ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য এবং তার দুর্গা

আইয়ুব আল আমিন

প্রকাশিত: ১৫:৫৯, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য এবং তার দুর্গা

বাংলায় আধুনিক চিত্রকলা আন্দোলনে  চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। আধুনিক চিত্রকলার সাথে সাধারণ মানুষকে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যতম। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ছবির জনপ্রিয়তার বিচারেও তিনি ছিলেন তালিকার একদম সামনের সারিতে।

সামাজিক অসংগতি এবং নাগরিক হতাশা চিত্রকর বিকাশকে তাড়িত করেছে সব সময়। শৈশব, কৈশোরেই তিনি দেখেছেন শহর উপচে ওঠা উদ্বাস্তুদের।  যারা তাদের মাটি থেকে উৎখাত হয়ে অন্যদেশে মানবেতর জীবন পার করছে।  বাবার অকালে চলে যাওয়ায় তিনি ও তাঁর মা যেখানে আশ্রয় জুটিয়েছিলেন, সেও ছিল এক উদ্বাস্তু জীবন।  ফলে এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক দোলাচালে যারা দেশত্যাগী হয়েছিলেন অতি শৈশব কিংবা কৈশোরে, তাঁদের মতোই ছিলেন চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য।  বেঁচে থাকাটাই যেখানে এতো হল্লা  মাথা উঁচু করে পথচলা তো সেখানে বিলাসিতাই। সেরকম পরিমণ্ডল থেকেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি।চিত্রকলায় জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য।  জনপ্রিয়তা অনেক ছোটখাট ভুলত্রুটিক মার্জনা করে দেয়। ফলে জনপ্রিয়তার পাল্লায় কোন শিল্পীকে বিচার করাটা আদৌ কতটা সঠিক তা বিবেচনার বিষয়।  তবে, এটাও সত্যি যে জনপ্রিয়তা তো আর এমনি এমনি আসে না।  তার জন্য অবশ্যই ছিু না কিছু যোগ্যতার দরকার আছে। আর জনপ্রিয়তাও তো আসলে এক ধরণের ক্ষমতাই।

বিকাশ ভট্টাচার্যের শৈশব কৈশোর ও যৌবনের শুরুর কিছুটা কেটেছে মামার বাড়িতে। কিন্তু সেই সব দারিদ্রে ঘেরা দিনগুলির কথা ফলাও করে কখনও বলতে চাননি। তিনি তাঁর নিজের কথায় “আরও অনেক ভাগ্যবিড়ম্বিত পিতৃহীনের মতো সেই একঘেয়ে কাহিনী।’ কিন্তু নিরন্তর অসহায়তার মধ্যেও শিশুকাল থেকে মনের গভীরে তিনি লালন করে চলেছেন এক রঙ্গীন স্বপ্ন। অবশেষে যা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে শিল্পের ভরা মজলিসে। গভীর অনুভবী এই শিল্পী তার নাগরিক সত্তাটিকে অকৃপন ভাবে কাজে লাগিয়েছেন অজস্র মূর্ত বিমূর্ত ক্যানভাসে । ফলে তাঁর ছবি হয়ে উঠেছে আরও গভীর আরও জীবন্ত। 
গভীর ও নিগূঢ় আকর্ষণ আছে বিকাশের ছবিতে। তাঁর চিত্রপট মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়াতে হয় খানিকক্ষণ । কী  সম্মোহনে  দর্শককে অমন স্তব্ধ করে রাখে তার ক্যানভাস? সে কি ছবির গল্প, বিষয় ভাবনা নাকি ছবির স্বতন্ত্র আঙ্গিকে নির্মাণের আশ্চর্য মুনশিয়ানা? কোন কৌশলে বিকাশ ভট্টাচার্যের ছবি আমাদের এমন সম্মোহিত করে রাখে— এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া খুব সহজ নয়। হয়তো, শিল্পী তার মননের গহীনে এমন কিছু ধার‌ণ করতেন যা থেকে উৎসারিত হত এসব অসাধারণ সৃষ্টি। তিনি আজীবন ছিলেন মনে প্রানে এক আদ্যপান্ত বাঙালি। তাঁর ছবিগুলিও নিবিড় বাঙালিয়ানায় মোড়া। শিল্পীর চিত্রপটে বার বার ফিরে এসেছে জীর্ণ অট্টালিকা, সময়ের আঘাতে খসে যাওয়া বিবর্ণ দেয়াল, একদা অভিজাত পরিবারের অসহায়  মলিন মুখ। সেখানেই থেমে যাওয়া নয়, বিকাশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরে বেড়িয়েছে শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার নানা অলিগলিতেও। আর সবটুকু চিত্রিত হয়েছে শিল্পীর পরম মগ্নতায়, গভীর মমতার সঙ্গে।সেসব ছবিতে নগরের উজ্জ্বল অতীতের সঙ্গে  মিশেছে সমকালীন বাস্তবতা। 

আমাদের এই অঞ্চলে  অন্যতম উৎসব শারদীয় দুর্গাপুজা। দুদিনআগে বিসর্জন হয়ে গেলেও এর রেশ এখনো রয়ে গেছে বাঙ্গালির ঘরে ঘরে। বাঙ্গালির এই সার্বজনীন উৎসবকে ঘিরে বিকাশ ভট্টাচার্য বহু ছবি এঁকেছেন বিচিত্র অনুষঙ্গে। কিশোর বয়েসে চোখের সামনে শোভাবাজারের রাজবাড়ির নাটমন্দিরে গড়ে ওঠা দুর্গাপ্রতিমার নির্মাণ তাঁকে এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে আজীবন শিল্পীর চিত্রপটে দেবীর আনাগোনা চলেছে প্রায় একই ভঙ্গিতে।  শিল্পীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি চিত্র রচনা করেছে অবিরত । মন দিয়ে লক্ষ্য করেছেন, কী ভাবে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব ক্রমে বিবর্তিত হয়েছে,! আজও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলার সমাজ, ধর্মচেতনা,সংস্কৃতি, রীতিনীতি, সৌন্দর্যবোধ, ভাবাবেগ, সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে। তার সবটুকুই শিল্পীর চোখে ধরা পড়েছে গভীর মমতায় ও যত্নে।শিল্পীর চিত্রপটে ফুটে উঠেছে দুর্গাপুজোর আনন্দবিধুর মুহূর্ত। বিজয়া দশমীর অপরাহ্ণে দেবীকে বিদায় দেবার আগে, তাঁকে বরণ করে নেবার বেদনাঘন ছবি বিকাশের পটে এক আসাধারণ চিত্ররূপ ধারণ করে। শিল্পীর এমন একটি ছবিতে সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে এক বিষণ্ণ আলোর স্নিগ্ধতা। সামনের দিকে একাধিক নারীর ছায়ামূর্তি। তাঁরা একে অপরকে সিঁদুর লাগিয়ে দিচ্ছেন। সেখানেই সামনে দাঁড়ানো লাল-পেড়ে সাদা শাড়িতে আবৃত নারীর কপালে ত্রিনয়ন। তাঁকেও কেউ সিঁদুর দিচ্ছেন। দেবী যেন নেমে এসেছেন ধরনীর সমস্ত নারীদের মাঝে! 

দুর্গা চিত্রমালার অন্য একটি ছবিতে উত্তর কলকাতার এক বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর দৃশ্য- মণ্ডপের মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে অনেক নারী ও পুরুষ। তার মধ্যে হঠাৎ এক যুবতী মুখ ঘুরিয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে। যেন সয়ং দেবী দুর্গা রূপেই ওই পিছন ফিরে দেখা যুবতী । এ যেন শিল্পীর এক ইন্দ্রোজালিক সম্মোহন।

 আরেকটি ছবিতে সাদা-লাল-পেড়ে শাড়ির ঘোমটায় মাঝবয়সী মহিলা বসেছেন পুজোর আসরে। রুপালি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন তাঁর মুখমণ্ডলের কেবল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ছবিটিকে রাখা হয়েছে প্রায় মেঝের সঙ্গে, সামনে আলপনায় অলংকৃত মেঝেতে রাখা সিঁদুর মাখা ঘট, ফুল, ইত্যাদি পুজোর সরঞ্জাম- ছবি ও প্রকৃত উপকরণের চমৎকার সজ্জা।
খুবই উল্লেখযোগ্য তার আরেকটি ছবি ত্রিনয়না এক দৃপ্ত নারী। অতি সাধারণ বেশে চপ্পল পায়ে কলকাতার ট্রাম লাইনের পাশে হেঁটে চলেছে, দু’হাতে সব্জি-ভরা থলে, বাঁ হাতের মাঝেও সবুজ শস্য। 

তিনি যখন বাঙালির প্রিয় দুর্গা প্রতিমাকে নিয়ে ছবি আঁকেন, তখনও দেখতে পাই সে-দুর্গা যেন  নারী। তারা জলজ্যান্ত নাগরিক। বিকাশ ভট্টাচার্য দুর্গা সিরিজের ছবিতে দেখিয়েছেন নারীর ভিন্ন রূপ, কিন্তু তারা শুধু শহুরে নারী নয়। সে নারী কখনও সন্তানকোলে গ্রামের এক সাধারণ, দরিদ্র জনজাতি রমণী, ঝর্নার সামনে দৃপ্ত তেজে, রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়ে, কখনও সে পথের পাঁচালীর দুর্গার মতো, গ্রামে মাটির কুটিরের মাঝে সংকীর্ণ পথের এক কোণে দাঁড়িয়ে । কখনও বা গ্রামের পুকুরে আত্মবিসর্জনের প্রতিমার মতো।

এই হল তার ছবি যা বিষয়কে ছাপিয়ে দর্শকের মনের গভীরে প্রবেশ করে। চোখের দেখা আর মনের দেখা যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে। ছবি পৌঁছে যায় বাস্তবের জগত পেরিয়ে পরাবাস্তবে, কী এক চেতন অবচেতনের মাঝখানে। শিল্পী নিজেই বলেছেন—

“এমন কিছু ব্যাপার থাকে যা কারও কারও জীবনের রূপরেখাকে আছন্ন করে রাখে। যেমন আমার জীবনে দুর্গার ভূমিকা। ছেলেবেলা থেকে তার সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয়। রথের দিন থেকে শুরু করে বিজয়া পর্যন্ত ওকে নানাভাবে নানারূপে দেখেছি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওকে নিশ্চিন্দিপুরের হরিহরের কন্যা হিসাবে গড়েছেন। সত্যজিৎ রায় তাকেই পথের পাঁচালিতে নিয়ে এলেন। আমরা দেখলাম ‘চেনা লোককে অচেনা গাম্ভীর্যে’ যা দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় রূঢ়তা থেকে বাঁচতে চাইল একান্ত ভাবে আপন জীবনরসে। এ বিশ্বাস নিয়েই আমাকে বাঁচতে হচ্ছে, হবে। “দুর্গা” সেদিন হেরে গেলেও আদতে সে কখন হার মানেনি, হার মানবে না। সে দুর্গা কখনও মা, কখনও ভগ্নী, কখনও বধূ, কখনও কন্যা। আবার কখনও বা শুধু ’সে‘।

…… আমার এক এক সময় গভীর আক্ষেপ হয়, এখনকার ছেলেমেয়েরা কাশ ফুল, শিউলি চেনে না। অথচ টিউলিপ, পিটুনিয়া, চেরি সম্পর্কে তারা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে দেবে। জানি প্রকৃতির সম্পদ সর্বকালের সর্বদেশের, এর কোনও সীমানা নেই। তবু নিজস্ব মাটি বলে একটা কথা আছে। নিজের দেশ নামক একটা তীব্র আবেগ আমাদের ভরিয়ে রাখে। শরতের শিউলি অথবা কাশ ফুলের সঙ্গে আমাদের সেই নাড়ির যোগ, মাটির যোগ।”সাহিত্য শিল্পকলায় সেই নাড়ির যোগ, সেই মাটির যোগকে তীব্রভাবে ছুঁয়ে থাকা চাই।” 

দুর্গা তথা নারী ছিল বিকাশ ভট্টাচার্যের ছবির এক প্রিয়তম বিষয়। তিনি বলেছেন ‘নারীদের সম্মান না দিয়ে আমার জীবন কখনওই সম্পূর্ণ নয়’। তিনি এক চিরকালীন নারীর কল্পনা করতেন, যেখানে বাস্তব এবং পুরাণ মিলেমিশে যেত। বারাঙ্গনা থেকে দেবী দুর্গা– তাঁর ছবিতে বিভিন্ন রূপক নিয়ে মূর্ত হয়েছে। সামাজিক সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে নারীদের এই সবরকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যে অসাধারণ ত্যাগ ও সংগ্রাম, তিনি সবসময় এটি তার ক্যানভাসে নিয়ে এসেছেন। যেখানে সেই নারী কখনও  লোভ ও হিংস্রতার শিকার হয়েছেন, কখনও  দেবী দুর্গার ঐশ্বরিক শক্তি লাভ করেছেন। তাই তথাকথিত শিল্পরসিক থেকে সাধারণ দর্শক কারোরই তাঁর ছবিকে বুঝতে কষ্ট  হয়না । 

আসলে তিনি বাস্তবকেই আঁকতে চেয়েছিলেন, একইসঙ্গে চেয়েছিলেন সেই বাস্তবকে সর্বসাধারণের মাঝে প্রকাশ করে দিতে। এ যেন  এক অন্তহীন শিল্পযাত্রা!

রাজু

×