ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

’২৪-এর ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান

গ্রাফিতির ব্যবহার

ড. আশরাফ পিন্টু

প্রকাশিত: ২১:৪০, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

গ্রাফিতির ব্যবহার

গ্রাফিতি

ইতালিয়ান শব্দ ‘Grafitiato’ থেকে এসেছে ‘গ্রাফিতি’ যার অর্থ ‘খচিত’। গ্রাফিতিকে বলা হয় কাউন্টার কালচার, অর্থাৎ যা গতানুগতিক সংস্কৃতির বিপরীত। যে শিল্পকর্মটি প্রচলিত রীতি-নীতি-সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে একধরনের শিল্প বিপ্লব গড়ে তোলে, তাকে গ্রাফিতি বলে। এর উপাদান মূলত সমাজের অবক্ষয়, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, রাজনৈতিক অরাজকতা বা স্বেচ্ছাচারতন্ত্র ইত্যাদি।
কলকাতার মনফকিরা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বীরেন দাশ শর্মার ‘গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প’ গ্রন্থে লেখক গ্রাফিতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে : ‘এক অর্থে গ্রাফিতি সাহিত্য না হয়েও লেখার শিল্প, চিত্রকলা না হয়েও অঙ্কনশিল্প।’ 
সহজ ভাষায় বলা যায়Ñ  গ্রাফিতি হলো দেওয়ালে আঁকা ছবি; যা সাধারণ চিত্রকর্ম থেকে সাধারণ মানুষের ভেতর প্রতিবাদের বোধ জাগ্রত করে। সারাবিশ্বে গ্রাফিতি মূলত প্রতিবাদের নীরব ভাষা হিসেবে পরিচিত।
গ্রাফিতির ইতিহাস বহু পুরনো। প্রাচীন রোম থেকে প¤েপই নগরীর বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্রের দেওয়ালে গ্রাফিতির চিহ্ন পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে গ্রাফিতি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ‘করষৎড়–ধিং যবৎব’ নামক গ্রাফিতি আমেরিকার দেওয়ালে-দেওয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। টাকমাথার লম্বা নাকওয়ালা এক লোক দেওয়াল ধরে বসে আছেÑ এটাই ছিল কিলরয়ের উপজীব্য। সাদামাটা এই গ্রাফিতিটি আমেরিকান সেনাদের ব্যবহারে জার্মানদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা মনে করে, এটা আমেরিকান সেনাবাহিনীর গোপন কোনো কোড। 
গ্রাফিতিতে উঠে আসে সমাজের সমসাময়িক বিশৃঙ্খলার এক ব্যঙ্গাত্মক রূপ, যা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোন অবস্থায় বাস করছ তুমি, কী তোমার পরিণতি, কীসে তোমার পরিত্রাণ। স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের মাধ্যম গ্রাফিতি। তাই এই স্বভাবজাত ভাবনা প্রকাশের স্থান দেওয়াল। বিশ্বের সকল দেওয়াল একজন গ্রাফিতি শিল্পীর জন্য উন্মুক্ত ক্যানভাস। তাই বিভিন্ন দেশের দেওয়ালে আমরা দেখতে পাই প্রতিবাদ, মুক্তচিন্তা, দেখতে পাই সেই দেশের প্রকৃত দৃশ্য একজন গ্রাফিতি শিল্পী বা গেরিলা শিল্পীদের চিত্রকল্পের মাধ্যমে। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ফ্রান্সেÑ আটষট্টির ছাত্র বিপ্লবে।
বাংলাদেশে গ্রাফিতি আঁকার ইতিহাস বেশিদিনের নয়। ১৯৯০-এর দশকে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’ লেখাকে বাংলাদেশে গ্রাফিতি লেখার সূচনা ধরা হলেও প্রকৃত গ্রাফিতি লেখা হচ্ছে ‘সুবোধ’ ঘিরে। সেই সময় রাজধানীর আগারগাঁও এবং মিরপুরের কয়েকটি দেওয়ালে ‘সুবোধ’-এর গ্রাফিতি বাংলাদেশের প্রথম উদ্দেশ্যমূলক গ্রাফিতি বা দেওয়ালচিত্র। যা দেখে মানুষ থমকে যায়। এই গ্রাফিতির একমাত্র চরিত্র ‘সুবোধ’। এসব গ্রাফিতির একটি বিখ্যাত লেখা ছিল : ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।’
২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশের দেওয়ালে-দেওয়ালে প্রচুর গ্রাফিতি দেখা গিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তরুণেরা এসব গ্রাফিতির জন্ম দিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জুলাইয়ের প্রথমদিকে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন জনতার আন্দোলনে রূপ পায় ১৮ জুলাই। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকা-, ইন্টারনেট ব্লকআউট ও গণগ্রেপ্তারে স্তিমিত হয়ে যায় গণআন্দোলন। ঠিক সে সময় প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে উঠে আসে দেওয়াল লিখন বা গ্রাফিতি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে ২৯ জুলাই প্রথম সারাদেশে গ্রাফিতি কর্মসূচি দেওয়া হয়। স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেওয়াল লিখন আর গ্রাফিতির কাজ শুরু করে। নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে তারা এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। পুলিশ আতঙ্ক, স্বৈরাচারের দোসর ছাত্র সংগঠনের হামলা, হেলিকপ্টার থেকে গুলির শঙ্কা নিয়েই শিক্ষার্থীরা রঙ-তুলি ও ¯েপ্র নিয়ে মাঠে নামে।

যাদের আর্ট নিয়ে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না, তারাও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ লিখেছে দেওয়ালে-দেওয়ালে। সুযোগ ও হামলার আশঙ্কায় এর বেশিরভাই ছিল সাদামাটা আনাড়ি হাতের দেওয়াল লিখন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ডিজিটাল আর্ট। প্রফেশনাল গ্রাফিক ডিজাইনার ও কার্টুনিস্টরাও এতে অংশ নেন।
গ্রাফিতিগুলোতে উঠে এসেছে গণঅভ্যুত্থানের সময় রিক্সা ভর্তি লাশের করুণ চিত্র। একটি গ্রাফিতিতে দিনপঞ্জিকার মতো করে গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলো নিউজ পেপার কাটিং কোলাজ আকারে লাগানো হয়েছে; যার শেষ তারিখ দেওয়া হয়েছে ৩৬ জুলাই। একটি দেওয়ালে দেখা যায় সবুজ আইডি কার্ডের ফিতা ঝুলানো আন্দোলনে শহীদ মুগ্ধের হাসিমাখা মুখ।

যার শিরোনামÑ ‘পানি লাগবে? কারো, পানি?’ আরও ছিল- ‘হামার বেটা মারলু ক্যানে?’, ‘ছাত্র যদি ভয় পাইতো বন্দুকের গুলি, উর্দু থাকতো রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি’, ‘বায়ান্ন দেখিনি চব্বিশ দেখেছি’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তের বিচার চাই’, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘খুনি হাসিনার বিচার চাই’, ‘চেটে নয়, খেটে বড় হও’, ‘এসেছে ফাগুন, আমরা হয়েছি শত গুণ’, ‘২৪-এর গল্প, আমি নয় আমরা’, ‘পাহারায় থাকতে হবে, দুর্নীতিকে রুখতে হবে’, ‘হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, উই আর ওয়ান’, ‘দেশের কোনো ধর্ম নেই, দেশের কোনো বর্ণ নেই, দেশ আমার দেশ তোমার’, ‘ধর্ম যার যার দেশ সবার’, ‘বিকল্প কে?

আমি, তুমি, আমরা’, ‘ঘুষ চাইলে ঘুষি’, ‘শিক্ষক রাজনীতি নিপাত যাক, মেধা পাচার থেমে যাক’, ‘ছাত্ররাজনীতি নিপাত যাক, শিক্ষাঙ্গন মুক্তি পাক’, ‘চলো রাষ্ট্র সংস্কার করি’, ‘স্বাধীনতা এনেছি সংস্কারও আনব’, ‘দেশ গড়ব করছি পণ, ক্ষমতায় আজ জনগণ’, ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ কিংবা ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির!’ ‘মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি’ ইত্যাদি। এ ছাড়া ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার! রাজাকার!’ ‘নাটক কম কর পিও’ ইত্যাদির মতো শ্লেষাত্মক রাজনৈতিক গ্রাফিতিও।
২০২৪ জুলাই ও আগস্ট মাসে গ্রাফিতিতে পুরো দেশ যেন ছেয়ে যায়। শুধু ঢাকা শহর নয় পুরো বাংলাদেশের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে এই গ্রাফিতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ত্যাগ স্মরণ করতেই দেওয়ালে-দেওয়ালে এই আয়োজন করে তাদের সহযোদ্ধারা। গ্রাফিতিতে রাঙিয়ে তোলা হয় বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশের গল্প ও আন্দোলন অভ্যুত্থানের নানা ঘটনা। তুলে ধরা হয় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সমাজ বা রাষ্ট্রের কী চাওয়া।

যেখানে বাংলায় স্লোগান যেমন লেখা হয়েছে, তেমনি আছে ইংরেজিতে লেখা স্লোগান। আছে ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিও। বিদ্রোহী গানের পাশে আছে জেনারেশন জেডের প্রশংসা, ’২৪-এর গল্পের পাশে আছে ’৫২ ও ’৭১-এর ইতিহাস। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা গানের পংক্তির পাশাপাশি আছে জালাল উদ্দিন রুমির বিখ্যাত উক্তি। বিদ্রোহী স্লোগানের পাশাপাশি আছে সম্প্রীতির আহ্বান। 
প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতি বিপ্লবে দ্বিগুণ মাত্রা যোগ করে। শুধু বাংলাদেশেই নয়Ñ এরকম দৃষ্টান্ত দেখা গেছে বহু সময়ে বহু দেশে। ভারতে দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হোক কলরব’ আন্দোলন, ব্রাজিলের ক্ষুধার্ত শিশুর দেওয়ালচিত্র, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, ইসরাইল, সিরিয়ার যুদ্ধসহ আরও অনেক অস্থিরতার সময়গুলোতে ছিল গ্রাফিতির জয়জয়কার। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ে ‘ইষধপশ খরাবং গধঃঃবৎ’ শীর্ষক অসংখ্য গ্রাফিতি আমেরিকার দেওয়ালে-দেওয়ালে আঁকা হয় প্রতিবাদের অংশ হিসেবে।
দুনিয়ার প্রতিবাদী মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে এই গ্রাফিতি। সমাজের অন্যায়, অবিচার আর রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি যেন এক সৃষ্টিশীল প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সারা পৃথিবীতেই গ্রাফিতি নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের কাছে সমাদৃত হচ্ছে। তাই দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকা বড় থেকে ছোট বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে সুস্থধারার আন্দোলনের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হিসেবেই মনে করেন সবাই।

প্রগতিশীল গ্রাফিতিতে শিল্পবোধ থাকে। থাকে চিন্তা-চেতনার খোরাক। তাই গণঅভ্যুত্থানের পর সারাদেশে চিত্রিত অসাধারণ গ্রাফিতিগুলো ইতিহাসে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে দেওয়াল থেকে মুছে যাওয়া বা বিবর্ণ হওয়ার পূর্বেই সরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল ফরমেটে গ্রাফিতিগুলো সংরক্ষণ করা উচিত।

×