ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

আহমদ ছফার কালজয়ী সৃষ্টি

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ৩ অক্টোবর ২০২৪

আহমদ ছফার কালজয়ী সৃষ্টি

মরন বিলাশ

মৃত্যুর দোরগোড়া অবধি না গিয়েও একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মনের অনুভূতি এত সাবলীল ও সূক্ষ্ম করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তোলা, নিজ মানস দিয়ে অপরের জীবন এত গভীরভাবে উপলব্ধি করা শুধু আহমদ ছফার দ্বারাই হয়তো সম্ভব।
‘মরণ বিলাস’ আহমদ ছফার একটি রাজনৈতিক উপন্যাস বলা যায়। এই উপন্যাসটিতে যেভাবে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুশয্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বেশ সূক্ষ্ম; এবং তাতে বিসভিন্ন মতবাদ, ঘটনা এবং মনস্তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
এবং সেই চিত্রপটে মূল ভূমিকায় আছেন ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুমুখী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফজলে ইলাহি। আর, তাঁর শেষ শয্যায় বসে অথবা কখনো দাঁড়ায়ে আছে একজন পাতিনেতা ও রাষ্ট্রপতির সুদৃষ্টিতে আসতে ব্যাকুল মওলা বক্স। ‘মরণ বিলাস’ উপন্যাসটি পুরটাই মূলত মন্ত্রী ফজলে ইলাহী ও মওলা বক্সের মধ্যে কথোপকথন। শয্যাশায়ী মন্ত্রী চায় তার জীবনের যত গোপন অপকর্ম আছে তা অন্তত পৃথিবীর একজন মানুষকে বলে যেতে পারলে তার আর নিজের জীবনকে বৃথা মনে হবে না।

তাই, মওলা বক্সকে বলে যেতে চায় তার সব গোপন পৈশাচিক কর্মকা-। তাদের কথোপকথনে, তর্কে-বিতর্কে, পারস্পরিক স্তুতি ও নিন্দায়, কখনো স্বগতোক্তিতে, কখনো সুস্পষ্ট উচ্চারণে, কখনো শালীন বাক্যে, কখনো খিস্তিতে, কখনো তীব্র ঘৃণায়, কিংবা কখনো বিনম্র শ্রদ্ধার অনুভূতিতে পেরিয়ে যায় হাসপাতালের শেষ রাতটি। আসে নতুন ভোর। কিন্তু সেই ভোরটি অবশ্যই অন্যরকম হয়। 
জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফজলে ইলাহী চান একজন শ্রোতা, যে কোনো বাধা না দিয়ে শুধু তার কৃতকর্মের ফিরিস্তি শুনে যাবে। তার অপকর্মের কথা শুনে মওলা বক্স নিজের মধ্যে যুদ্ধ করছিল। ভাবছিল তার সঙ্গেই কেন এসব হলো? কেন তাকেই এসব শুনতে হলো। সে ভাবতে পারছিল না মন্ত্রী মারা যাবার পর তার জীবনে কি হবে। সে নিজেও অনেকখানি মন্ত্রীর মতো চিন্তা রাখা সত্ত্বেও মেনে নিতে পারছিল না ‘মানব সন্তানের রূপে, এই রাক্ষস বৃত্তান্ত!’ তারপর মন্ত্রীর শেষ নিঃশ্বাসের আগে মন্ত্রী যখন তাকে বলল একটা আলো এসে গ্রাস করছে তাকে; আর তারপরেই নিথড় মন্ত্রীর দেহ।

স্বর্গ আর নরকের চিরন্তন সহাবস্থানে মানবজীবন, ‘মরণ বিলাসে’র মুখ্য উপজীব্য। ফজলে ইলাহী মূলত তার জীবনের তিনটি বিশেষ ঘটনা বর্ণনা করেন মাওলা বক্সের কাছে। কাম, লালসা, ঘৃণা আর অবিবেচনার মোড়কে আবৃত এই ঘটনাগুলো যেন মানব জীবনের চিরন্তন কদর্যতারই প্রতীক। প্রতিটি পাপকেই ফজলে ইলাহী পাশ কাটিয়ে এসেছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, জীবনে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছেন, কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে তার সকল অর্জনের নিষ্ফলতা তার সামনে প্রকট।

আহমদ ছফা অতি সন্তর্পণে কথোপকথনের ছলে কাহিনী প্রবাহ এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনোই পাঠককে বিচারকের আসনে বসাতে চাননি। ফজলে ইলাহীর উক্তির মাধ্যমে তাই তিনি পাঠককে যেন একপ্রকার সাবধানই করে দিয়েছেন-
‘উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, শুনে রাখো, মানুষ মানুষের কর্মের বিচারক হতে পারে না। তারপরেও তোমার মন যদি কৈফিয়ত দাবি করে বসে, অবশ্যই আমারও কিছু বলার থাকবে।’ লেখক পাঠককে তার কাহিনীর ও কাহিনীর ভেতরের কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি পাঠককে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, ভাবতে উৎসাহিত করেছেন, একইসঙ্গে অন্ধভাবে বিচার করতে বাধা দিয়েছেন।

মূল তিনটি গল্পের বা ঘটনার বাইরে আরও একটি ঘটনা ছিল ফজলে ইলাহীর জীবনে, যা তাকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাপবোধের মধ্যেও মুক্তির আলো দেখায়। একজন পাপিষ্ঠ মন্ত্রী নিজের পাপ রোমন্থনের ছলে যেন তার বহুকষ্টে লভিত জীবনবোধ তার সেবকের ভেতরে ছড়িয়ে দিলেন। মন্ত্রী ও সেবক দুজনের জন্যই সে রাত শেষের ভোরটি অন্যরকম ভোর ছিল।

একইসঙ্গে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎপদতা, প্রভূত রিপু ও মানবীয় সীমাবদ্ধতাসমূহ অবজ্ঞা করে মানুষ হিসেবে আমাদের যে অপার সম্ভাবনা, তাকে জড়িয়ে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে ‘মরণ বিলাস’ আহমদ ছফার শ্রেষ্ঠতম কীর্তিগুলোর একটি। আহমদ ছফা তার সূক্ষ্ম জীবনবোধ ও মানব দর্শন প্রকাশ করেছেন ‘মরণ বিলাস’-এ।

×