ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

সোনাঋতু হেমন্ত

মোস্তাফিজুল হক

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

সোনাঋতু হেমন্ত

দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ সোনালি রঙের পাকা ধানে ঢেকে দেয় হৈমন্তী

দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ সোনালি রঙের পাকা ধানে ঢেকে দেয় হৈমন্তী। হেমন্তের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে। তৎসম ‘হৈমন্তিক’ শব্দের অর্থ ‘হেমন্তকালে জাত’ বা ‘আগুনী’। ‘আগুনী’ শব্দের উৎস অনুসন্ধানে আমন ধান কাটার মৌসুমকেই বোঝায়। সাধারণত বর্ষার শেষে আমনের চারা রোপণ করা হয়, আর অগ্রহায়ণে তা পেকে সোনালি রং ধারণ করে। এক সময় এই ধানের প্রাচুর্য দেখে সম্রাট আকবর পহেলা অগ্রহায়ণকে বাংলা নববর্ষ হিসেবেও ঘোষণা করেছিলেন।
দয়াবতী হৈমন্তী যেন আঁচল ভরে হেমকুচি নিয়ে আসে। তারপর মুঠো মুঠো সোনা ছড়িয়ে দেয় মাঠে। মাঠের এই শোভা দেখে কিষাণির মন আনন্দে নেচে ওঠে। কাস্তে হাতে ধান কাটতে নেমে যায় কৃষক। সমস্ত ক্লান্তি ভুলে মনের আনন্দে ধান কেটে বাড়ির আঙিনায় নিয়ে আসে। ধানের গন্ধে চারদিক ম ম করে। তখন ছড়ার ছন্দে বলতে ইচ্ছা হয় :
 
‘হেম মানে স্বর্ণ,
সোনারং বর্ণ;
হেমরূপে অন্ত
ও কি সে হেমন্ত?’
 
হেমন্ত ঋতু কার্তিক-অগ্রহায়ণ দু’মাস মিলে হলেও খুব বেশি দিন উপভোগ করা যায় না। এই অল্প সময়ের ঋতুর পরিপূর্ণতা ধরা দেয় অগ্রহায়ণে। তাই তো কবিগুরু লিখেছেন :
 
‘ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে,
আমি কি দেখেছি মধুর হাসি ॥’
 
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ আখ্যানকাব্যে হেমন্ত বৈচিত্র্যময় হয়ে ধরা দিয়েছে :
 
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’
 
ক্ষণিকার এই হাসি মূলত গ্রামের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের আনন্দ নিয়ে হাজির হয়। নতুন চাল আর চালের গুঁড়া তৈরির তালে তালে মুখরিত হয় গ্রামের বাড়ি ঢেঁকিঘর। রাতে ও ভোরে ঘরে ঘরে তৈরি হয় মজাদার পায়েস আর পিঠাপুলি। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষীরের ঘ্রাণ। তাই সুদূর অতীতকাল থেকেই বাঙালির জীবনে হেমন্ত এক চিরন্তন উৎসবের ঋতু। এই উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য; জড়িয়ে আছে সংস্কৃতির নানা দিক।

বাঙালি জাতি সবসময়ই ধর্ম-বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্ন উৎসবে মেতেছে। তৈরি করেছে একে অপরের সঙ্গে মধুর সামাজিক সম্প্রীতি। তাই আজও গাঁয়ের মাঠে মেলা বসে। মেলায় শিশু-কিশোরসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নামে। সবার মাঝেই দেখা যায় আনন্দের ঢেউ। খেটে খাওয়া মানুষগুলো এই মেলাকে একটু ভিন্ন ভাবেই পালন করে। মেলার এককোণে রাতভর চলে পালাগান। বাহারি সব খাদ্যের পসরায় সেজে ওঠে মেলার মাঠ। হালে শহরের মানুষও নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে বেশ ঘটা করেই নবান্ন উৎসব হয়। তিন দিনব্যাপী এই মেলার আয়োজনে থাকে পিঠাপুলির উৎসব। রাজধানীবাসীকে আনন্দ দিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নবান্নকেন্দ্রিক জারি, সারি, মুর্শিদি, লালন ও পালা গান চলে। মেলায় পাওয়া যায় নানা স্বাদের খাবার ও খেলনা সামগ্রী। গ্রামের মেলায় ছোটদের বাড়তি আনন্দ দিতে নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের ব্যবস্থা থাকে। এত স্বল্পায়ুর আনন্দদাত্রী হেমন্তের কথা ভেবে বলতে ইচ্ছা হয় :
 
‘পিঠাপুলি উড়কি
হাতে হাতে মুড়কি
মালপোয়া পায়েসে
নবান্ন আয়েশে
ক্ষণিকেই অন্তÑ
কামিনী হেমন্ত!’
 
মূলত বাঙালির বারো মাসে তেরো-পার্বণকে আরও গাঢ়ো করার উৎসব নিয়ে আসে হেমন্ত। এই উৎসবকে ঘিরে কবি-লেখকের কলমও শাণিত হয়ে ওঠে। যদিও অধিকাংশ কবিই বসন্ত, বর্ষা আর শরৎ নিয়েই ভাবের আবর্তন ঘটিয়েছেন, তবে প্রকৃতি ও চিত্রকল্পের কবি জীবনানন্দ দাশ হেমন্তকেই সবচেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছিলেন। আর তাই হয়তো তিনি তাঁর কবিতায় লিখেছেন :
 
‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরেÑ এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়Ñ হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’
 
কবি জীবনানন্দ দাশের চেতনায় হেমন্ত এক আবেগি মূর্ছনার নাম। তিনি এই ঋতুকে গাঁয়ের সাধারণ কিষাণির সুখ সমৃদ্ধি আর ব্যস্ততাতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তিনি প্রকৃতি প্রেমের নৈবেদ্যকে ব্যক্তিক চেতনায়ও সৃজন করেছেন। তাঁর লেখা ‘সন্ধ্যা হয় চারিদিকে’ কবিতা যেন সে কথাই বলে :
 
‘সন্ধ্যা হয় চারিদিকে শান্ত নীরবতা;
খড় মুখে নিয়ে এক শালিক যেতেছে উড়ে চুপে;
গোরুর গাড়িটি যায় মেঠোপথ বেয়ে ধীরে ধীরে;
আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে;
 
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।’
 
নিঃসন্দেহে হেমন্ত তাঁর প্রিয় ঋতু। আর কোনো কবিই হেমন্তকে নিয়ে তাঁর কবিতায় এত রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর অলঙ্কারের অবতারণা করেননি। তাঁর কবিতা মনের অজান্তেই পাঠককে হেমন্ত-প্রেমিক বানিয়ে ছাড়ে। জীবনানন্দ দাশের ‘ধান কাটা’, ‘নবান্ন’, ‘ইঁদুর’, ‘শালিক’, ‘লক্ষ্মীপেঁচা’, ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘কার্তিকের নীল কুয়াশায়’ বারবার হেমন্তের বর্ণিলরূপ চিত্রিত হয়েছে।
ধানকাটা আর নবান্ন উৎসবই হেমন্ত ঋতুর শেষ কথা নয়, বরং হেমন্ত কৃষককে নতুন সবজি চাষের ব্যস্ততায় নিমগ্ন করে। আলু, বেগুন, লাউ, মুলা, শিম-বরবটি, কপি, টমেটো আর গাজরের চারা কৃষকের যতেœ শীতের আগমনী গান শোনায়। হেমন্ত শেষ মুহূর্তে কুয়াশার আবরণে শীতকে স্বাগত জানায়। তখন হেমন্তের শেষ সপ্তাহে মাঠে নববধূর সাজে সর্ষে ফুলের রূপমাধুরী চোখে পড়ে। ছড়াকারের মন বলে ওঠে :
 
‘হলুদিয়া সর্ষে,
নাচে কোন হর্ষে?
ও কি রাঙা নববধূ?
অঞ্চলে ঢাকা মধু?
রাঙা পায় কুয়াশায়
সাজে ও কি আলতায়?’
 
অথবা, সুফিয়া কামালের সেই বিখ্যাত কবিতা এসে স্মৃতির মণিকোঠায় নাড়া দিয়ে যায়Ñ
 
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?’
 
হেমন্তের রং বদলের পালা যেন সব সৌন্দর্যকে হার মানাতে চায়। হৈমন্তী আকাশেও রাঙা শরতের মতোই নিখুঁত কারুকাজ দেখা যায়। বিকেলে নীল আকাশের ফাঁকে গোধূলির মায়াময় হাতছানি। তখন ঝাঁক বেঁধে হাজারো পাখি নীড়ে ফেরে। হৈমন্তী মাঠ চষে বেড়ানো কিশোরের মন আনমনেই বলে ওঠে :
 
‘হেমন্ত খুব ডেকেছিল
কাল বিকেলে দূরের মাঠে,
সূর্যিমামা দারুণ ঠাটে
অনন্তলাল এঁকেছিলÑ
তালদিঘিটার পুকুর ঘাটে!
 
গোধূলি-ক্ষণ এমন বেলায়
চঞ্চলা মন পাখির মেলায়
মোহিনী সেই সুরের হাটে
ভাব আয়োজন দূরের ভেলায়
অন্যরকম সময় কাটে।’
 
হেমন্ত যেন ভোরের লজ্জাবতীর শবনম ধোঁয়া জৌলুস মাখা। ছাইতান, মল্লিকা আর হাসনাহেনার ঘ্রাণে উদ্বেলিত। তিলপল্লব আর হাওয়ার মিঠাই ওয়ালার টুংটাং শব্দে চিরায়ত শৈশব ও কৈশোরের কথা বলে। হেমন্ত ক্ষুধামুক্ত আনন্দময়ী ঋতু। তাই এই ঋতু শুধু গাঁয়ের মানুষের ঋতু নয়- বাঙালির চির আবেগ ও অনুভূতির ঋতু। এই ঋতুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে; সেইসঙ্গে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে আমাদের কৃষক সমাজের প্রতি।

×