যাত উপন্যাস  ‘ঞযব ঠবমবঃধৎরধহ’, যা সমগ্র কোরিয়াজুড়ে আলোড়ন তোলে।

এটি লিখতে তিনি তিন বছর সময় ব্যয় করেন। এটির কেন্দ্রীয় ও নারী চরিত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা অন্যান্য চরিত্রের পটভূমি এবং গাছপালা ও সূর্যকিরণের চিত্রকল্পের আবহ তৈরির জন্য তিনি অনেক ভাবনাচিন্তা ও পর্যবেক্ষণ করে  মাসের পর মাস খেটে  উপন্যাসটি সমৃদ্ধ করেন। কোরীয় ভাষায় ২০০৭ সালে বইটি প্রকাশিত হলেও ২০১৫ সালে তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন কোরীয় ভাষার জনপ্রিয় ব্রিটিশ অনুবাদক ডেবোরাহ স্মিথ।

ইংল্যান্ড, আমেরিকায় এটির ইংরেজি ভার্সন প্রকাশের পরপরই হ্যান কাংয়ের ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। ২০১৬ সাল থেকে  বিশ্বে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বইটি আরও ১৩ ভাষায় অনূদিত হয়। লেখক হিসেবে পাল্টে যায় তার জীবন। ইংরেজি অনুবাদের পর ২০১৬ সালে এ উপন্যাসের জন্য তিনি ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার জিতে নেন । এ গ্রন্থটিই চলিত অক্টোবরে তাকে পাইয়ে দেয় ‘নোবেল প্রাইজ’ নামের হীরক খণ্ড।

এটি নিয়ে ২০০৯ সালে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। তিন পর্বে লেখা এ উপন্যাসটিতে ইয়ং হাই নামের এক নারীর  নিরামিষাশী হয়ে ওঠার গল্প তুলে আনা হয়েছে, যিনি মাংস খেতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তার স্বামী, কর্তৃত্ববাদী বাবা এবং অন্যান্যের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়ে নিষ্ঠুরতার আতঙ্ক নিয়ে ‘বৃক্ষের মতো’ বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা চালান। তার উদ্ভিদময় সেই রাজ্য একদিকে যেমন আকর্ষণীয়, অন্যদিকে তেমনই অন্ধকার এবং বিপজ্জনকও।

এতে দেখা যায়, অদৃশ্য অনুশাসনের নিগড়ে আবদ্ধ ইয়ং হাইয়ের স্বামী লোকটি তার স্ত্রীর বুক নিয়ে চিন্তিত, স্তনবৃন্ত দেখা যাচ্ছে, কি যাচ্ছে না। পরিবারের অন্য সদস্যরা কিন্তু তার মাংস খাওয়া না খাওয়া নিয়ে চিন্তিত। অথচ কেউ ভাবল না, ইয়ং হাইয়ের মনোজগতে এসব কী তীব্র ঘৃণার ঝড় তুলছে।
‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসের মাধ্যমে হ্যান কাং কোনো ভনিতা ছাড়াই পাঠককে এক নগ্ন সত্যির মুখোমুখি দাঁড় করান। যেখানে পাঠক উদ্ভট অস্বস্তি ও বিকৃত আরামের দোদুল্যমানতায় ভোগেন; আবার বিবেকের দংশনেও ক্ষত হন। এটা এমন এক অবস্থা যেখান থেকে পাঠক বেরিয়ে আসার সুযোগ কম, আবার পালানোরও পথ পান না।

এ যেন উপন্যাসশৈলীর কনভেনশনগুলোর দিক বদলের এক অভিনব প্রচেষ্টা!  অবশ্য আমরা এতে ফ্রানৎস কাফকার ‘রূপান্তর’ গল্পের কিছুটা ছায়াও দেখতে পাই, যেখানে ‘পোকা’র জায়গায় তিনি ‘বৃক্ষ’ দেখিয়েছেন। কাফকা লিখেন, ‘‘এক সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় পড়ে আছে এক দৈত্যকার পোকায় রূপান্তরিত হয়ে।”
‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’-এর পথ বেয়েই হ্যান কাংয়ের নোবেল স্বীকৃতি। তবে এর পেছনে রয়েছে  তার স্বকীয় গভীর ক্ষুরধার ও কাব্যময় গদ্য, যা ইতিহাসের যন্ত্রণাদগ্ধ ঘটনাকে উপজীব্য করে মানব জীবনের ভঙ্গুরতাকে উন্মোচিত করে, আলোর পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে জীবনের নানা উত্থান-পতন, দুঃখ-বেদনার অনুভূতি, ঐতিহাসিক ট্রমা, অদৃশ্য অনুশাসন। তার নিরীক্ষাধর্মী ও কাব্যময় লিখনশৈলী গদ্য সাহিত্যের ভাণ্ডারে এক অভূতপূর্ব ব্যতিক্রমী সংযোজন, যা তাকে সাফল্যের স্বর্ণ দুয়ারে পৌঁছে দেয়।

এ প্রসঙ্গে নোবেল কমিটি জানান, ‘কাব্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গদ্যের নতুন ধারার সূচনা ঘটিয়েছেন হ্যান কাং। তার কাজ বিভিন্ন ধরনের শৈলীকে একত্র করে নতুন কিছু তৈরি করেছে। এই কাজগুলো নৃশংসতা, শোক ও পিতৃতন্ত্রের মতো জটিল বিষয়গুলোকে সম্বোধন করে।’ তার লেখায় দেহের সঙ্গে আত্মার, জীবিতের সঙ্গে মৃতের সংযোগ নিয়ে এক ধরনের সচেতন বোধ বিচ্যুরিত হতে দেখা যায়, যা সুনির্দিষ্ট গণ্ডি বা ছকে বাঁধা যায় না।

তার গদ্য সাহিত্যে ‘ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশন’ এতটাই প্রখর যে, নোবেল কমিটির বিচার করা তা এড়িয়ে যেতে পারেননি। ফলত,  বিশ্বের তাবৎ বাঘা বাঘা সাহিত্যিককে পিছনে ফেলে সাহিত্যে নোবেল নামের সোনার ট্রফি ছিনিয়ে নেন ৫৩ বছর বয়সী এই হ্যান কাং।
হ্যান কাংয়ের জন্ম ১৯৭০ সালের ২৭ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরের এক সাহিত্যিক পরিবারে। তার বাবা হ্যান সিউঙ ওন দক্ষিণ কোরিয়ার একজন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক, যিনি এখনো জীবিত। তার বড়ভাই হ্যান ডং রিম ও ছোটভাই হ্যান কিম ইনও লেখক। তার বয়স যখন সবেমাত্র ৯, তখন তার পুরো পরিবার রাজধানী সিউলে চলে যায়।

এখানেই পিতা ও ভাইদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণায় বাবার বিশাল পুস্তকভাণ্ডার থেকে বই পড়ে পড়ে  হ্যান কাংয়ের বেড়ে ওঠা। লেখক পরিবারে আশৈশব লালিত হওয়ার  সুবাদে সংগত কারণেই পারিবারিক আবহের মাঝেই তার মাঝে এক সৃষ্টিশীল লেখকসত্তা অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয়, যা তাকে সাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।
কোরীয় সাহিত্য নিয়ে ইয়োনসেই ভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হ্যান কাংয়ের  সাহিত্যিক হিসেবে প্রথম অভিষেক ঘটে ২৩ বছর বয়সে ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ কোরীয় সাময়িকী ‘লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি’তে ৫টি গুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯৪ সালে তিনি ‘রেড অ্যান্কর’ নামে একটা ছোটগল্পের মাধ্যমে দৈনিক সিউল শিনম্যান সাহিত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার বিজয়ী হয়ে সবার নজর কাড়েন। ১৯৯৫ সালে ‘কারলেকেন টু ইয়েসু’ (ইয়েসুর প্রেম) নামে তার একটা ছোটগল্প সংকলন বের হয়।

এটি প্রকাশের পরপরই এজন্য তিনি জিতে নেন ‘হ্যানকুক সেরা লিখিয়ে পুরস্কার’। মূলত, এটির মাধ্যমে তার গদ্য একত্রিত অবস্থায় প্রথম পাঠকের সামনে আসে। পরবর্তীতে তিনি উপন্যাস লেখায় হাত দেন এবং বছর তিনেকের মধ্যে লিখে ফেলেন জীবনের প্রথম উপন্যাস  ‘ব্যাক ডিয়ার’।

১৯৯৮ সালে এটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লক্ষ্য করে তিনি নিজেকে লেখালেখিতে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন এবং গল্প, গদ্য নোবেল- নোবেলা লেখায় মনোযোগী হন। এরপর একে একে বেরোতে থাকে তার অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্ম। হ্যান কাংয়ের এ পর্যন্ত ৮টি উপন্যাস, ৫টি উপন্যাসিকা, ১টি কাব্যগ্রন্থ ও ২টি প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 
হ্যান কাংয়ের শৈশবে সংগঠিত ১৯৮০ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে  গোয়াংজু বিদ্রোহ তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল, যা তিনি তার অসাধারণ উপন্যাস  ঐঁসধহ অপঃং-এ উপস্থাপন করেন।  এতে মানুষ কি?  দুঃখ, নিষ্ঠুরতা  এসব কেন মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়? -এ ধরনের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজেছেন। এটি তার তীব্র মানবিক ও আবেগী অভিঘাতসম্পন্ন উপন্যাস। ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ উপন্যাসে হ্যান কাং লিখেন, ‘মৌলিকভাবে মানুষ কি সত্যিই নিষ্ঠুর? প্রজাতি হিসেবে নিষ্ঠুরতাই কি একমাত্র অভিজ্ঞতা, যা আমাদের মিলিয়ে দেয়।

যে মর্যাদা আঁকড়ে পড়ে থাকি আমরা, তা আত্মবিভ্রম ব্যতীত কিছু নয়! একটা মুখোশ, যা আমাদের একমাত্র সত্য থেকে দূরে রাখে, যে আমরা প্রত্যেকেই পতঙ্গ,  হিংস্র জন্তু, মাংশের পিণ্ডে পরিণত হতে পারি যে কোনো মুহূর্তে। অধঃপতন, নিধন- মানবজাতির জন্য কি অপরিহার্য, ইতিহাস কি একে অনিবার্য বলে চিহ্নিত করেছে।’’ ২০১৭ সালে এই ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ গ্রন্থের জন্য তিনি  ‘মালাপার্তে পুরস্কার’ লাভ করেন। হ্যান কাংয়ের ‘ণড়ঁৎ ঈড়ষফ ঐধহফং’ (২০০২) একটি  জনপ্রিয় উপন্যাস।  এ উপন্যাসে তিনি  মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বের চিত্র তুলে ধরেন।
             বন্ধুত্ব ও শিল্পকলাকে উচ্চকিত করে লেখা  হ্যান কাংয়ের The Wind Blows, go (2010) উপন্যাসটিও বেশ আলোচিত। এতে দুঃখ ও রূপান্তরের আকাক্সক্ষা যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘Greek Lessons’ উপন্যাস।

এতে  বাকশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হারানো যন্ত্রণাদগ্ধ দু’নরনারীর নিবিড় নৈকট্যের মনোমুগ্ধকর সম্পর্কের বর্ণনা বিধৃত হয়। তারা ছিল বিচ্ছিন্ন, কিন্তু ঘটনা পরম্পরা তাদের একত্রিত করে। তখন তারা বুঝতে পারে, পৃথিবীতে কেবল তারাই একমাত্র যন্ত্রণাদগ্ধ নয়।  ২০২৩ সালে তার এ বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
তার ২০১৬ সালে প্রকাশিত  ‘The White Book’ একটি  আত্মজৈবনিক গদ্য কবিতার সংকলন। এটি একটি ধীরগতির বই, যা শূন্যতার আলোছায়ায় মোড়ানো। এতে তার ৬৪টি সংক্ষিপ্ত কবিতার মাধ্যমে জন্মের পর দু’ঘণ্টা বেঁচে থাকা সদ্যমৃত সাদা কাফনে জড়ানো বোনের স্মৃতিকাতরতা উদ্ভূত নিজের মাঝে জমে থাকা গভীর বোধের আলোকে  জীবন ও  মৃত্যুকে ‘রঙ’ও ‘রূপে’র প্রিজমে প্রতিফলিত করেছেন অস্তিত্বের গভীর ধ্যানে। এখানে তার বলার চাইতে না বলা কথাগুলো বেশি বাগ্ময় হয়ে উঠেছে। তার এই অসাধারণ গ্রন্থটি ২০১৭ সালে ডেরোবাহ স্মিথ ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর ২০১৮ সালে  দ্বিতীয়বারের মতো তিনি জিতে নেন ম্যান বুকার প্রাইজ।
হ্যান কাংয়ের কাছে লেখালেখি প্রতিদিনের সাধনার মতো একটা অনুশীলন। এজন্য তিনি প্রতিদিন লেখালেখি করেন এবং বিশ্বাস করেন, তিনি গন্তব্যের নিকটবর্তী হচ্ছেন।
তার সাহিত্যচর্চা শৈলচিকিৎসকের এমন এক নির্ভুল ‘অস্ত্রোপচার’, যেখানে মানবিক আত্মাকে ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে এর অনুষঙ্গগুলোর চারপাশে সূক্ষ্ম সুতোর আখ্যান বোনা হয়, যা বেদনা, ক্ষত, আকাক্সক্ষা ও মুক্তির থিমকে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করে। তার সাহিত্য যেন, রাত্রির গভীরতা শেষে বালার্কের তির্যক রশ্মি, যা দিবালোকের আগমন বার্তার আগাম জানান দেয়। এমন এক সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দিয়ে  নোবেল কমিটি প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকেই উচ্চকিত করলেন।

×