বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় কাব্যানুষঙ্গ
বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি পাশ্চাত্য, রাশিয়ান, ফরাসি প্রভৃতি ভাষার সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অনেকের মধ্যেই এ রূপান্তর চেষ্টা বিদ্যমান ছিল। এ প্রসঙ্গে টি. এস. ইলিয়টের ‘দ্য মিউজিক অব পোয়েট্রি’ গ্রন্থের ‘ঋড়ৎসং যধাব ঃড় নব নৎড়শবহ ধহফ ৎবসধফব’ কথাটি গ্রহণযোগ্য। বোদলেয়ার রচিত একটি গদ্যগ্রন্থ ‘খবং ঋষবঁৎং ফঁ গধষ’ এ আধুনিক কবিতার ধরন যৌক্তিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলার কবিগণ নিজস্ব ভাষা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ লক্ষ্য রেখে রাশিয়ান বাস্তববাদ, ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ, মার্কসবাদী তত্ত্ব, ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণকে তাঁদের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ঠাঁই দিয়েছেন। ফলে রূপান্তরিত কবিতা নতুনমাত্রা লাভ করে সাবলীল হয়ে পাঠকচিত্তকে জয় করেছে।
বাংলা কবিতা অনূদিত হয়ে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে না পৌঁছালেও, বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটাতে বাংলার কবিরা পিছিয়ে ছিলেন না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলাভাষা ও কবিতায় প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রয়োগ করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাংলা কাব্য সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। অনুরূপভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমাত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া বাংলা কবিতায় আধুনিকতার ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয়।
তবে আধুনিক কবিতার পরিপূর্ণ প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে তিরিশের দশকে। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ এবং তিরিশের বেশ কিছু কবির মানসে প্রকৃত আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। তাঁদের প্রায় সবারই ইউরোপীয় ভাষায় দখল থাকায় রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় কবিতার শক্তি বাংলা কবিতায় প্রবেশ করান।
আধুনিক কবিতার মূল তত্ত্ব হলো আত্মিক উপলব্ধি। শৈল্পিক আত্মার স্বরূপকে সামনে রেখে আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে একটু দেরিতে হলেও ইউরোপীয় ধারার প্রচলন ঘটে। এজরা পাউন্ড, টি. এস. ইলিয়ট, অ্যাডগার এলান পো, বোদলেয়ার, রবার্ট ফ্রস্ট, মালার্মে, পাবলো নেরুদা, র্যাবোর মতো ইউরোপীয় কবিদের ভাবাদর্শ গ্রহণ করে বাংলা কবিতার নবযাত্রা শুরু হয়। এসব কবিদের সৌন্দর্য চিন্তা, গতিশক্তি, ভাবনার ঐক্যকে রূপান্তর বাংলা কবিতা ঢেলে সাজানোর চর্চা শুরু হয়।
এ সময়ে আমাদের কবিতায় বিশ্বসাহিত্যেও উজ্জ্বলতা ধরা দিতে শুরু করল। রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নিজস্ব ভাষায় কাব্য নির্মাণ ভালো কবির বৃহৎ গুণ। তবে এক্ষেত্রে সবাই সাফল্যের মুখ দেখতে পারেননি। এক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত : মধুসূদন দত্তের কবিতায় দান্তে, ওভিদ, মিল্টন প্রমুখ ইউরোপীয় কবির প্রভাব বিদ্যমান। তাঁর তিলোত্তমা কাব্যে দেব চরিত্রে ব্রহ্মার ভূমিকায় জিউসের প্রভাব আছে। জিউসের মতো মাইকেল মধুসূদন দত্তের ব্রহ্মা স্বেচ্ছাচারী এবং দেবতারা তাঁর প্রজা। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা হোমারের হেফাইটোসের মতো সূক্ষ্ম শিল্পী। নিদ্রা ও স্বপ্নদেবী গ্রিক ছাঁচে গড়া। তাদেরই অনুসরণে ভক্তি, আরাধনা প্রভৃতি দেবীর কল্পনা করা হয়েছে। এক্ষত্রে বায়ুপতি যেন গ্রিক দেবতা এওলাস।
মধুসূদন দত্তের কবিতায় দান্তের বর্ণনার সাদৃশ্যও বিদ্যমান। তিনি অবশ্য মিল্টনের মাধ্যমে দান্তের রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। দান্তের বর্ণিত নরকের প্রবেশমুখে লেখা ছিল : অনধহফড়হ ধষষ যড়ঢ়ব, ুব যিড় বহঃবৎ যবৎব.
আর মধুসূদন লিখেছেন, ‘এই পথ দিয়া-/ যায় পাপী দুঃখদেশে চির দুঃখভোগে,/ হে প্রবেশি, ত্যাজি স্পৃহা প্রবেশ এদেশে।’ বীরাঙ্গানা কাব্যটি ভালোভাবে পড়লে সহজেই অনুমেয় যে, মধুসূদন দত্ত ইউরোপীয় কবি ওভিদের পত্রকাব্য ‘হিরোইদাস’কে অনুসরণ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বিশ্বকবির অনেক কবিতাই ইউরোপীয় সাহিত্যের কাব্যরসে সিক্ত। তাঁর বলাকা কাব্যগ্রন্থে কাব্যের গতিতত্ত্বের সঙ্গে ফরাসি দার্শনিক অঁরি বের্গস-এর ঊষধহ ঠধরঃধষ তত্ত্বের গতিবাদী চেতনার সাদৃশ্য আছে। এই প্রভাবিত হওয়ার ধারণাটিকে আরো স্পষ্ট করে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক টি এস এলিয়টের ‘জার্নি অব দি মেজাই’ কবিতা ‘তীর্থযাত্রী’ নামে অনুবাদ করে ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্র্রন্থভুক্ত করা। এ প্রসঙ্গে কবি তাঁর ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, ‘গীতাঞ্জলির গানগুলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলাম। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে।
সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘তার পরে আমার অনুরোধক্রমে একবার অবনীন্দ্রনাথ এই প্রচেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। আমার মত এই যে, তাঁর লেখাগুলি কাব্যেওর সীমার মধ্যে এসেছিল, কেবল ভাষাবাহুল্যের কারণে তাতে পরিমাণ রক্ষা হয়নিÑ বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ। আর একবার আমি সেই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছি।’ এভাবেই তিনি বাংলায় গদ্যছন্দের প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন এবং পদ্যকাব্যের ভাষা ও প্রকাশরীতির সসজ্জ ও সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথাকে দূরে ঠেলে বাংলা কবিতায় গদ্যছন্দের স্বচ্ছন্দ পদচারণার পথ সুগম করেন। যেমন:
আজ এই বাদলার দিন,
এ মেঘদূতের দিন নয়।
এ দিন অচলতায় বাঁধা।
মেঘ চলছে না, চলছে না হাওয়া,
টিপিটিপি বৃষ্টি
ঘোমটার মতো পড়ে আছে
দিনের মুখের উপর।
সময়ে যেন ¯্রােত নেই,
চারদিকে অবারিত আকাশ,
অঞ্চল অবসর। (বিচ্ছেদ : পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থ)
তিনি তাঁর ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে এলিয়টের ‘প্রিল্যুড’ এবং ‘আন্ট হেলেন’ কবিতা যুক্ত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘উর্বশী’ কবিতার মূলে জড়িয়ে আছে কবি সুইনস বার্গের ‘অ্যাফ্রোদি’ কবিতা। যেমন:
দঅ ঢ়ধৎষড়ঁং মড়ফফবংং ধিং নড়ৎহ;
অহফ ঃযব ধিাবং ড়ভ ঃযব ংবধ ধং ংযব পধসব
ঈষড়াব, ধহফ ঃযব ভড়ধস ধঃ যবৎ ভববঃ,
‘আদিম বসন্তপ্রাতে উঠেছিল মগ্রিন্থত সাগরে...
তরঙ্গিত মহাসিন্ধু মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতো
পড়েছিল পদপ্রান্তে উচ্ছ্বসিত ফণা লক্ষ শত
করি অবনত।’
জীবনানন্দ দাশ : জীবনানন্দ দাশ ইয়েটস-এর অনুরাগী ছিলেন। তাঁর ‘হায়চিল’ কবিতা ইয়েটসের কবিতা দ্বারা প্রভাবিত। যেমন :
দঐব ৎবঢ়ৎড়াবং ঃযব পঁৎষব,ি
ঙ পঁৎষব,ি পৎু হড় সড়ৎব রহ ঃযব ধরৎ
ঙৎ ড়হষু ঃড় ঃযব ধিঃবৎ রহ ঃযব বিংঃ;
ইবপধঁংব ুড়ঁৎ পৎুরহম নৎরহমং ঃড় সু সরহফ
চধংংরড়হ ফরসসবফ বুবং ধহফ ষড়হম যবধাু যধরৎ...
তাঁর ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাও ইয়েটসের কবিতা দ্বারা প্রভাবিত। যেমন:
দঞযব ভধষষরহম ড়ভ ঃযব খবধাবং,
অঁঃঁসহ রং ড়াবৎ ঃযব ষড়হম ষবধাবং ঃযধঃ ষড়াব ঁং,
অহফ ড়াবৎ ঃযব সরপব রহ ঃযব নধৎবষু ংযবধাবং;
এছাড়াও তাঁর ‘ধূসর পা-ুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের ‘মৃত্যুর আগে’ এবং ‘মাঠের গল্প’ কবিতাতেও ইলিয়ট-এর অনুষঙ্গ আছে।
বিষ্ণু দে: ইউরোপীয় কবি টি এস ইলিয়ট যেমন মর্মযাতনা থেকে যুগযন্ত্রণাকে কবিতায় রূপান্তর করেছেন, তেমনি সে উত্তেজনা ও অন্তর্দ্বন্দ্বকে বিষ্ণু দে তাঁর কবিতায় চিত্রায়িত করেছেন। তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কাব্যধারায় কিছুটা সমন্বয়বাদী। তাঁর কবিতায় মার্কসীয় দর্শন বিদ্যমান হলেও তিনি কিছুটা দ্বান্দ্বিক। যেমন:
‘অমর ঐশ্বর্যে বাজে শিল্পীর তন্ময়ধ্যানে সৌন্দর্যে গম্ভীর-
নির্মাণে চঞ্চল ভিড়ে জেগে ওঠে কোনার্কেও মন্দির-শ্মশান।’
বুদ্ধদেব বসু: বুদ্ধদেব বসুর শার্ল ভাষান্তরে অনুবাদকের দায়বদ্ধতার সহজাতগুণ পরিলক্ষিত হয়। তিনি কবিতা পাঠের স্বভাবজাত আনন্দ পেতে কবিতার ভাবের যথার্থ রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতেন। কবিতার তীব্র সৌন্দর্যবোধ আর কোমলতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদক সত্তাকে স্পর্শ করত। শার্ল বোদলেয়ারের বিষাদের কবিতার ভাষান্তর সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বুদ্ধদেব বসু বাংলা ভাষার শব্দ ভা-ারকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজি অনুবাদে বোদলেয়ারের ‘অভিপ্রায়’ থেকে বিচ্যুত হননি। ছন্দের বৈচিত্র্য, চিত্রকল্প, উপমা বা স্তবকসজ্জা ঠিক রেখে অনুবাদ হয় না। অনুবাদ করতে হলে অসাধারণ শব্দজ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। শব্দ ভা-ারকে অর্থবহ করে সাজাতে না পারলে ভাবের অপূর্ণতা থেকে যায়।
শার্ল বোদলেয়ারের ভাষায় বললে, বুদ্ধদেব বসু অনুবাদ কাব্যে ‘মাতাল করে দেওয়ার ঐশ্বরিক শক্তি রাখে!’ বুদ্ধদেবের কাব্যানুবাদে শার্ল বোদলেয়ার-এর কবিতার উচ্চারণ: ‘সুরা, কবিতা, পুণ্যÑ যার দ্বারাই হোক, মাতাল হও!’ তাঁর অনুবাদে শার্ল বোদলেয়ার-এর ‘অচেনা মানুষ’ কবিতাটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য:
‘বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি
সবচেয়ে ভালবাসো?
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে?
পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীÑ কিছুই নেই আমার।
তোমার বন্ধুরা?
ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনোই জানি নি।
তোমার দেশ?
জানি না কোন্ দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।
সৌন্দর্য?
পারতাম বটে তাকে ভালবাসতে- দেবী তিনি অমরা।
কাঞ্চন?
ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ঈশ্বরকে।
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালবাসো তুমি?
আমি ভালবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...
উঁচুতে...ঐ উঁচুতে...
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।’
অমিয় চক্রবর্তী : বাংলা কবিতায় পঞ্চকবির একজন অমিয় চক্রবর্তী। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি করতে গিয়ে ১৯৩৩-১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রাবীন্দ্রিক অনুকৃতি থেকে বেরিয়ে পড়েন কবি। তিনি তাঁর স্বদেশীয় সৌন্দর্য চেতনার সাথে ইউরোপীয় প্রাণময় সৌন্দর্যকে একসূত্রে গেঁথে কাব্য রচনায় মনোযোগী হলেন। তিনি লিখে ফেললেন:
‘চা খাচ্ছি, বেইরুট যাত্রী, কাড়লো মন
ঢেউয়ের শব্দ শোনো সুগন্ধী পাইন কাঠের বাতায়ন...’
তখন অক্সফোর্ডে চলছিল ফরাসিদের উদ্ভাবিত মুক্তক ছন্দ; ঠবৎং ষরনৎব থেকে ঋৎবব াবৎংব এর চর্চা। এ সময় হুইটম্যানের গদ্যভঙ্গির সাথে মিলেমিশে তৈরি হলো হপকিন্সের স্প্রাংরিদম। অমিয় চক্রবর্তী এসব গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন। ফলে তাঁর কবিতার পর্ব বিন্যাস, প্রস্বরের ব্যবহার ও ছন্দাভাস স্বতন্ত্ররূপ ধারণ করল। এই পরিবর্তনের ধারা তাঁর ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থের ‘রাত্রিযাপন’ কবিতার অংশবিশেষ পাঠ করলে সহজেই বোঝা যায়:
‘প্রকা- আমার চাঁদ রাত্রে
গলে হ‘লো সোনা। সোনার পাত্রে
পরে আভাস ছড়ালো অন্তর্লীন রোদ্দুর।
নৌকো দূরে গেল বেয়ে সেই নীল অভ্রের সমুদ্দুর
সেদিন রাত্রে যখন আমাদের বোন কুমুকে হারাই।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মালার্মে’র ভীষণ ভক্ত ও অনুরাগী। পোলভালেরি ও মার্সেল-এর সঙ্গেও তাঁর কাব্যধারার মিল ছিল। তিনি পোলভালেরির রোমান্টিক মনোবৃত্তি সম্পর্কিত অবজ্ঞা, নিঃসঙ্গতা, নির্জীব আবেগ, ধ্রুপদী গাম্ভীর্যকে গ্রহণ করেন। সুধীন্দ্রনাথ এই নিঃসঙ্গতার ধ্রুপদী গাম্ভীর্যকে ধারণ করে টিএস ইলিয়টের ‘দি ককটেল পার্টি’-র আদলে লিখলেন:
অতএব কারো পথ চেয়ে লাভ নেই,
অমোঘ নিধন শ্রেয় তো স্ব-ধর্মেই,
বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।
অন্যদিকে তাঁর রোমান্টিক মনোবৃত্তি সম্পর্কিত অবজ্ঞার আভাস উচ্চমাত্রা পেয়েছে ‘শাশ্বতী’ কবিতার শব্দচয়ন ও বাণী বিন্যাসেÑ
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
একটি পণের অমিত প্রগল্ভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ দিল অবারিত ক’রে... (শাশ্বতী: অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থ)
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন, ‘শিথিল ও অতিভাষী বাংলা ভাষাকে সুধীন্দ্রনাথ দান করেন নির্মেদ ও নির্বহুল এক টানটান ছিলার সংহতি।’
সুধীন দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’ বাংলাকাব্যের প্রেমবিরহের চিরায়ত ধারার সঙ্গে বিশাল ব্যবধান তৈরি করেÑ যা কি না বাংলাসাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘সংবত’। তিনি বইটির মুখবন্ধে লিখেন, ‘মালার্মে প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট। আমিও মানি যে কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ; এবং উপস্থিত রচনাসমূহ শব্দ প্রয়োগের পরীক্ষা রূপেই বিবেচ্য।’ সংবর্তে উত্তপ্ত ও ঝংকৃত সমকাল মূর্তমান হয়ে মানসপ্রিয়া, প্রকৃতি ও রাজনীতি উল্টেপাল্টে একীভূত হয়ে এলোমেলো জীবনকাহিনি নতুনত্ব পেয়েছে। এ নতুনত্ব ‘নান্দীমুখ’ কবিতা দিয়ে শুরু হয় এবং ‘উপসংহার’ কবিতায় সমৃদ্ধ পরিসমাপ্তি ঘটে।
পরিশেষে বলা যায়, ইউরোপীয় কাব্য আন্দোলনের সঙ্গে বাংলার প্রধান কবিদের সংহতি বাংলাকাব্যের নির্মাণ ও ছন্দকলার লুকনো রূপকে বিকশিত এবং বাংলা কবিতার মৌলিক লাবণ্যকে প্রদীপ্ত করেছে। নিয়মসিদ্ধ পদ্যরীতির কাব্যধারা থেকে উত্তর-প্রজন্মকে কাব্যচর্চায় অধিকতর মনোনিবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।