ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

কান্নার রং ছিল লাল

সনোজ কুণ্ডু

প্রকাশিত: ২১:১৪, ১০ অক্টোবর ২০২৪

কান্নার রং ছিল লাল

কান্নার রং ছিল লাল

এস্রজের সুরের মতো জলপতনের শব্দ শিবানির কানে আসে। যদিও এ শব্দের সঙ্গে তার পরিচয় নতুন নয়। কারণ তার স্বামী শিবু প্রতিদিন অন্তত একবার মানচিত্রের বুকে প্র¯্রাব করতে আসে। শিবানি রুটির বাঁটি হাতে নিয়ে নিষ্পন্দের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বিস্ময় চোখে স্বামীর এই জঘন্ন কা-ের সাক্ষী হতে হয়। তবুও স্বামীকে ঘৃণা করতে পারে না।
‘খাবারটা খেয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে যাও।’ শিবানি বিরক্তি কণ্ঠে স্বামীকে ডাকে। শিবু উ™£ান্তের মতো মধুমতী নদীর দিকে ছুটে যায়। তখনো মানচিত্রের বুকে প্র¯্রাবের বুদবুদানি। পাশের ভাঁগাড়ে চিত হয়ে পড়ে থাকা মরা বিড়ালটার সঙ্গে শিবানি নিজের জীবনের কোনো তফাত খুঁজে পায় না।
শিবু দাস ওরফে শিবু মুচির যে স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তি নেই এটা সত্য, তবে যেখানেই যাক প্রতিদিন একবার সে বাড়ি আসে। লুঙ্গিটা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মানচিত্রের কবরে তার প্রস্রাব ঢালা চাই। কাজটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত শিবু থাকে অশান্ত। চোখ দুটো হয়ে থাকে রক্ত জবার মতো লাল। হাতের কাছে যা পায় ভাঙচুর করে। শিবানিকেও লাথি-গুঁতো খেতে হয়। তার স্থায়ী ঠিকানা বলতে মধুমতীর ঘাট। দিনরাত নদীতে দলছুট কচুরিপানা, টাবুরে নৌকা ভেসে যাওয়া দেখে। শিবুর ধারণা তার মেয়ে বকুল একদিন এই নদীর পাড় দিয়ে দৌড়ে আসবে। বাবা বলে জড়িয়ে ধরবে।

শিবু বকুলকে ডাকেÑ‘আয় মা ফিরে আয়। আর অভিমান করে দূরে থাকিস না।’ পরক্ষণেই আবার উন্মাদের মতো হাসে। সারাক্ষণ মেয়ের নীল ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে রাখে। কখনো নাকের কাছে নিয়ে মেয়ের শরীরের মিষ্টি গন্ধ শোকে।
শিবুর সংসারে অভাব ছিল। অভাব নামক বেরসিক শব্দটার সঙ্গে তার জীবনের একটা যোগসূত্র আছে, কিন্তু সুখের সীমা ছিল না। শিবু ভাবে, নিজেকে যে সুখি মনে করে অভাব তার সুখ কেড়ে নিতে পারে না। সুখ হচ্ছে মনের ব্যাপার। অভাব জীবনের অংশ হতে পারে কিন্তু সুখের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে না।
গভীর বনে কাঠ কুড়িয়ে চলত শিবুর সংসার। একসময় চামড়া বিক্রি করাই ছিল তার বংশগত পেশা। পথে-পাথারে, ভাঁগাড়ে কখনো নদীর ধারে ছুরি হাতে মৃত গরু-ছাগল খুঁজে বেড়াত। তবে এ ব্যবসা ছিল নেহায়েত পেটের দায়ে। বছরের দুটো ইদ এলেই তার ব্যস্ততা বেড়ে যেত। এ অঞ্চলের পশুর চামড়া সে একাই সংগ্রহ করে নৌকা কখনো নছিমনে করে শহরে বিক্রি করত। 
শিবু একদিন বাপ-দাদার সমাধিতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে এ পেশা ছেড়ে দেয়। বনকর্তাকে ধরে বন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। সকাল থেকেই বোবা ছেলে জগাইকে সঙ্গে নিয়ে বনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত লাঠি হাতে ঘুরে বেড়ায়। শিবু লক্ষ্য করে খোদ সরকারি দলের নেতারা বনকর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গাছ কেটে নৌকা ভরে নিয়ে যায়। শিবু গোপনে কর্তৃপক্ষকে জানালে একদিন ডজনখানেক নেতা ও বনকর্মীদের পুলিশ আটক করে। শিবু এই বনের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো পাখিশিকারিও এ বনে ঢোকার সাহস দেখায়নি।
শিবু ছোট জাত বলে গ্রাম থেকে তাকে একঘরে করে রেখেছে। অথছ শিবু মুচির বউয়ের হাতে লাগানো ফুল দিয়েই অনেকের বাড়িতে পূজা হয়। গত মাঘি পূর্ণিমায় শিবু বৈষ্ণব সেবার আয়োজন করে। আঙিনার মাঝখানের একটি জলচৌকিতে রাধা-গোবিন্দকে বসানো হয়। সকাল থেকেই স্বজাতির ভক্তরা আঙিনায় বসে খোল-করতাল বাজিয়ে গুরুর শানে ভক্তিমূলক গান পরিবেশ করে। আঙিনার অন্যপ্রান্তে ভক্তদের জন্য আয়োজন হচ্ছে খিচুড়ি, মিষ্টান্ন প্রসাদ। যে ভক্তদের জন্য এত আয়োজন এখন পর্যন্ত তাদের ছায়াও দেখা গেল না। শিবানি বেশ চিন্তিত। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছায়া। শিবু তাকে আশ্বাস দেয় যে, যথাসময়ে ভক্তরা আসবে। স্বামীর মৃদু ঠোঁটের হাসি দেখে শিবানি কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়।
বেলা গড়িয়ে আসে। শিল্পীরা হরে কৃষ্ণ নাম ধরে অনুষ্ঠানের সমাপনী টানার প্রস্তুতি নেয়। শিবানির অসহায় চেহারা শিবুকে বিধ্বস্ত করে। তবুও তাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেÑ‘আসবে শিবানি, ভক্তরা ঠিক আসবে।’ 
শিবু জগাইকে নিয়ে সারি সারি কলারপাতা বিছিয়ে প্রসাদ বিতরণ শুরু করে। স্বজাতির কিছু ভক্তরা প্রসাদ গ্রহণ করার জন্য বসে পড়ে। শিবানি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছে। শিবু বৌয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করেÑ‘কেঁদো না শিবানি। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। আজ আমার প্রকৃত ভক্তরাই প্রসাদ নিতে আসবে। তৃপ্তির সঙ্গে গোবিন্দর প্রসাদ গ্রহণ করে তোমাদের আশীর্বাদ করে যাবে।’ 
শিবানি বড়ই সরলা। স্বামীর কথার গভীর অর্থ বোঝার সাধ্য তার নেই। কেবল বোবা ছেলে জগাইকে বুকে টেনে অঝোরে কাঁদে। শিবু তার বিশ্বস্ত প্রাণী ধলুকে কাছে ডাকে। প্রভুর গলার আওয়াজ শুনে ধলু বাঘের মতো গর্জন করে হাজির হয়। শিবুর পায়ের কাছে মাথা নুইয়ে যেন প্রভুর আদেশের অপেক্ষায় থাকে। শিবানি কিছুটা দূর থেকে স্বামীর ছলছলে চোখ দেখে নিজেও কাঁদে। শিবু আঙুল দিয়ে ধলুকে কলার পাতায় সাজানো প্রসাদ দেখিয়ে কানের কাছে কিছু একটা বলে। কুকুরটি আরেক দফা হুঙ্কার ছেড়ে আঙিনা ত্যাগ করে।

কী অবাক কা-! বিধাতার এই লীলা বোঝার সাধ্য কার আছে! সময় গড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পাড়ার প্রায় সব কুকুর শিবুর আঙিনায় এসে হাজির হয়। ওদের সম্মিলিত ঘেউঘেউ আওয়াজে গ্রামবাসীর বুকে কাঁপন ধরে। এই আওয়াজ যেন মুখোশপরা অমানুষের পর্দাটা খুলে দেওয়ার সংকেত। কলার পাতায় পাতায় খিচুড়ি প্রসাদ সাজানো দেখে ওদের আনন্দ হয়। সবাই একসঙ্গে লেজ নাড়িয়ে যেন শিবু মুচিকে অভিনন্দন জানায়। প্রসাদ খেতে শুরু করে। শিবু চিৎকার করে বলে, ‘খা খা, আজকের এই গোবিন্দর প্রসাদ কেবল তোদের জন্য। অমানুষের জন্য নয়!’
ভক্তরা তৃপ্তির সঙ্গে চেটেপুটে প্রসাদ খাচ্ছে। শিবানি কোনো কোনো পাতায় হাতা দিয়ে আবার প্রসাদ দিয়ে ওদের পেটভরে খাওয়ায়। আঙিনায় নতুন উৎসব শুরু হয়। মহিলারা আনন্দে উলুধ্বনি দিতে থাকে। শিল্পীরা খোল-করতাল বাজিয়ে নতুন ভক্তদের বরণ করে নিতে কৃষ্ণনাম শুরু করে। 
স্মৃতির অথৈ সমুদ্রে ডুবসাঁতার খেলতে খেলতে শিবুর ঠোঁট ভেদ হয়ে উচ্চারিত হয়Ñ‘জয় হোক ভক্তদের!’ শিবানি নিজের আঁচলে জমে থাকা একমুঠ ফুল শিবুর চোখে মুখে ছিটিয়ে ধ্যান ভাঙাতে চেষ্টা করেÑ‘কি হলো তোমার?’
‘না, গতবার বৈষ্ণব সেবায় ধলুর কা-র কথা মনে পড়ছে! শিবানির মনটাও কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। শিবুর হাত ধরে বলেÑ‘চলো না আমরা আজ ধলুর সমাধিতে ফুল দিয়ে আসি।’ শিবু ফাঁত করে দীর্ঘশ্বাস ছড়ে। বকুলগাছে পিঠ ঠেসান দিয়ে কত কি ভাবে! একসময় অতি আবেগে বকুলগাছটিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। গাছটি যে অনেক বড় হয়ে গেছে। মেয়ে জন্মানোর দিনেই স্মৃতিস্বরূপ শিবু এই বকুলগাছটি লাগায়। মেয়ের নাম রাখে বকুল। 
কাকতালীয়ভাবে বকুল ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। বকুলের দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটি শিবানিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। বকুলের চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস। শিবু মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে। গাছটি জড়িয়ে ধরতে না পাবার কষ্ট মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। শিবুর মনে হলো গাছটি থেকেও বকুল যেন বড় হয়ে গেছে। মেয়ের কথা শুনে শিবুর গর্ব হয়। তার মেয়ে শহরের কলেজে পড়তে যাবে। তার তিন পুরুষের কেউ স্কুলের গ-ি পার হতে পারেনি। বকুল শহর থেকে মানুষ হয়ে একদিন গ্রামে ফিরবে। গোটা গ্রামের মানুষ বকুলকে নিয়ে অহংকার করবে। জাত-পাত নিয়ে কেউ আর তাদের কাছে ফুঁসফাঁস করবে না।
বেলা গড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা শুরু হয়। শিবানি গোয়ালঘরের শতছিদ্র চালের ওপর পলিথিন বিছাতে ব্যস্ত। সন্ধ্যা থেকেই টিনের চালে ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি দাপিয়ে বেড়ায়। শিবানি বকুলের মাথায় তেল মেখে চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছে। জগা বকুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। বোনের জন্য সে খয়েরি রঙের ভ্যানিটি ব্যাগ, আয়না, চিরুনি, লিপস্টিক কিনে এনেছে। বোন তার শহরে পড়তে যাবে, এ কি চারটি খানেক কথা। দাদার হাতের জিনিস পেয়ে বকুলও খুশিতে ডগমগ। বোনের সঙ্গে কথা বলতে না পারার কষ্টে তার বুক ভেঙে চৌচির হয়ে আসে। ইশারায় বোনকে বুঝিয়ে দেয় তোকে অনেক বড় হতে হবে।
বাতাসের ধাক্কায় বৃষ্টি দফায় দফায় টিনের চালে আছড়ে পড়ে। ঘরের মাঝে টিনের চালের ছিদ্র দিয়ে টপটপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে যাচ্ছে। শিবানি একটা গামলা পেতে দেয়। তখনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উপস্থিতি সে টের পায়। ‘শিবুকাকা, দরজা খোলো, দরকারি কথা আছে।’ মতিন হুজুর বাইরে থেকে বলে। শিবু বালিকেচা দিয়ে জংধরা ছুরিটা শান দিতে ব্যস্ত। চামড়ার ব্যবসা অনেকটাই সে ছেড়ে দিয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে অন্য অঞ্চলে পশুর চামড়া খসাতে যায়। ইচ্ছে করলেই তো সব ছেড়ে দেওয়া যায় না।

জাতি ব্যবসা বলে কথা। তাছাড়া দুপয়সা বাড়তি আয় হলে তো আর ক্ষতি নেই। মেয়ে তার শহরে পড়তে যাচ্ছে, সামনে কত খরচা! জগা চৌকির নিচ থেকে বঁটিদাও হাতে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়। মতিন হুজুরের দ্বিতীয় ডাক শিবুর গলায় আসে। ইশারায় সে জগাকে দরজা খুলতে বলে।
মতিন হুজুর পান খাওয়া ঠোঁটে শিবানির দিকে তাকিয়ে হাসে। ভেজা ছাতাটা মেলে বারান্দায় জল ঝরাতে দেয়। মতিন হুজুর ঠোঁটে লেগে থাকা পান চেটেপুটে আয়েশি ভঙ্গিতে বলেÑ‘শুনলাম, আমাদের বকুল নাকি শহরে পড়তে যাবে?’ 
‘হ্যাঁ, যাবে তো! কালই আই এ ক্লাসে ভর্তি হতে যাবে। মেয়েটার বড় হওয়ার অনেক স্বপ্ন। মা-কালির দয়ায় লেখাপড়ার মাথাটাও বেশ ভালো। তাছাড়া আমিও চাই না, মেয়েটা গ্রামে থেকে মাথা নিচু করে চলুক। শহরে ছোট জাত বলে কেউ নিন্দা, ধিক্কার দেবে না।’
‘মেয়েকে শহরে পড়ানোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো শিবু কাকা, চেয়ারম্যান সাব ভারি কষ্ট পাবেন। বাবার নামে গ্রামে কত বড় কলেজ করেছেন। এসব তো গ্রামের ছেলেমেয়ের কল্যাণের জন্যই। আর বকুল যাবে শহরে পড়তে! এ বড় অন্যায়। 
‘এসব বাহানা ছাড়েন হুজুর। কী বলতে চান ছাপছাপ বলে ফেলুন।’ শিবুর ঝাঁঝাঁল কণ্ঠÑ
মতিন চেয়ারে রাখা গামছা দিয়ে ভেজা চুল মোছে। গলায় তার আরষ্ঠÑ‘শোনো কাকা, আজগর চেয়ারম্যান তোমাদের রক্ষক। তার ছেলে শিহাব বকুল মাকে ভালোবাসে। জানোই তো, চেয়ারম্যান সাহেবের পরপর দুটি ছেলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সেই শোক আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শিহাব তার কলিজার টুকরা। ক্ষমতা থাকলে আকাশের চাঁদ ছেলেকে এনে দিত।’ 
‘মুখে লাগাম দেন মতিন হুজুর। তিনি আজগর না অজগর চেয়ারম্যান আমাকে চেনাতে আসবেন না। আর তিনি আমাদের রক্ষক হতে যাবেন কেন? রক্ষক তো স্বয়ং ঈশ্বর! দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে হিন্দুগো ঘরের মেয়ের দিক নজর পড়ল কেন? তারপর আমরা ছোটজাত।’
‘এমন কথা বলে আমাদের কষ্ট দিয়ো না শিবু কাকা। ভালোবাসার কাছে কি আর জাত-পাত আছে। আমাদের বকুল মায়ের মতো এই তল্লাটে একটা মেয়ে খুঁজে দেখাও দেহি!’
‘শিবুর আক্রমণাত্মক গলা। ‘আমার মেয়ে সম্পর্কে একটা কথা বললেÑ’
‘এত উত্তেজিত হওয়ার দরকার নেই কাকা। বিষয়টা ভেবে দেখো। সবার জন্য মঙ্গলই হবে। চেয়ারম্যান সাহেব তোমাদের আত্মীয় হলে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে পারবে। মানুষ গর্বের সুরে বলবে, ঐ দেখো, চেয়ারম্যান সাহেবের বিয়াই যাচ্ছে! তাছাড়া আমাদের দেশে থাকতে হলে আজগরদের খুশি করেই তো তোমাদের থাকতে হবে!’
শিবুর হাতের শান দেওয়া ছুরিটা হারিকেনের আলোতে চকচক করে ওঠে। ছুরিটা হাতের তালুতে থুতু দিয়ে ঘষে আরও ধারালো বানাতে চেষ্টা করেÑ‘চুপ করুন আপনি। এই শিক্ষা দেন ছাত্রদের? আমার দেশ, তোমার দেশ আবার কি ভাষা? 
দুদিন পর কালিসন্ধ্যায় সদানন্দ মালোর ভেঁসালে একটি নিল রঙের ওড়না উঠে আসে। খবর পেয়ে শিবানি ভেঁসালের কাছে ছুটে যায়। বকুলের ওড়না চিনতে তার অসুবিধা হয় না। পেছন থেকে শিবু চিলের মতো ছোঁ মেরে মেয়ের ওড়না গলায় পেঁচিয়ে দৌড়ে যায়। সেই থেকে মেয়ের ওড়না সে গলায় পেঁচিয়ে রাখে। কখনো বুকে চেপে ধরে। নাকের কাছে নিয়ে মেয়ের শরীরের গন্ধ নেয়। প্রতিদিন ওড়না নিয়ে নদীর ঘাটে এসে বকুল বলে চিৎকার করে। ওই গগণবিদারী চিৎকার নদীর ওপারে গিয়ে প্রতিধ্বনি হয়। 
শিবু মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর জগাই বন দেখাশুনা করে। একদিন বনকর্তা অফিসের লোকজন নিয়ে বন পর্যবেক্ষণে আসেন। তারা বনের ভেতর ঢুকে দেখে, তাদের বিশ্বস্ত শিবু মুচির ছেলে জগাই একটি আমগাছ কেটে কাঠ খ-খ- করছে। এ দৃশ্য দেখে বনকর্তা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। জগার হাত বেঁধে থানায় নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়। কর্তার পায়ের ওপর লুটে পড়ে জগা। অনুনয়-বিনয় করে অনেককিছু বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার বোবাভাষা কেউ বুঝতে পারে না। শিবানি ওদের চলার পথে আগলে দাঁড়ায়। একপর্যায় বনকর্তার পায়ের ওপর মাথা ঠুঁকেÑ‘দোয়াই কর্তা, আজকের দিনে অন্তত জগাকে ধরে নিয়ে যাবেন না। আমার জগাকে আজ যে বড় প্রয়োজন। এই কাঠগুলোও আমাদের দিতে হবে!’
শিবানির কথা শুনে বনকর্তা হেসে ওঠেন। রাগে তার শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছেÑ‘এসব কী আজগুবি কথা বলছ তুমি? তোমার ছেলে বনের গাছ কেটে অপরাধ করেছে। তাকে শাস্তি পেতেই হবে। তুমি আবার নির্লজ্জের মতো চুরি করা কাঠগুলোও চাইছোÑছি! ছি! এ কী মামাবাড়ির আবদার হে? রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তার শাস্তি কতটা ভয়ংকর হয় তা তুমি নিজ চোখেই দেখবে। তোমরা যে ছোটজাত, তার পরিচয়টা সত্যিই আজ দিলে!’
‘হ্যাঁ কর্তা, আমরা ছোটজাত ঠিকই, তবে চোর নই। মিথ্যাও বলি না। ছেলে এবং কাঠ দুটিই আমার প্রয়োজন। কারণ বাবার মুখাগ্নি করার জন্য ছেলেকে যেমন চাই, তেমনি শিবু মুচির সৎকার করতে ওই কাঠেরও প্রয়োজন। মানুষটি মৃত্যুর আগে একটাই শেষ কথা বলে গেছেÑ‘যে সমাজে মানুষ নেই, সেখান থেকে তোমরা বহুদূর চলে যেও শিবানি।’
বনকর্তা নিজে জগার হাত থেকে বাঁধন খুলে দেন। শিবানি বৌদির কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন।

×