আকমল হোসেন আকাশে তাকালেন
গতকাল বিকেলে যে ঘটনা ঘটে গেল, সেটি পুনরায় ভাবনায় এসে অদ্ভুতভাবে কাতর করে দেয়। আকমল হোসেন আকাশে তাকালেন। একটুপর ঊষার আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। পুব আকাশে জেগে থাকা তারাও হারিয়ে যাবে দৃষ্টিসীমার ওপারে। তারা নয়, শুক্রগ্রহ, সবাই জানে গোধূলি শেষে পশ্চিম আকাশে জেগে ওঠে যে, সে সন্ধ্যাতারা, ভোর সকালে তার নাম হয় শুকতারা। এই জানা কখনো ভুলবার নয়। অনেককিছুই ভুলে যাওয়ার নয়। বাবার কোলে বসে সেøটে অক্ষর লেখা কিংবা স্কুলে হ্যান্ড রাইটিং খাতায় ‘সদা সত্য কথা বলিব’ লেখার চর্চা।
সবই তো জীবনের প্রাপ্তি। গতকাল অবশ্য কিছুতেই স্মরণ করতে পারলেন না। এখানেই সমস্যা। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। বাজারের ব্যাগে সবজি তুলে দিতে দিতে হতবাক হলো বসির মিয়া নামের মধ্যবয়সি লোকটিও। আকমলের সামনে তখন সুটেড-বুটেড ভদ্রলোক। চেহারায় হাসি হাসি যেন অনেকদিনের চেনাজানা আশকারা।
‘কেমন আছেন ভাই?’
‘জি ভাই ভালো আছি। আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ! আমি এখন বাহাদুর বাজার শাখায়। একদিন আসেন গল্প করা যাবে।’
‘আপনি কোথায় আছেন যেন?’
এখানেই ভুল করে ফেলেন আকমল। তার উপস্থিত বুদ্ধি চলনসই, সহজে পরিস্থিতি সামলে নিতে পারেন, কিন্তু সেই জিজ্ঞাসায় নিজের স্মৃতি যে ঘোলাটে হতে শুরু করেছে সেটি প্রমাণীত হয়ে গেল। ভদ্রলোক বিস্মিত কণ্ঠে পালটা প্রশ্ন রেখে দিলেন।
‘আপনি কি চিনতে পেরেছেন আমাকে?’
‘চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক...।’
‘অ কে। মনে করতে পারছেন না। আচ্ছা মনে করার চেষ্টা করুন। দেখা হবে।’
ভদ্রলোক বাজার হতে বের হওয়ার পথের দিকে এগোতে শুরু করেছেন। আকমল সেদিকে তাকিয়ে বড়ই বিমূঢ় হয়ে গেলেন। বসির মিয়া বলে উঠল, -
‘স্যার আপনি ওনারে চিনতে পারেন নাই?’
‘ঠিক। কে তিনি? চেনা চেনা মনে হলো, কিন্তু...বুঝতে পারছি না।’
‘উনি এখানে ব্যাংকের ম্যানেজার।’
‘কোন ব্যাংক?’
বসির মিয়া বিশাল কৃতিত্ব করেছে এমনভাবে ব্যাংকের নাম জানায়। আকমল কিছু বললেন না। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হলো। এতক্ষণে চিনতে পেরেছেন। জিল্লুর রাহমান। একসময়ে তার কাছে গিয়েছিলেন। সেও তো বছর তিন-চার কিংবা তারও বেশি আগের কথা। এখন রিটায়ার্ড জীবন, দেখতে দেখতে ষাট বছর পেরিয়ে গেছে; দীর্ঘ এই সময়ে পরিবর্তন হয়েছে অনেককিছুর। তার এবং জিল্লুর রাহমানেরও। সুতরাং দোষ কাকে দেবেন? তারপরও মনের মধ্যে হতাশাব্যঞ্জক অতৃপ্তি হৃৎস্পন্দনের মতো ধুক ধুক করতে লাগল।
একদিন স্কুলের অ্যাসেম্ব্লি শেষে শিক্ষক লাইব্রেরিতে বসে আছেন। অনেক দুশ্চিন্তায় পাঠ্যসূচিতে সঠিক মনোযোগ দিতে পারছেন না। গ্রামীণ মহাজনের কাছে থেকে নেওয়া ঋণ পাহাড়ের মতো ভারী আর গোলকধাঁধায় জটিল করে তুলেছে মনমেজাজ। এই জগদ্দল পাথর সরাতে চান, কিন্তু উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় পাবেন এত টাকা? ‘কাল্ব’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের ঋণ দেয়।
সুদের হার দুই শতাংশ। সেখানের শর্ত পূরণ করার পথও বন্ধ। কেননা নিজ অ্যাকাউন্টের চেকবই মহাজনের কাছে জমা রেখে ঋণ নিয়েছেন। পরিশোধ না করে চেকবই ফেরত পাবেন না। এ ছাড়া দু-একটি শর্তাবলী গ্রামের মহাজনি ঋণে। দেড়শ টাকার স্ট্যাম্পের সবটুকু সাদা রেখে নিচে পূর্ণস্বাক্ষর। গ্যারান্টিয়র হিসেবে দুজন সহকর্মীর সাক্ষ্য। ঋণ নিয়েছেন তিরিশ হাজার টাকা মাত্র। এক বেতন থেকে পরবর্তী বেতন মেয়াদে সুদ গণনা। আউটস্ট্যান্ডিংয়ের ওপর দশ শতাংশ সুদ। ঋণ গ্রহণের সময় প্রথম সুদের পঞ্চাশ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধ করার নিয়ম।
এখন পর্যন্ত দু-চারটি কিস্তি দিতে পেরেছেন। কয়েকটি সুদ মূলের সঙ্গে যোগ হয়ে আউটস্ট্যান্ডিং অনেক হয়ে গেছে। এখন টেনে নিতে পারছেন না। টাকা হাতে এলে ভালো লাগে, ঋণ পরিশোধে কষ্ট; এদিকে জীবনযাপন ব্যয় বাড়ছে তো বাড়ছেই। এসব জটিল ভাবনায় মন বড় অস্থির। পিরিয়ড শেষে ক্লাস, অথচ মন ভালো নেই; সবকিছুই কেমন খাপছাড়া অস্থির লাগে। এদিকে কুড়ি তারিখ, অথচ গত মাসের বেতনভাতার খবর নেই। সরকার সম্ভবত একসঙ্গে দুই মাসের সরকারি অনুদান বেতনভাতা দিতে পারে। অর্থবছরের শেষ এবং শুরুর সময়ে এমন হয়। সে-সময় ফিজিক্যাল ইন্স্ট্রাক্টর জাকির হোসেনের সঙ্গে আলোচনা।
‘আকমল ভাই মন খারাপ নাকি?’
‘পুরুষ মানুষ অর্থকষ্টে থাকলে যা হয় আরকি! তারপর মাথার ওপর ঋণের বোঝা।’
‘ভাই যত মুশকিল তত আসান। ব্যাংক থেকে লোন নিন। ওই রাক্ষসের থাবা বন্ধ করেন। আপনার মতো শিক্ষিত মানুষ কেন যে মহাজনি ঋণে জড়ায়? এটা তাদের ব্যবসা।’
জাকির একদিন ক্লাস শেষে ব্যাংকে নিয়ে যায়। উপজেলার বিখ্যাত কলেজ প্রিন্সিপালের ছেলে জিল্লুর রাহমান। তিনি ব্যাংকের ম্যানেজার। জাকিরের ছেলেবেলার বন্ধু। আকমল হোসেনকে সাদরে আপ্যায়ন করেন। আকমল ভরসা পান। পরিস্থিতির সব খুলে বলেন।
‘সমস্যা নাই ভাই। আপনি চাকরিজীবী বা ভোগ্যপণ্য লোন নিয়ে ওই খাল ভরাট করে ফেলেন। এখানে তো অ্যাকাউন্ট আছে, মাসের বেতনে কিস্তি কেটে নেওয়া হবে। সুদের হারও কম।’
আকমল হোসেন ওইদিনই ঋণের আবেদন ফরম সংগ্রহ করে নিলেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বিবিধ সংযুক্তিসহ দাখিলও হলো। তারপর যা হয়, ভুলোমন স্মরণে থাকল না। মাসের শেষদিকে একসঙ্গে দু-মাসের বেতনের খবর হলো। আকমল হোসেন মনে খুশি নিয়ে বেতন তুলতে গিয়েছেন। চেক জমা হয়েছে। অপেক্ষা করছেন, কখন টোকেন নম্বরে ডাক পড়ে; আকস্মিক খুব কাছে থেকে কথা বলে ওঠে কেউ।
‘ভাই কেমন আছেন?’
‘ওহ্ ভালো আছি ভাই? আপনি ভালো তো?’
আকমল তাকিয়ে দেখেন জিল্লুর রাহমান। হাসি হাসি চেহারা। এমন মুখছবি আনন্দ দেয়। আজ আকমলের মনেও খুশির জোয়ার। বেতনের টাকায় পরিবারের এটা-ওটা কেনা যাবে। অনেকদিন ইম্প্রুভ খাওয়ার সুযোগ আসে না। ছেলেমেয়ের আবদার। আজ হয়তো পূরণ করা সম্ভব হবে। তাই ভেতরে ভেতরে সাধ বাস্তবায়নের ছবি ভেসে ওঠে।
‘আমি ভালো আছি, কিন্তু আপনার খবর কী? আপনার লোন কর্পোরেট শাখা থেকে অ্যাপ্রুভ হয়ে এসেছে বেশ কয়েকদিন হলো, আর আপনার খবর নেই।’
‘তাই! আমি ভেবেছিলাম এক-দুই মাস লাগতে পারে।’
‘লোন তুলবেন আজ?’
‘আজ নয় ভাই, পরশুদিন আসব।’
‘আশ্চর্য!’
বিস্ময়ের বিষয় বটে! মহাজনের কাছে থেকে চেক বইয়ের একটি পাতা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। অন্য একটি পাতা জোগাড় হলেই তো ঋণ ক্যাশ করা সম্ভব। সেই কথা মনে থাক। আকমল খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। এমন পরোপকারী মানুষ তাহলে জগতে আছে। অথচ সেই উপকারী মানুষটিকে ভুলে গিয়েছেন। সময়ের ব্যবধান কি সব ভুলিয়ে দেয়? কথায় বলে আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড। কে জানে বয়স বাড়ছে, স্মৃতিও হারিয়ে যেতে শুরু করেছে; মানুষের জীবনে এমনই হয়।
এই তো এক-দেড় মাস আগে জেলায় সাহিত্য সম্মেলন হয়ে গেল। একসময় স্থানীয় সংবাদপত্রে কয়েকটি কবিতা প্রকাশ পেয়েছিল। তেমন কিছু নয় আবার ফেলনাও বলা যাবে না। আকমল হোসেন সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলেন। সকাল দশ-এগারোটায় অনুষ্ঠান শুরু হলো। লোকে-লোকারণ্য অডিটোরিয়াম। অনেক গুণীজন সমাগত। তিনি অডিটোরিয়ামের এককোণায় বসে আছেন। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ, তবুও এসি চলছে; তিনি শীতে জমে আছেন। আকস্মিক তার পাশেরজন জিজ্ঞেস করে বসলেন, -
‘আপনি আকমল হোসেন না?’
‘জি। আপনি আমায় চেনেন কিভাবে?’
‘আপনি একদিন সিটি কলেজ এসেছিলেন। সেখানে গল্প-আলাপ হয়। আপনি তো কবিতা-ফিচার এসব লেখেন।’
‘একসময় লিখতাম। এখন তেমন আর চর্চা নেই। বলতে পারেন ভালো লাগে না।’
‘লিখবেন। কেন লিখবেন না? আমাকে মনে পড়ছে?’
‘আমার স্মরণশক্তি কম ভাই। মনে করতে পারছি না। আপনার নাম?’
আকমল হোসেন বড়ই বিব্রতবোধ করতে লাগলেন। অন্যের স্মৃতিশক্তি এত ভালো, অথচ তিনি কিছুই মনে রাখতে পারেন না। কারও প্রসঙ্গে কথা উঠলে তাকে চিনতে অসুবিধা হয়। কারও চেহারা চোখে ভাসে, কিন্তু নাম-ঠিকানা স্মরণে আসে না। তিনি ভদ্রলোককে কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। হাবাগোবার মতো তাকিয়ে রইলেন।
এদিকে রাজনৈতিক সেøাগানের উচ্চৈঃস্বরে অডিটোরিয়াম ভূমিকেম্পর মতো দুম দুম করে উঠল। সেøাগান বলতে ক্ষমতাসীন দলের জয়ধ্বনি। সাহিত্য সম্মেলনে রাজনৈতিক কর্মীর এত ছড়াছড়ি কেন? আসলে রাজনীতি ছাড়া কি সাহিত্য হয়? সমাজের সবকিছু নিয়েই তো সাহিত্য। এই সম্মেলন মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতির পোশাকে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর প্রচার। মেরুকরণের অথবা যাচাইয়ের নগ্ন চেষ্টা। কে জানে কী! আকমল হোসেন সেøাগানের ধ্বনিতে অন্যরকম স্বস্তি পেলেন। সেটি জয়ধ্বনি নয়, অন্যদিকে মনোযোগ ফেরানোর সুযোগ বা অবসর। ভদ্রলোক সেদিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। আকমল চারিদিক সহনীয় হলে জিজ্ঞেস করলেন, -
‘আপনার বাসা?’
‘আমার দেশের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এখানে আছি তেরো বছর। বালুবাড়িতে বাড়ি করেছি। কলেজে ইংরেজি পড়াই। আগামী বছর এলপিআর-এ যাব।’
‘সাহিত্যচর্চা করেন?’
‘তেমন না ভাই, তবে পড়ি, সবকিছুই পড়ি; পড়তে পছন্দ করি।’
‘কবিতা পড়েন?’
‘অবশ্যই। গল্প-উপন্যাস পড়ি। সাহিত্য মনের পরিচ্ছন্নতা এনে দেয়। তাই না?’
এই উক্তি বড় ধাক্কা দিল মনে। আকমল তেমনভাবে কোনোদিন ভাবেন নাই। সাহিত্যকে দলীয় প্রচারে কলুষিত করা হচ্ছে কেন? তিনি অনেকদিন লেখেন না। এবার লেখা শুরু করবেন। পারবেন কি? ভদ্রলোক বেশ আস্তে আস্তে রবিঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’-র কিছু অংশ আবৃত্তি করলেন। জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’। আকমলের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তিনি আবেগপ্রবণ মানুষ। জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। গোপন কষ্ট বুকে যুগের পর যুগ বহন করে চলেছেন। মানুষ সকল কষ্টের কথা বলতে পারে না। তিনি লিখতেও পারেন না।
‘আকমল ভাই, আপনি এখনো আমাকে চিনতে পারেন নাই। তাই না?’
‘চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু নাম মনে করতে পারছি না। দুঃখিত ভাই, মনে কিছু নিয়েন না।’
‘আপনার নামেই আমার নাম। আকমল খান। আপনি হোসেন আমি খান। আমি আপনাকে মিতা বলে ডাকব ভাই।’
‘অবশ্যই মিতা।’
আকমল হোসেন নিজের মধ্য থেকে সকল কুণ্ঠা মুছে ফেলতে চাইলেন। তখন ডায়াসে অনবদ্য সুন্দরী এক আয়োজন উপস্থাপন শুরু করেছে। অডিটোরিয়াম অনেকখানি শান্ত হয়ে এলো। অপূর্ব সুন্দর কণ্ঠ চারদিকে মায়াজাল ছড়িয়ে রাখল।
এই ঘটনার অনেক পরে অন্য একদিন বিকেল বেলা। সেও বাহাদুর বাজার। আকমল হোসেন দুই কিলো চাল কেনার জন্য দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ একজন দক্ষিণ থেকে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, -
‘মিতা কেমন আছেন? আপনাকে দেখা যায় না।’
‘জি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাই?’
‘এই তো! মাছ নিতে এসেছিলাম। মেয়েটা সকালে ঢাকা থেকে এসেছে। ইলিশ নিলাম। সতেরো শ’ টাকা কেজি। চিন্তা করা যায়!’
‘সেই তো ভাই, কি দিন এসে গেল!’
দোকানি ব্যাগের মধ্যে চালের পলিপ্যাক নামিয়ে দিচ্ছে, আকমল বিব্রত চেহারায় মনে করার চেষ্টা করছেন; ভদ্রলোককে কোথায় দেখেছেন? মিতা বলে সন্বোধন করছেন কোন্ প্রেক্ষিত থেকে? মনে করতে পারলেন না। অপরপক্ষ কী বুঝল কে জানে। অনেকখানি মনের কথা পড়তে পড়তে সামনে এগোলেন।
‘আচ্ছা আসি ভাই। দেখা হবে। আস্সালামু আলায়কুম।’
‘ওয়া আলায়কুম আস্সালাম।’
আকমল স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন যে, তার স্মৃতিশক্তি ক্ষয় হয়েছে বা হতে শুরু করেছে। বাজার সেরে বাসা পর্যন্ত যাওয়ার পরও শনাক্ত করতে পারলেন না এই মিতা কে? তার সঙ্গে কি আগে কোথাও আলাপ হয়েছিল? কেন এমন হয়? তিনি কি তবে সত্যি সত্যি বৃদ্ধ হয়ে গেলেন? শোনা যায়, বয়সি মানুষের মস্তিষ্কে মেমরি সেলের কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করে। সেলে রক্ত চলাচল বিঘিœত হলে স্মৃতিভ্রংশ হয়।
ডাক্তারি ভাষায় বলে, ডেমনিশিয়া আর আলঝেইমার্স। কয়েকদিন এই ভাবনায় কাতর হলেন। সেই কিশোরবেলায় গল্পের বই পড়েছেন। সেই গল্পের চরিত্রগুলোর নাম কি অদ্ভুতভাবে মনে আছে। দস্যু বনহুরের নায়িকা মনিরা, প্রতি নায়িকা নুরি। দস্যু মোহনের নায়িকা রমা, কাজের মানুষ বিলাস, ডিটেকটিভ মি. বেকার। কুয়াশার শহিদ-কামাল-মহুয়া। এরকম কত গল্প-উপন্যাসের ডজন ডজন চরিত্র, তাদের নাম, ঘটনাপ্রবাহ উজ্জ্বল মনে আছে, অথচ কাছের মানুষগুলোর নাম হারিয়ে ফেলছেন। সকল মানুষের কি এমন হয়?
এর আরও পরে একদিন রেলওয়ে বুক স্টল থেকে দুটি ম্যাগাজিন কিনে ফিরছেন। কেউ একজন অটোরিকশায় ধা করে সামনে দিয়ে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। সেই অটো থেকে জিজ্ঞাসা ভেসে এলো। একজন শেভহীন চেহারার মানুষ কাঁধ বাঁকিয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।
‘মিতা কেমন আছেন?’
‘জি ভাই ভালো। আপনি ভালো আছেন?’
আকমল হোসেন আশ্চর্যজনকভাবে প্রশ্নকর্তাকে চিনে নিতে পারলেন। সেই আকমল খান। মানুষ মনে রাখার কত পদ্ধতি বের করেছে। কত উপায়! কেউ কেউ মোবাইলের এগারো ডিজিট পরিচিতি কি সুন্দর মনে রাখতে পারে! সেও একটি-দুটি নম্বর নয়, অনেক। তিনি তেমনই কোনো কৌশল খুঁজে নেবেন। সেই কৌশল কী, পারবেন কি; কিভাবে?
সেদিন ভোরের আলোয় বারান্দায় বসে আছেন। রাতে ঘুম ঠিকমতো হয় না। ডাক্তারের পরামর্শে কিছু সিডেটিভ নেন। এবং প্রেশারের ট্যাবলেট। তারপরও বুকের গহিনে অশান্তি সারারাত দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে। রাতে দু-একবার উঠে পড়েন। হাজারো উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা কাতর করে দেয়। কিছু ভালো লাগে না। কোত্থেকে ভেসে আসে পরাজয়ের তেপান্তর। জীবনের টার্নিং পয়েন্টগুলোয় ভুল সিদ্ধান্ত। এখন সে-সব ভেবে কোনো লাভ নেই জেনেও মন ফিরে যেতে চায়। নতুন আরেকটি জনমের ভুল সাধ জাগে। নিজের জন্য কখনো অসম্ভব করুণা। ব্যর্থ মানুষ আর কী করতে পারে!
সমাজের নিয়ম কোন্ কোন্ অনিয়মে মানুষের মন ভেঙে দেয়? ‘সদা সত্য কথা বলিব’-এই নিয়মের ব্রত থেকে কি হেরে গেলেন? কেন স্রোতে ভেসে যেতে পারেন নাই? সকলেই তো নয়-ছয় করে কত উপরে উঠে গেল। তিনি শুধু বই, বইয়ের শিক্ষা, নীতিকথা, প্রশ্নপত্র তৈরি, পরীক্ষা আর পাঠদানে ব্যস্ত থাকলেন। এসব তো মন ভুলে যায় না। তিনি কেন ভুলে যান না? দুপুরের রোদ আর বৃষ্টিতে ছাতা খুলে নিজেকে রক্ষায় আয়ু শেষ হতে থাকে। অন্য আকাশে তাকালেন না। কী করলেন জীবনে?
সারাজীবন শুধু নিজের ভাবনার আবর্তে পরিক্রমন? ছোট ভাইবোন কে কেমন আছে, কে কিভাবে বেঁচে আছে খোঁজ নিয়েছেন? আশপাশের খবরাখবর? সমাজ আর দেশের কথা? কোন্ কারণে এত অসামাজিক হয়ে গেলেন? নিজেকে ক্রমশ সম্পর্কের সেতুবন্ধন থেকে আলগা করতে করতে একা হলেন অবশেষে। কারও খোঁজখবর রাখেন না। কেউ তার ভালো-মন্দ নিয়ে জিজ্ঞেসও করে না।
আকাশের পুবদিকে শুকতারা জ্বলজ্বল করছে। ভোরের আলো উজ্জ্বল হতে হতে ওই গ্রহের চিহ্ন আর দেখা যাবে না। মুছে যাবে। জীবন কি এমনই? তার দু-চোখ আলগোছে ঝাপসা হয়ে যায়। এভাবে একা একা জীবন চলে না। সকলের মধ্যে মিলেমিশে বেঁচে থাকার নামই জীবন। সকালে একে একে সবার একবার খোঁজ নেবেন। এর মধ্য দিয়েই শুরু করতে চান নতুন জীবন। ভুলে যেতে চান না...কাউকে ভুলতে দিতেও।
তিনি সকালের প্রতীক্ষায় শুকতারার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন।