মর্গ স্ট্রিটের হত্যা রহস্য
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দলটা যখন ওপরে ওঠে, তখন তাদের পাশ দিয়ে কেউ নেমে যাবেÑ সেটাও কোনোমতে সম্ভব নয়।
ডাক্তার পল দুমা জানিয়েছেন, খুব ভোরে তিনি মৃতদেহ পরীক্ষা করতে যান। তখন দুটো মৃতদেহ বিছানার উপরে শোয়ানো ছিল। দুটো দেহই ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত দেখেছেন তিনি। মেয়ের গলায় আঙুলের ছাপ দেখেছেন। তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। মায়ের ডান হাত আর ডান পায়ের হাড়গোড় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। বাঁ পজরের হাড়ও ভাঙা। শরীরের সর্বত্র আঘাতের চিহ্ন। আঘাত দেখে মনে হয় খুব শক্তিশালী কেউ ভারি কাঠ, চেয়ার কিংবা ভোঁতা কোনো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছে বারবার। মাথাটা আলাদা হয়ে গেছে। সেখানেও আঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন। ধারালো ছুরি কিংবা ধাতব কোনো অস্ত্র দিয়ে মহিলার গলা কাটা হয়েছে।
পত্রিকা বলছে এ রকম ভয়ঙ্কর জোড়া খুনের ঘটনা প্যারিসে আর ঘটেনি। প্যারিসের পথে, ঘাটে, রেস্তোরাঁয় সর্বত্র এখন এই আলোচনা। তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ব্যাংকের কেরানি এডলফ বোঁ-কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের সংবাদটা পড়ার পর দুপঁ আমাকে জিজ্ঞেস করলোÑ এই হত্যাকা- সম্পর্কে আমার কী ধারণা? প্যারিসের আর সব বাসিন্দার মতো আমারও মনে হচ্ছিলÑ এটা এমন এক রহস্য, যার কুলকিনারা করা বোধহয় সম্ভব না।
দুপঁ বললো, ‘চলো আমরা নিজেরা সরেজমিনে দেখে আসি জায়গাটা। যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই কেরানি এডলফ বোঁ আমাকে একবার সাহায্য করেছিলÑ লোকটার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। পুলিশ প্রধান আমার পরিচিত, অনুমতি পেতে সমস্যা হবে না।’
অনুমতি পাওয়া গেল, আমরা দেরি না করে মর্গ স্টিটে চলে গেলাম। বাড়িটা খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হলো না। অনুমতির চিঠি দেখাতেই পাহারায় নিযুক্ত গার্ড আমাদের উপরে নিয়ে গেল। সেখানে পাশাপাশি শুয়ে আছে দুটো মৃতদেহ। পত্রিকায় যেমন পড়েছি, তেমনই এলোমেলো দেখলাম সারা ঘর। নতুন কিছুই আমার চোখে পড়লো না। দুপঁ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখলো। মৃতদেহ দুটোও পরীক্ষা করলো মনোযোগ দিয়ে।
সব ঘর চেক করলো সে। বিশেষ করে বড় ঘরের জানালা দুটো অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলো। শেষে আমরা গেলাম বাড়ির পেছনের উঠোনে। উঠোন থেকে জানালা দুটো দেখা যায়। অনেক সময় নিয়ে জানালা এবং জানালার কিছুটা দূর দিয়ে নেমে যাওয়া পাইপ গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলো দুপঁÑ কী যেন একটা কুড়িয়ে পকেটে পুরলো। এসব করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমরা বাড়ি ফিরলাম। ফেরার পথে একটা দৈনিক পত্রিকা অফিসে ঢুকলো সে দুচার মিনিটের জন্য।
সেদিন এই মার্ডার কেস নিয়ে আর একটা কথাও বললো না দুপঁ। ওর এ রকম মুড দেখে অভ্যস্ত আমিÑ এই নীরবতার অর্থ সে তথ্যগুলো নিয়ে মনের ভেতরে নাড়াচাড়া করছে, ভাবছে। পরদিন দুপুরে হঠাৎ দুপঁ আমাকে প্রশ্ন করলো, গতকাল অস্বাভাবিক কিছু আমার চোখে পড়েছে কিনা?
আমি বললাম ‘পত্রিকা থেকে যা জেনেছি, তার বাইরে তেমন কিছু আমার চোখে পড়েনি।’
‘পত্রিকার কথা বাদ দাও।’ দুপঁ বললো। ‘ঘটনার ভিতরে যে অস্বাভাবিকতা আছে, তা ওরা ধরতে পারেনি। পুলিশও ঘটনার নৃশংসতা দেখছে, নিষ্ঠুরতা দেখছেÑ কিন্তু এসবের ভেতরে ব্যতিল্ডমী যে ব্যাপারগুলো আছে, তা পুলিশের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছেÑ অথবা সেটাকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এখানে দেখতে হবেÑ অস্বাভাবিক কী ঘটেছে, যা অন্য কোনো খুনের ঘটনায় দেখা যায় না। তাহলেই রহস্যের সমাধান পেয়ে যাবো আমরা।’ আমি আরও কিছু শোনার আশায় বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
‘একজনের অপেক্ষা করছি আমরা।’ দরজার দিকে দেখিয়ে বললো দুপঁ। ‘খুব সম্ভব লোকটা নির্দোষ। তবে ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সে জড়িত। আশা করি আমার অনুমান ঠিকÑ এই অনুমানের উপরেই নির্ভর করছে সবকিছু। লোকটা আসতে পারে, আবার নাও আসতে পারে। যদি আসে, তাহলে তাকে আটকাতে হবে। এই নাও পিস্তল, সঙ্গে রাখো।’
হাত বাড়িয়ে পিস্তলটা নিলাম। যদিও দুপঁ কী বলছে তার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। তবে আগেও দেখেছি, এ রকম সময় দুপঁ আপন মনে কথা বলতে থাকে। এখনো তাই করছে সেÑ যদিও আমাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন নিজের সঙ্গে মনোলগ চলছে তার।
‘এ বিষয়ে আমরা এখন নিশ্চিতÑ’ বলে চললো দুপঁ, ‘সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে যে দুটো কণ্ঠস্বর শোনা গেছে, তা মা-মেয়ের নয়। এবার মেথড অব এলিমিনেশন ব্যবহার করা যাক। মা মেয়েকে হত্যা করে তারপর নিজে আত্মহত্যা করেছেনÑ এই সম্ভাবনা আমরা নাকচ করে দিতে পারি। কেননা জবানবন্দি থেকে জানা যায় মা-মেয়ের সম্পর্ক ভালো ছিল। এ ছাড়াও নাকচ করার বড় একটা কারণÑ মেয়েকে চিমনি দিয়ে ওভাবে ঠেসে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া মাদাম এসপানায়ার শক্তিতে কুলোবে না।
তাছাড়া মাদামের শরীরে আঘাতের যে চিহ্ন দেখা গেছে, সেভাবে নিজেকে আঘাত করাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই এটা নিশ্চিতÑ খুনটা হয়েছে অন্য কারও দ্বারা। এই অন্যদের কথোপকথন শুনেছে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা মানুষেরা। তাদের জবানবন্দি থেকে জানা যায় দুটো কণ্ঠস্বর শুনেছে সবাই। এই দুই কণ্ঠস্বর সম্পর্কে যা বলছে তারা, তার ভেতর অস্বাভাবিক কিছু তুমি লক্ষ্য করেছো?’ আমাকে প্রশ্ন করলো দুপঁ।
‘সবাই বলছে প্রথম কণ্ঠস্বর, অর্থাৎ গম্ভীর কণ্ঠস্বরটা একজন ফ্রেঞ্চম্যানের।’ আমি জবাব দিলাম। ‘কিন্তু দ্বিতীয় কণ্ঠস্বর অর্থাৎ তীক্ষè স্বর নিয়ে প্রচুর মতভেদ আছেÑ একেকজন একেক কথা বলছে। একজন তো কণ্ঠস্বরটাকে তীক্ষè বলতেও নারাজÑ তার মতে স্বরটা কর্কশ।’
‘ঠিক বলেছো, প্রথম কণ্ঠস্বরের বেলায় সবাই একমত,’ দুপঁ বললো। ‘দ্বিতীয় কণ্ঠস্বর নিয়ে দ্বিমত করছে সবাই। তবে আসল পয়েন্টটাই তুমি মিস করেছোÑ সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছেÑ শুধু দ্বিমতই করছে না তারা, দ্বিমতের মধ্যেও তাদের কথায় এক জায়গায় মিল আছে। জবানবন্দি যারা দিয়েছে, তাদের মধ্যে একজন ইংলিশম্যান, একজন ইতালিয়ান আছেÑ এছাড়াও আছে (চলবে...)
স্প্যানিয়ার্ড, হল্যান্ডার এবং ফ্রেঞ্চম্যান। সবাই বলছে দ্বিতীয় কণ্ঠস্বরের লোকটা যে ভাষায় কথা বলেছেÑ সেই ভাষাটা তাদের অচেনা, অজানা।
এইখানেই আসল মজা। ফ্রেঞ্চম্যান বলছে ভাষাটা স্প্যানিশ। অথচ স্প্যানিশ যার মাতৃভাষা, সে বলছে ভাষাটা ইংলিশÑ যদিও ইংরেজি সে জানে না। আবার ইংলিশম্যানের মতে ভাষাটা জার্মানÑ অথচ সে জার্মান ভাষা বলতে পারে নাÑ উচ্চারণ শুনে তার এ রকম মনে হয়েছে। ওদিকে আবার ইতালিয়ান ভদ্রলোক কী বলছে? তার মতে ভাষাটা রাশিয়ানÑ সে কিন্তু কোনো রাশিয়ানের সঙ্গে কোনোদিন কথা বলেনি। সব শেষে দ্বিতীয় একজন ফ্রেঞ্চম্যান বলছেÑ তার মতে ভাষাটা ইতালিয়ান।
এটা সত্যি বিস্ময়কর যে পাঁচ ভাষার পাঁচজন মানুষ শুনেও বলতে পারছে না দ্বিতীয় কণ্ঠস্বরের ভাষাটা কোন্ ভাষা। একটা শব্দও তারা বুঝতে পারেনি। এদের মধ্যে একজন ইন্টারেস্টিং একটা পয়েন্ট উল্লেখ করেছেÑ তার মনে হয়েছে কণ্ঠস্বরটা তীক্ষè নয়, কর্কশ। এসব থেকে আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। সেই সিদ্ধান্তের বিষয়ে এই মুহূর্তে আর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না। তার চেয়ে চলো কল্পনায় আমরা আবার একবার ঘটনাস্থলটা ঘুরে আসি।
কী খুঁজবো সেখানে আমরা? খুঁজবো খুনিদের পালানোর পথ। কোন্ পথ দিয়ে পালালো খুনিরা? চিমনি দিয়ে একটা বিড়ালও যেতে পারবে না, কাজেই চিমনি বাদ। ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, তাছাড়া ছাদের দরজাও বন্ধ দেখেছি আমরাÑ কাজেই চিলেকোঠা দিয়ে ছাদ হয়ে পালাবেÑ সে সম্ভাবনা বাদ হয়ে গেল। এবার আসি যে ঘরে মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে সেই ঘর এবং পাশের বড় ঘরটার কথায়। খুনিরা এই দুটো ঘরে ঢুকেছে নিশ্চিত।
বড় ঘরটায় দুটো জানালা আছে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো। এই জানালা দুটোই আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। একটা জানালা ফার্নিচার দিয়ে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গেছে। অন্য জানালা বরাবার খাটটা রাখা। খাটের মাথা জানালায় প্রায় ঠেকে আছে, মাঝখানে একটুখানি ফাঁক। সেইখানে জানালার ছিটকিনি। ছিটকিনিটা আমি খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করেছি। এখানেই পলায়ন পথের রহস্য লুকিয়ে আছে। ছিটকিনিটা অটোলক পদ্ধতিতে কাজ করে, একটা স্প্রিংয়ের সাহায্যে। ধরা যাক জানালা দিয়ে কেউ বাইরে চলে গেল, তারপর ওপাশ থেকে পাল্লাটা ধাক্কা দিলÑ তাহলে ছিটকিনি অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক এটাই ঘটেছে।
এই অনুমান সত্য কিনা জানার জন্য আমরা এরপর উঠোনে গেলাম। সেখানে কী দেখলাম? বজ্র-বিদ্যুৎ থেকে রক্ষা করার জন্য সব বাড়ির ছাদে লাইটনিং রড থাকেÑ এই বাড়িতেও আছে। মোটা একটা লাইটনিং রড নেমে এসেছে এই বাড়ির ছাদ থেকে মাটিতে। রডটা গেছে জানালা থেকে বেশ খানিকটা দূর দিয়ে। খোলা জানালা থেকে সরাসরি কেউ রডটার নাগাল পাবে না। কিন্তু যদি কেউ জানালার পাল্লা পুরো খুলে দেয়, তাহলে রড থেকে জানালার দূরত্ব কমে যাবে। সেক্ষেত্রে নাগাল পাওয়া সম্ভব। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো জানালার পাল্লায় খড়খড়ি দেওয়া আছে। খড়খড়ি ধরে ঝুলে, পাল্লায় দোল খেয়ে একটু কসরত করলেই রডের নাগাল পাওয়া সম্ভব। তবে, এ কাজের জন্য খুব সাহসী মানুষ দরকার। অথবা যদি...
আচ্ছা, এখন তোমাকে আবার গুরুত্বপূর্ণ দুটো পয়েন্ট মনে করিয়ে দিইÑ সবাই বলেছে দ্বিতীয় কণ্ঠস্বরটি ছিল তীক্ষè, একজনের মতে তা ছিল কর্কশ এবং তার ভাষা কেউই বুঝতে পারেনি। ঠিক তো?’
আমার বন্ধু দুপঁ কিছু একটা ইঙ্গিত করছে বুঝতে পারছিÑ কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না, কী বোঝাতে চাইছে সে? দুপঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলতে থাকলো। ‘একটা জিনিস লক্ষ্য করো বন্ধুÑ’ দুপঁ বলছে, ‘আমি কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে খুঁজতে ফ্ল্যাটে প্রবেশের পথও পেয়ে গেছি। এখন চলো আমরা আবার কল্পনায় ফ্ল্যাটের ভেতরে যাই। কী দেখবো সেখানে? সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ব্যাংকার মিগনড তার জবানবন্দিতে বলেছে মা-মেয়ে খুন হওয়ার তিনদিন আগে মাদাম এসপানায়া চার হাজার ফ্রাঁ ব্যাংক থেকে তুলেছেন।
এই কোইনসিডেন্স থেকেই প্রশ্নটা এসে যায়Ñ চুরি-ডাকাতির মোটিভ কিনা? সন্দেহের শিকার হয়েছে কেরানি এডলফ বোঁ। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ আমরা দেখছি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে চার হাজার ফ্রাঁ সোনার মুদ্রা। চুরি-ডাকাতি মোটিভ হলে সোনার মুদ্রা পড়ে থাকতো না। কাজেই চুরি-ডাকাতির মোটিভ বাতিল হয়ে যায়।
তাহলে কী দাঁড়ালো? আমরা এমন এক খুনের তদন্ত করছিÑ যেখানে মোটিভ নাই, যেখানে অস্বাভাবিক একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেছে এবং অস্বাভাবিক শক্তির অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছেÑ একটা মেয়েকে হত্যা করে চিমনির ভেতরে এমনভাবে ঠেসে রাখা হয়েছে যে মৃতদেহটা নামিয়ে আনতে তিন-চারজন মানুষ লাগে।
তাছাড়া ভেবে দেখোÑ স্বাভাবিক কোনো খুনি কী এই কাজটা করবে? মৃতদেহ এভাবে লুকিয়ে রাখাার চেষ্টা করবে? কী ভীষণ শক্তিশালী সেÑ তার আরেকটা প্রমাণ দেখোÑ মেঝেতে যে চুলের গোছা পাওয়া গেছে, তা মৃতের মাথা থেকে উপড়ে তোলা হয়েছে, চুলের গোড়ায় লেগে আছে রক্ত আর মাংসÑ কী অমানুষিক শক্তি থাকলে এটা সম্ভব! এই সবকিছু এক করলে কী দাঁড়ায়? কী মনে হয় তোমার?’
প্রশ্নটা শুনে এবার ঠাণ্ঠা একটা ¯্রােত নেমে গেল আমার মেরুদ- বেয়ে। ‘পাগল!’ আমি বললাম। ‘নিশ্চয়ই কোনো পাগলের কাজ এটা। হয়তো কোনো উন্মাদ পালিয়ে এসেছে পাগলাগারদ থেকে।’
‘হতে পারে।’ দুপঁ বললো। ‘অসম্ভব নয়। কিন্তু বন্ধু, পাগলেরও একটা ভাষা থাকেÑ কোনো না কোনো ভাষায় কথা বলে সে। কিন্তু আমাদের খুনির কোনো ভাষা নেই, সে ভাষাহীন। এবার এই জিনিসটা দেখো। এই একগুচ্ছ লোমÑ এটা আমি মাদাম এসপানায়ার হাতের মুঠিতে পেয়েছি। এটা দেখে কী মনে হয় তোমার?’
‘দুপঁ!’ বিস্ময়ে আমি চিৎকার দিলাম। ‘এ তো কোনো মানুষের লোম নয়?’
‘আমি তো বলিনি মানুষের লোম।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো দুপঁ। ‘কীসের লোম, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আরও একটা জিনিস দেখাই তোমাকেÑ এই যে দেখতে পাচ্ছোÑ এখানে মেয়েটার গলায় যে আঙুলের দাগ ছিল, সেই আঙুলের ছাপ।’
আঙুলের ছাপওয়ালা একটা কাগজ টেবিলের উপর বিছিয়ে দিল দুপঁ। বললো, ‘এবার তোমার হাতের আঙুলগুলো রাখো এই ছাপের উপর। তারপর মিলিয়ে দেখো মেলে কিনা।’
তাই করলাম দুপঁর কথামতো। আঙুলগুলো মিললো না ছাপের সঙ্গে।
‘দাঁড়াও আরও নিখুঁতভাবে কাজটা করি আমরা।’ দুপঁ বললো। ‘মানুষের গলা তো গোল। এই যে গোল কাঠটার গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছি আমি কাগজটা। এবার চেষ্টা করে দেখো।’
চেষ্টা করলাম। কোনো লাভ হলো না। পার্থক্যটা আরও পরিষ্কার বোঝা গেল। আমি বললাম, ‘এটা কোনো মানুষের হাতের ছাপ না দুপঁ।’ জীবজন্তুর ছবিওয়ালা একটা বই বের করে এবার আমার সামনে ধরলো দুপঁ। বললো, ‘এই পৃষ্ঠাটা পড়ে দেখো।’
দেখলাম সেখানে বিশাল আকৃতির শক্তিশালী একটা ওরাং ওটাংয়ের ছবি আর তার বর্ণনা। পড়া শেষ করে হতভম্ব হয়ে গেলাম। বললাম, ‘দুপঁ আমি এখন নিশ্চিত, এই হাতের ছাপ আর ওই লোম ওরাং ওটাংয়ের। কিন্তু আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি নাÑ কী ঘটছে এসবÑ এখানে ওরাং ওটাং এলো কোত্থেকে? তাছাড়া কণ্ঠস্বর তো শোনা গেছে দুটো। তার মধ্যে একজন ফ্রেঞ্চম্যান ছিলÑ এ কথা সবাই বলেছে।’
‘হ্যাঁ ঠিক।’ বললো দুপঁ। ‘অনেকে এটাও বলেছে যে তারা ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘মাই গড!’ বলতে শুনেছে। এ থেকে মনে হয় ঘটনার ভয়াবহতা দেখে একজন ফ্রেঞ্চম্যান বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে কথাগুলো বলছে। আমার ধারণা লোকটা নিরপরাধ। এমন হতে পারে যে ওরাং ওটাংটা তার কাছ থেকে কোনোভাবে পালিয়ে গেছে। লোকটা জন্তুটাকে অনুসরণ করে ঘরের ভেতরে আসে এবং হত্যাকা-ের বিভৎসতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তবে এসবই আমার অনুমানÑ যথেষ্ট প্রমাণ আমার হাতে নেই, এ বিষয়ে তাই আর কথা বলা ঠিক হবে না।
যদি আমার অনুমান ভুল না হয়ে থাকে এবং ওই ফ্রেঞ্চম্যান যদি সত্যিই নিরপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে আমি আশা করছি এই বিজ্ঞাপনটা তাকে এখানে নিয়ে আসবে। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছেÑ গতকাল বাড়ি ফিরবার পথে আমি ‘লে মন্ড’ পত্রিকার অফিসে ঢুঁ মেরেছিলাম? এটা নাবিকদের পত্রিকা, প্রায় সব নাবিকই এই পত্রিকা পড়ে থাকে।’
দুপঁ আমাকে বিজ্ঞাপনটা দেখালো। তাতে লেখাÑ
দুদিন আগে, ...তারিখে (খুনের দিন সকালের তারিখ) বুলোন পার্কে একটি বোর্নিও প্রজাতির বড়সড় কমলা রঙের ওরাং ওটাং ধরা পড়েছে। ওরাং ওটাংয়ের মালিক (সম্ভবত মাল্টিজ জাহাজের নাবিক), উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে জন্তুটিকে ফেরত নিয়ে যেতে পারেন। জন্তুটিকে ধরতে ও খাওয়া বাবদ যা খরচ হয়েছে, তা মালিককে পরিশোধ করতে হবে। নি¤œ ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।
যোগাযোগের ঠিকানা আমাদের বাড়ি।
‘লোকটা নাবিক?’ অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম। ‘তুমি জানলে কী করে সে মাল্টিজ জাহাজের নাবিক?’
‘জানি না।’ দুপঁ জবাব দিল। ‘অনুমান করছি। এই যে দেখো আমি কী কুড়িয়ে পেয়েছিÑ এই ফিতেটা আমি পেয়েছি লাইটনিং রডের গোড়ায়, যখন আমরা তদন্ত করছিলাম। নাবিকরা তাদের লম্বা চুল এ রকম ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখে। এই ফিতেয় যে বিনুনি দেখছো, মাল্টিজ নাবিকরাই বিশেষ করে এভাবে বেণী গাঁথে। এ থেকে আমি ধরে নিয়েছি এই ফ্রেঞ্চম্যান মাল্টিজ জাহাজের নাবিক। আমার অনুমান ভুল হলেও ক্ষতি নেই। লোকটা ভাববেÑ যারা তার ওরাং ওটাং ধরেছে, তারা একটা ভুল করেছে। কিন্তু যদি অনুমানটা ঠিক হয়, তাহলে অনেক লাভ।
ভেবে দেখো লোকটা এই বিজ্ঞাপন দেখে কী চিন্তা করবে? সে প্রথমেই চিন্তা করবেÑ আমি তো নিরপরাধ, আমি নিজে কোনো অপরাধ করিনি। আমি গরিব মানুষ, ওরাং ওটাংটা আমার দামি একটা সম্পদ। আমি ওকে হারাবো কেন? তাছাড়া, যারা বিজ্ঞাপনটা দিয়েছে, তারা তো আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। নিরপরাধ হয়েও আমি যদি যোগাযোগ না করি, আমার উপর অকারণ সন্দেহ তৈরি হতে পারে...।’
এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
‘রেডি হও।’ দুপঁ বললো। ‘পিস্তল রেডি রাখোÑ তবে আমার ইঙ্গিত না পেলে ব্যবহার করো না।’
দরজার কাছে এসে পায়ের আওয়াজ থেমে গেল। বোধহয় ইতস্তত করছে লোকটা। সিঁড়ি দিয়ে শব্দটা নেমে যাচ্ছিলো। দুপঁ দ্রুত দরজার কাছে গেল, কান পাতলো। শব্দটা আবার ফিরে আসছে। দুপঁ চেয়ারে এসে বসলো। ঘরের দরজায় ঠকঠক শব্দÑ
‘ভেতরে আসুন।’ আগন্তুককে স্বাগত জানালো দুপঁ।
আগন্তুক ভেতরে এলো। লোকটাকে একনজর দেখে নাবিকই মনে হয়Ñ দীর্ঘ বলিষ্ঠ গড়ন, রোদে পোড়া তামাটে মুখÑ জুলফি আর গোঁফে মুখটা অর্ধেক ঢাকা পড়ে গেছে। তার হাতে ওক কাঠের লম্বা একটা লাঠি। ‘গুড ইভনিং।’ মাথা ঝুঁকিয়ে বললো আগন্তুক।
‘বসুন বন্ধু।’ দুপঁ বললো। ‘ওরাং ওটাংয়ের খোঁজে এসেছেন নিশ্চয়ই? দারুণ একটা পোষ্য আপনার, চমৎকার প্রাণী। কত হবে ওর বয়স?’
দুপঁর সহজ কথাবার্তা শুনে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো লোকটা ধীরে ধীরে। বললো, ‘ঠিক জানি না। চার-পাঁচ বছর হতে পারে। সে কী এখানে আছে?’
‘না না। এখানে তো রাখার জায়গা নেই। কাছেই আছে, দুবর্গ স্ট্রিটের একটা পশু খামারে আছে। আগামীকাল সকালেই পেয়ে যাবেন। আপনি যে মালিকÑ প্রমাণ সঙ্গে এনেছেন তো?’
‘এনেছি স্যার।’
‘আমার খুব মায়া পড়ে গেছে ওরাং ওটাংটার ওপর, বুঝলেন। ছাড়তে ইচ্ছে করছে না মোটেও।’ দুপঁ বললো।
‘ওর বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন, আমি দিতে রাজি আছি।’ বললো আগন্তুক। ‘অবশ্য আমার সাধ্যের মধ্যে।’
‘বেশ।’ দুপঁ বললো। ‘ভেবে দেখি তাহলে কী চাইতে পারি আমি আপনার কাছে...কী চাওয়া যায়! ও হ্যাঁ...মনে পড়েছেÑ মর্গ স্ট্রিটের হত্যাকা- সম্পর্কে যা জানেন আপনি, আমাকে বলুন।’
খুব শান্তভাবে কথা বলছিল দুপঁ। কথা বলতে বলতে উঠে শান্তভাবেই সে দরজার কাছে গিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। চাবিটা রাখলো পকেটে। অন্য পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে রাখলো টেবিলের ওপর।
নাবিকের মুখটা সাদা হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে সে লাঠিটা হাতে নিয়েছিল, পরমুহূর্তেই বসে পড়লো চেয়ারে এবং কাঁপতে লাগলোÑ দেখে আমার মায়া হলো লোকটার জন্য। একটা কথাও বললো না সে। ‘শোনো বন্ধু।’ সহৃদয় ভঙ্গিতে বললো দুপঁ। ‘ভয় পেও না। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। আমি জানি তুমি নির্দোষ, ওই হত্যাকা-ে তোমার কোনো হাত নেই আমি নিশ্চিত। তবে এটাও ঠিকÑ তুমি অনেক কিছু জানো। কোনো না কোনো ভূমিকা ছিল তোমার। বুঝতেই তো পারছো তোমার সম্পর্কে আমরা প্রচুর তথ্য জোগাড় করেছি। আমি জানি তুমি এমন কিছুই করোনি, যার জন্য আইনের চোখে তোমাকে অপরাধী বলা যায়। তুমি টাকা-পয়সাও নিয়ে যাওনিÑ কাজেই ডাকাতির অভিযোগও কেউ আনতে পারবে না তোমার বিরুদ্ধে। এ সবই সত্যি। সেই সঙ্গে এটাও সত্যিÑ তোমার একটা দায়িত্ব আছেÑ সবকিছু খুলে বলা। ভেবে দেখো, এই ঘটনায় একজন নিরপরাধ লোক গ্রেপ্তার হয়ে হাজতবাস করছে। তার প্রতিও তোমার কর্তব্য আছে। অপরাধী কে, তা যদি তুমি জানাও, তাহলে ওই নিরপরাধ ব্যক্তি মুক্তি পাবে।’
দুপঁর কথা শুনে লোকটা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলো। তবে সে যে ভীষণ ভয় পেয়েছেÑ তা বোঝা যাচ্ছে। ‘ঈশ্বর আমার সহায় হোন।’ অবশেষে বললো নাবিক। একটু দম নিল সে। ‘সবকিছু বলছি আমি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্তÑ এর কতটুকু আপনারা বিশ্বাস করবেন, জানি না। তবে ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি আমি নির্দোষ। পুরো ঘটনা বলবো আমিÑ যদি সেজন্যে কোনো শাস্তি আমাকে পেতে হয়, আমি মেনে নেব।’
নাবিক যা বললো তা সংক্ষেপে এ রকমÑ তার জাহাজ সম্প্রতি এশিয়ার বন্দরে বন্দরে ঘুরছিলÑ এক সময় বোর্নিওতে নোঙর করে জাহাজ। নাবিকদের একটা দল দ্বীপটা ঘুরেফিরে দেখার জন্য নেমে পড়লো তীরে। সেই দলে সে-ও ছিল। জঙ্গলের ভেতরে সে আর তার বন্ধু মিলে এই ওরাং ওটাংটাকে ধরে ফেলে। বন্ধুটি পরে মারা যায়। এভাবে ওরাং ওটাংয়ের মালিক হয়ে যায় সে। এই হিং¯্র বন্য জন্তুটাকে পোষ মানাতে তার দারুণ কষ্ট হয়েছে। কিছুদিন পর জাহাজ ফ্রান্সের বন্দরে ভিড়লে জন্তুটাকে নাবিক তার নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। এতদিন পাড়া-প্রতিবেশীর কৌতূহলী চোখ এড়িয়ে সে ওকে লুকিয়ে রেখেছিল।
ঘটনার দিন সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা শেষে গভীর রাতে বাড়ি ফেরে। ফিরে দেখে ওরাং ওটাং তার বেডরুম দখল করে বসে আছে। তাকে বেডরুমের পাশে একটা খাঁচায় রেখেছিল নাবিক, খাঁচা ভেঙে সে বেরিয়ে পড়েছে। তার হাতে নাবিকের দাড়ি কাটার ধারালো ক্ষুর। ক্ষুর হাতে ওরাং ওটাং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কাটার ভঙ্গি অনুকরণ করছে। নিশ্চয়ই জন্তুটা আগে নাবিককে এই কাজ করতে দেখেছে। হিং¯্র জন্তুটার হাতে এই বিপজ্জনক অস্ত্র দেখে নাবিক হতবুদ্ধি হয়ে যায়। অবাধ্য ওরাং ওটাংকে শায়েস্তা করার জন্য একটা চাবুক ছিল। চাবুকটা সে হাতে নেয়। চাবুক দেখা মাত্র জন্তুটি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়, তারপর খোলা জানালা দিয়ে বাইরে পালায়।
রাত তখন তিনটা। রাস্তাঘাট সুনসান। ওরাং ওটাংয়ের পিছে পিছে ধাওয়া করতে থাকে নাবিক। জন্তুটা কিছুদূর যায়, থেমে পেছন ফিরে মালিককে দেখে, তারপর আবার ছুটতে থাকে। এভাবে যেতে যেতে তারা পৌঁছায় মর্গ স্ট্রিটে। সেখানে চারতলায় আলো জ্বলছিল। জানালার আলোটা ওরাং ওটাংয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করেÑ সে সেদিকে এগোয়। তরতর করে জন্তুটা রড বেয়ে উঠে যায় ওপরে। জানালার পাল্লা সম্পূর্ণ খোলা ছিল। পাল্লা ধরে দোল খেয়ে ওরাং ওটাং লাফিয়ে নামে জানালায়Ñ সেখান থেকে ঘরের ভেতর। তার পায়ের ধাক্কায় জানালা আবার খুলে যায়।
নাবিক প্রথমে খুশিই হয়েছিল এ কথা ভেবে যে এবার জন্তুটাকে ধরা যাবে। আবার একটু শংকাও ছিল তার মনেÑ না জানি ঘরের ভেতর কী অঘটন ঘটায় হিং¯্র জন্তুটা। বহুকষ্টে সে রড বেয়ে ওপরে উঠে আসে। তার পক্ষে পাল্লা ধরে ভেতরে ঢোকা সম্ভব হয়নি। এক হাতে রড ধরে অনেকখানি ঝুঁকে ঘরের ভেতরটা সে দেখতে পায়। যে দৃশ্য দেখলো নাবিক, তাতে তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। মা-মেয়ে খুব সম্ভব লোহার ছোট্ট বাক্সটায় দরকারি কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছিল, যখন ওরাং ওটাং ঘরে ঢোকে।
হঠাৎ ঘরের মধ্যে এ রকম একটা জন্তু দেখে মা-মেয়ে ভয়ে জমে যায়। ওরাং ওটাং এগিয়ে গিয়ে মায়ের চুলের মুঠি চেপে ধরেÑ তার মুখের সামনে ক্ষুর হাতে সে নাপিতের মতো অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। মহিলা ভয়ে আর ব্যথায় চিৎকার দিতে থাকেন। এতে ল্ডুদ্ধ হয়ে ওঠে ওরাং ওটাং, ভীত মহিলা জন্তুটার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন প্রাণপণেÑ তখন সে মহিলার মাথার খুলি থেকে চুল উপড়ে নেয় এবং একটানে তার গলা কেটে ফেলে।
এই দৃশ্য দেখে সভয়ে চিৎকার দেয় মেয়েটি। ল্ডুদ্ধ ওরাং ওটাং এক লাফে এগিয়ে গিয়ে এবার মেয়ের গলা চেপে ধরে। মেয়েটিও মারা যায়। এমন সময় পেছন ফিরে জানালার বাইরে তার মালিকের মুখ দেখতে পায় ওরাং ওটাং। চাবুকের কথা তার মনে পড়ে যায়Ñ ভয়ে সে ঘরময় ছুটোছুটি করতে থাকে, সবকিছু এলোমেলো করে দেয়, বিছানা টেনে নামায়। এবং শেষে তার অপকর্ম লুকানোর জন্য মেয়েটির মৃতদেহ চিমনির ভেতরে ঠেসে দেয় সে, মহিলার মৃতদেহটা জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে। এই পর্যন্ত দেখে ভীত, সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত নাবিক পিছলে নেমে যায় রড বেয়ে। তারপর সোজা নিজের বাড়ি।
এরপর আর কিছু যোগ করার থাকে না। বোঝাই যাচ্ছে, ঘরের দরজা ভাঙার শব্দ পেয়ে জন্তুটা জানালা দিয়ে বেরিয়ে রড বেয়ে নিচে নেমে পালিয়েছে। তার পায়ের ধাক্কায় জানালার পাল্লা আবার অটোলক হয়ে গেছে। আর যে দুটো কণ্ঠস্বর শোনা গেছে তার একটা এই ফ্রেঞ্চ নাবিকের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর, অন্যটা ওরাং ওটাংয়ের।
পলাতক ওরাং ওটাংটা কিছুদিনের মধ্যে ধরা পড়েছিল তার মালিকের হাতে। জন্তুটাকে সে চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষের কাছে বিল্ডি করে দেয়, মোটা টাকার বিনিময়ে। নিরপরাধ কেরানি এডলফ বোঁ মুক্তি পায়। সেজন্য অবশ্য দুপঁকে থানায় গিয়ে ঘটনা ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। থানার দারোগা দুপঁকে ধন্যবাদ দেওয়ার বদলে উল্টে কিছু কথা শুনিয়ে দিল। ব্যঙ্গ করে বললোÑ মানুষের উচিত যার যার নিজের চরকায় তেল দেওয়াÑ অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো।
‘বলুক যা খুশি।’ থানা থেকে বেরিয়ে মন্তব্য করলো দুপঁ। ‘এসব বলে পরাজয়ের জ্বালা যদি জুড়ায় বেচারার...জুড়াক।’