ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

মুক্ত গদ্য ॥ কবিতা-কথা

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

প্রকাশিত: ২১:১০, ১০ অক্টোবর ২০২৪

মুক্ত গদ্য ॥ কবিতা-কথা

কবিতা-কথা

সার্থক কবিতার শরীরতন্ত্রের কথা যদি বলি, তাহলে সর্বাগ্রে বলতে হবে শব্দের কথা। এই শব্দই হলো কবিতার প্রাণভোমরা। শব্দের যথাযথ ব্যবহারের ওপরই কবিতার লাবণ্য যথেষ্ট মাত্রায় নির্ভরশীল। কবিতার সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে। তাই কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের যথার্থতা অপরিসীম। এই শব্দেরা আবার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। এই যেমন অপরিহার্য শব্দ, তাৎপর্যময় শব্দ, ব্যঞ্জনাময় শব্দ, উপমান এবং উপমিত শব্দ ইত্যাদি।

যারা কবিতার গতি-প্রকৃতি, ভাব, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি গভীর ও সার্থকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই কবিতায় শব্দ প্রয়োগ করতে হবে অত্যন্ত সাবধানে এবং সচেতনভাবে। শব্দই কবিতার ভাবকে প্রাণদান এবং গতি সঞ্চার করে। অহেতুক শব্দ বা মেদ কবিতায় ব্যবহৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। 
কবিতার যথার্থ শব্দের ব্যবহার নিশ্চিত করার পরই আসে বাক্যালংকার। এই বাক্যালংকারই হলো কবিতার মূল চালিকাশক্তি। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেমন খুশি বাক্য ব্যবহার করে থাকি। কোনো বিশেষ চিন্তা ভাবনা করি না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে মুখে বলা এবং কবিতায় বলা এক কথা নয়। সার্থক কবিতার জন্য সার্থক বাক্য অপরিহার্য। বাক্য গঠনজনিত ভুল থাকলে সার্থক কবিতা লেখা কোনোদিনই সম্ভব নয়।

একটি সার্থক বাক্যের আবশ্যিকভাবেই তিনটি গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়। এই যেমন : আকাক্সক্ষা, আসক্তি এবং যোগ্যতা। এই তিনটি গুণের কোনো একটির অভাবে বাক্যটি ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে। আর ত্রুটিপূর্ণ বাক্যের কবিতা সার্থক কবিতা হয়ে উঠবে না এটা বলাই বাহুল্য। এই যেমন : পাখি আকাশে ওড়ে না বলে যদি আমরা বলি গরু আকাশে ওড়ে তাহলে বাক্যটি নিঃসন্দেহে যোগ্যতা হারাবে। 
শব্দের যথার্থ ব্যবহারের পরেই আসে কবিতার ভাব বা চিত্রকল্প। এ ক্ষেত্রে কবিতার ভাব অবশ্যই সার্বজনীন হওয়া উচিত। ব্যক্তিকেন্দ্রিক লেখা হলেও তা এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত যাতে করে কবিতায় ব্যবহৃত চিত্রকল্পটি প্রায় সকল পাঠকের জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পাঠকের দিব্য চোখের সামনে চিত্রকল্পটি ভাসতে থাকে। যদি এমন না হয় তাহলে কবিতার আবেদন পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দিতে ব্যর্থ হবে। মূলত চিত্রকল্প পাঠককে দৌড়ের ঘোড়ার মতোন এক মোহময় স্বপ্নিল আবেশে তাড়িত করবে।

ভাবাবেগে হৃদয় মন মনন আন্দোলিত করবে। তবে কবিতার সার্বিক চিত্রকল্পের পাশাপাশি শব্দকল্পও যথার্থ হওয়া উচিত। তাতে করে পাঠক শব্দে শব্দে ভাবনার এক বর্ণিল জগতে ঘুরে আসতে পারে। শব্দের রূপ, রঙ, রস এবং স্পর্শে পাঠক মন সদা ভিন্ন আমেজের স্বাদ পায়। 
সার্থক কবিতার আরও একটি বিশেষ গুণ বৈশিষ্ট্য হলো, ছন্দ এবং ছন্দরীতি। আমরা যারা কবিতা লিখি তারা অনেকেই কম-বেশি ছন্দের অক্ষর জ্ঞান জানা আছে। আবার অনেকে এমনও আছেন যে ছন্দ এবং ছন্দরীতি সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। তবুও বছরের পর বছর কবিতা লিখে যাচ্ছেন। কোনোদিন জানার চেষ্টাও করেননি। প্রকৃতপক্ষে ছন্দের ন্যূনতম জ্ঞান ছাড়া একটি সার্থক কবিতা লিখতে পারা সহজ কাজ নয়।

বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত যতগুলো কবিতা সার্থক হয়েছে; প্রতিটি কবিতা পড়ে দেখুন অবশ্যই কোনো না ছন্দের মধ্যে পড়ে। কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত যে কোনোটির মধ্যে পড়বেই। মূলত ছন্দজ্ঞানে জ্ঞানী কবির কবিতাও সমৃদ্ধ হবে, ধনী হবে এটা অনায়েসেই বলে দেওয়া যায়। 
কবিতার যথার্থ ভাবের স্ফুরণ এবং পাঠকের ভাবনায় ভিন্নমাত্রা আনয়ন করার জন্য আমরা সাধারণত উপমা, অলংকার, অনুপ্রাস ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে থাকি। কিন্তু অনেকেই উপমা, অলংকার এবং অনুপ্রাস কাকে বলে তাই জানি না। জানি না উপমান এবং উপমিত। ফলশ্রুতিতে এসবের সঠিক ব্যবহারে আমরা প্রায়শই ভুল করে থাকি। অসামঞ্জস্য উপমা, অলংকার এবং অনুপ্রাসের ব্যবহার করার ফলে কবিতা হয়ে ওঠে সাক্ষাৎ দুর্বোধ্যতা দোষে দুষ্ট, অগোছালো, যা পাঠ করার সময় বোদ্ধা পাঠক মাত্রই তার হৃদয়ে একটি বড় ধাক্কা খান।

ফলশ্রুতিতে সেই সব কবিতা কেতাদুরস্ত হয় না। সার্থক কবিতা তো আরও অনেক দূরের বিষয়। মোটকথা এসব বিষয়ে আমাদের আরও ভালোভাবে যেমন জানা উচিত; তেমনি আমাদের প্রয়োজন কিছু ব্যাকরণগত জ্ঞান। বাংলা ব্যাকরণের যথার্থ জ্ঞান ছাড়া আপনার- আমার লেখায় ভুল-ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। 
আমাদের মনে রাখতে হবে সার্থক কবিতার আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তুর চমৎকারিত্ব এবং বৈচিত্র্য কবিতাকে পাঠকের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করায়। তবে সার্থক কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই। হতে পারে প্রেমের কবিতা। আবার হতে পারে নস্টালজিক, স্বদেশপ্রেম, মিলন কিংবা বিরহ, হতে পারে প্রকৃতির কবিতা, মানবতার কবিতা, বিদ্রোহী কবিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, তা অবশ্য অবশ্যই সমসাময়িক হলে ভালো হয়। যে কবিতা সময়কে ধারণ করে, লালন করে, পালন করে সেই কবিতা অবশ্যই সচেতন পাঠকের সপ্রশংস দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। 
সর্বোপরি আমাদেরকে কবিতা লেখায় যতœশীল হতে হবে। আরও আন্তরিক হতে হবে। বাংলা সাহিত্যসহ বিশ্বসাহিত্য পড়তে হবে। নিজেকে খুব বড় কবি না ভেবে কবিতার একজন ছাত্র ভাবতে হবে। আপনার সব কবিতা-ই সার্থক হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সারাজীবন কবিতা লিখে যদি আমার একটি কবিতা অথবা একটি কবিতার অংশ বিশেষ সুধীমহলে স্বীকৃতি লাভ করে তাহলেই লেখক জীবন সার্থক। বিখ্যাত কবিদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমরা তাদের কয়টি কবিতার নাম বলতে পারি? হয়তো কারো একটি, কারো দুটি, তিনটি কিংবা বড়জোর চার কি পাঁচটি! ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব কিংবা পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি....এই রকম লাইন খুব বেশি দরকার নেই। এক, দুটি হলেই যথেষ্ট!
প্রিয় পাঠক, হতাশা নয়। আসুন, আশাবাদী মানুষ হই। আসুন, কবিতাকে ভালোবাসি। ভালোবেসে কবিতা লিখতে থাকি। লিখতে লিখতে একদিন দেখবেন আপনার আমার কলম দিয়েও সার্থক কবিতার জন্ম হয়েছে।

×