অর্থের খোঁজে
বয়স ষাট পার হওয়া আরিফা অনেকটা পথ হেঁটে রামপুরা সড়কে পৌঁছাল। সাধারণত রিক্সা নিয়ে সে এই রাস্তাতে আসে। আজ রিক্সা নেই। ছাত্ররা কি মাথামুন্ডু দাবি নিয়ে জমায়েত করছে, মিছিল করছে কে জানে। তাই রিক্সাশূন্য, বাসশূন্য রাস্তাঘাট। এই রামপুরা সড়ক থেকেই বাসে চড়ে আরিফা গত বহু বছর মতিঝিল পার হয়ে অফিসে গিয়েছে। এখন ওর কাজ শেষ, ঢাকা শহরের বাসও শেষ হবে শীঘ্রই। বয়স তো অনেক হলো আর কাজ করার কোনো দরকার নেই। নিঃসন্তান বিধবা আরিফা ভাই-ভাবির বাড্ডার বাড়িতে বলতে গেলে জীবন পার করে দিল।
আধা সরকারি চাকরি থেকে কয়েক মাস হলো অবসর নিয়েছে। সব দেনা-পাওনাও বুঝে নিয়েছে। এবার শান্তিতে গ্রামে চলে যাওয়ার কথা। সমস্যা হলো আরেক খাতে কিছু টাকা সে বছর কয়েক ধরে বিনিয়োগ করে রেখেছিল। প্রথম বছর সে টাকার ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার পর তার মনে আনন্দ ধরছিল না। তখন ওই সংস্থার একজন পদস্থ লোক তার সঙ্গে খুব সমীহ নিয়ে কথাবার্তা বললেন। তিনি আরও বললেন আরিফার পরিচিত কেউ যদি লাখ টাকার ওপর ভালো লাভ পেতে চান তাদের সে এখানে যেন টাকা রাখতে বলে। আরিফা তাকে বলেছিল
‘ভাই আমার স্বামীর সৎ পথের পয়সা তাই হয়তো লাভটা সহজে পেয়েছি’
‘এই কথাটাই সবাইকে বলবেন’
আরিফার জমা টাকার ওপর ভালো লাভ পাওয়ার গল্প শুনে ওর অফিসের কয়েকজনও তাদের টাকা এখানে রাখলেন। তারপর আরিফার গল্প মুখে মুখে ছড়াল। সহকর্মীর আত্মীয়-বন্ধুরাও আরিফার অর্থলাভের গল্পে অনুপ্রাণিত টাকা জমা রাখল। যদিও আরিফা কাউকে কখনোই ওই প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখতে বলেনি।
এ বছর আরিফা টাকাটা তোলার জন্য খুব দৌড়াদৌড়ি করছে। তার ভাই মারা গেছেন কোভিডে, তারও আগে ভাইয়ের মেয়েটির বিয়ে হয়ে সে এখন ইতালি না স্পেনে যেন পরবাসী। ভাইয়ের বউ আর আরিফা আছে ঢাকাতে ভাইয়ের নিজস্ব ছোট্ট বাড়িতে।
ইতোমধ্যে আরিফার টাকাটা সুদে আসলে মোটামুটি মন্দ হয়নি। টাকাটা হাতে আসলেই সে সিলেটের মেঘালয় সীমান্তের কাছে নিজের শ্বশুড়ের গ্রামে চলে যাবে। তার ভাবনা হাতের নগদ টাকা খেতের ফসল, বাগানের সবজি, পুকুরের মাছ এসবে আরিফা ও তার ভাসুরপোদের স্বচ্ছন্দে দিন চলে যাবে।
সে তার জমানো টাকা তুলে ফেলবে শুনে অফিসের অন্যান্য যারা টাকা রেখেছিলেন তারাও তাদের টাকা তুলতে আগ্রহী হলেন। তখনই শুরু হলো ওই সংস্থার ধানাই পানাই। দিচ্ছি, দেব বলে তিন মাস ধরে ঘুরাচ্ছে। এখন আরিফার ওপরও ওর অফিসের লোকেরা নাখোশ। প্রায় প্রতি দিন আরিফা অফিসটাতে যাচ্ছে টাকা তুলতে তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ভয় লাগছে। এর মাঝে শুনল ফার্মার্স ব্যাংক ও আরও কিছু সংস্থা মানুষের টাকা ফেরত দেয়নি। সোজা কথা ব্যাংকগুলোর লালবাতি জ্বলেছে।
আরিফা রাজনীতি বোঝে না, আন্দোলনও বোঝে না তবে নিজের সৎ পথের পয়সা সে কড়ায় গ-ায় বুঝে নিতে খুব ব্যগ্র।
রাস্তায় ছাত্রদের ভিড় দেখে সে বিরক্ত ও ভীত। অফিস থেকে ফেরার পথে টুকটাক বাজার সওদা সে মালিবাগ রেললাইনের ওপর বসা বৈকালিক দোকান থেকে করে নিত। রিক্সাওয়ালা, ফলওয়ালা, সবজিওয়ালাও আরিফার পরিচিত আছে। হতাশ লাগছে ভেবে এই হট্টগোলে ওরা কই গেছে কে জানে। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে মিছিলের লেজুর সে ধরে ফেলল। মিছিলের চেহারা জঙ্গী নয়। তবে ভালো করে খেয়াল করে দেখল অনেক সাধারন মানুষও আছে মিছিলে। ছাত্ররা দাবি-দাওয়া নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ পথে নামে। হয় পরীক্ষা পেছানোর দাবি নয় হেন দাবি তো তেন দাবি। দাবির ইয়ত্তা নাই। তবে ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের দাবিটা ছিল খুব জরুরি একটি দাবি। ওই দাবি নিয়ে আন্দোলনটা আরিফার মনে ধরেছিল।
এবারের দাবি কি নিয়ে কে জানে? রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছিল আরিফা। হঠাৎ দেখে সামনে তার পরিচিত সবজিওয়ালা নুরালী। বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী নুরালীর পিঠে হাত দিয়ে ষাটোর্ধ আরিফা জিজ্ঞেস করলÑ
‘আরে নুরালী! তুমি বাবা ছাত্রদের মিছিলে কি কারণে?’
‘আল্লা খালাম্মা আফনেও আইছইন, ছাত্ররা করতাছে চাকরির লাগি আন্দোলন আমরা চান্দাবাজির হাত থাকি বাইচবার লাগি মিছিলে আইছি’
নুরালীর সঙ্গে কথা শুরু করল আরিফা।
‘তুই সন্ধ্যায় রেললাইনে বসে সবজি বেচিস আর সকালে চালাস রিক্সা তোর চান্দা দেওয়ার টাকা কই বল দেখি?’
‘খালাম্মা কইয়েন না আর বদ পুলিশ থাইক্যা রাজনৈতিক ষ-াপা-া সবে আমরার লাহান গরিবগুরবার কলিজা চুইসা চান্দা আদায় করে হেইয়া আপনি জানেন না গো’
‘কিভাবে চান্দা নিতো তোদের কাছ থেকে?’
‘মন কইরেন এক আঁটি শাক পঞ্চাশ টাকায় বেইচলে দশ টাকা দিতে হইতো, পরের দিন শাকের আঁটি পাঁচান্নো টাকা বেচইচতে হইতো।’ কথা বলতে বলতে মিছিল কখন পৌঁছে গেছে মালিবাগের মোড়ে আরিফা খেয়াল করেনি। সবার সঙ্গে হাঁটাতে ক্লান্তিও তেমন লাগছে না। এবার সে নুরালীকে বলল
‘যা দাবি কর গিয়ে। আমি যাচ্ছি টাকা আদায় করতে দোয়া করিস।’
কথা শেষ করে নুরালীর হাতে পঞ্চাশটা টাকা গুজে দিল। দরিদ্র তবে সৎ ছেলে নুরালী। আরিফা ওকে ব্যবসা করার জন্য এক সময়ে কিছু টাকা ধার দিয়েছিল। প্রতি মাসে কিছু কিছুকরে নিয়ম করে ফেরত দিয়েছিল সে। শেষ দুই হাজার টাকা আরিফা নেয়নি। বলেছিল
‘এটা তোর পরিশ্রমের পুরস্কার।’
আরিফা পৌঁছাল সে অফিসে যেখানে তার টাকা প্রাপ্য। পৌঁছানোর পর পরিস্থিতি দেখে ও সমস্ত ঘটনা চিন্তা করে তালুতে আগুন জ্বলে উঠল তার। গতকাল ফোনে এই অফিসের একজন কর্মী ওকে বলেছেÑ
‘আপা আগামীকাল যতটুকু টাকা দেয় নিয়ে নিয়েন, টাকা পয়সা লোপাট করে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা, হাজার কোটি টাকা আপা!’
‘বলেন কি দেশে আইন নাই! টাকা মেরে চলে যাবে বললেই হলো নাকি?’
‘আপা আইন-আদালতকে ওরা কিনে ফেলেছে।’
অফিসের অবস্থা দেখে আরিফা হতভম্ব। অফিসের দারোয়ান বসে আছে এতিমের মতো। অফিস বন্ধ। দারোয়ান জানালো হৈচৈ-গ-গোলের কারণে সাহেবরা অফিস খুলতে পারছে না।
কার কাছে বিচার চাইবে, কে তার টাকা ফেরত পেতে সাহায্য করবে আরিফা জানে না।
আস্তে আস্তে আরিফা ফেরার পথ ধরে। পথে দেখা ওর এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। নিজের অসহায়ত্ব থেকে সে মন খুলে সব তাকে বলল আরও জানতে চাইল তার প্রাপ্য টাকা কিভাবে আদায় হবে।
‘আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ আমার সামান্য নয় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ওরা নাকি বিদেশে চলে গেছে, টাকাটা কিভাবে ফেরত পাব বলতে পারবে ভাই?’
‘শোন তোমার মতো অতি সাধারণ হাজার হাজার মানুষের সামান্য টাকা জড়ো করে হাজার হাজার কোটি হয়েছে সেই টাকা লোপাট করেছে ক্ষমতাবানদের সাহায্য ও সহযোগিতায় তারপর চলে গেছে বিদেশে’
প্রায় কান্নাভেজা গলায় আরিফা বলে উঠল
‘ধরা যাবে না ওদের! ভাই তোমার পরিচিত মন্ত্রী টন্ত্রী আছে তাদের ধরে আমার আর আমার সহকর্মীদের টাকাগুলো উদ্ধার করা যায় না? জান আমার সহকর্মীরা আমার ওপর খুব নাখোশ আমি কেন এখানের খবর ওদের দিলাম ’
‘ওই দেখ রাস্তায় মানুষ নেমেছে নানা ফরিয়াদ নিয়ে।
‘রিক্সাওয়ালা, ফেরিওয়ালা ওদেরও কি টাকা মার গেছে?’
‘ওদের কাছ থেকে ট্রাফিক পুলিশ নেয় চাঁদা, ব্লকে ব্লকে রাজনীতির মস্তান, পান্ডা নেয় হিস্যা। সবাই জ্বলে-পুড়ে খাক হচ্ছে তারাই এখন আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বুঝলে’
‘হায় হায় এত কিছু তো জানতাম না, মনে হচ্ছে সব ভেঙেচুড়ে শেষ করে দেই!’
বন্ধু মিশে গেল প্রতিবাদী মানুষের দলে। ছাত্র, মজুর, রিক্সাচালকদের সঙ্গে অফিস কর্মী আরিফাও পা বাড়াল মিছিলে।
সেই যে আরিফা মিছিলে গেল তার আর ঘরে ফেরা হলো না। সে তার অর্থের খোঁজে মিছিলেই আছে। কেন জানি ওর মাথাও তেমন কাজ করছে না। শুনল নতুন সরকার সবকিছু ঠিক করে দেবে। সে তাই আশায় আশায় সব মিছিলে আছে।
রাস্তায় চলতে কত কিছু যে শুনল। একজন বললÑ
‘জানেন ওই যে দাড়িওয়ালা দরবেশের মতো লোকটা সে সরকার বা জনগণের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এত টাকা নিয়েছে চিন্তা করেও থই পাই না!’
অন্যজন বলছেÑ
‘তবে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। তাই তো তার মেয়েটা অনেক উঁচু বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে!’