বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরলপ্রজ লেখক। তার সাহিত্য বর্ণিণ বিভায় উদ্ভাসিত। তিনি ধ্রুপদি ধারার সাহিত্য রচনা করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিভূতিভূষণ সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট, হাসি আনন্দ, প্রেম, তাদের জীবন যাপনের গল্পগাঁথা দক্ষ কারিগরের মতো পরিস্ফুটিত করেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনায় কাঁচড়াপাড়া হলিশহরের নিকটে মুরাতিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মহানন্দ বন্দোপাধ্যায় মাতা মৃণালিনী দেবী। গল্প রচনার মাধ্যমে কথাসাহিত্যের জগতে তার আবির্ভাব ঘটে।
তার রচিত প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৮ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার মাঘ সংখ্যায়। বিভূতিভূষণ প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাচালি’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। খুব সহজেই পাঠকরা এই উপন্যাসের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে যায়। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তার লেখক জীবনের পরিচিতি ঘটে।
এ উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাস ঘটনা প্রবাহ উপস্থাপন ভঙ্গি আকর্ষণীয় ও অনবদ্য। নর নারীর মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, আনন্দ বেদনা, পাওয়া না পাওয়ার ব্যাকুলতা এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। পথের পাঁচালী, অপরাজিত উপন্যাসে ইন্দির ঠাকুরণের কাহিনী অপু দুর্গার জীবন চিত্র পাঠকের চেতনাকে আলোড়িত করে। পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বন করে সত্যজিৎ রায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন যা আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। মানুষের জীবন প্রবাহ, ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়া, আহাজারি তিনি উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন।
তার উপন্যাসে আকর্ষণীয় অনেক চরিত্রের সমাবেশ তিনি গভীর মমতার সঙ্গে ঘটিয়েছেন। বাহিনীর মাধুর্যতা ও অলংকরণের মিশ্রণের জাদুমন্ত্র দিয়ে তার উপন্যাস গল্পের পাঠকদের তিনি আটকে রাখার পারঙ্গতার পরিচয় দিয়েছেন। সচ্ছল ও উন্নত জীবনের আশায় মানুষের ক্রমাগত শহরমুখী হওয়ার অভিলাষ বিভূতিভূষণ ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ছুটে যায় পুজিবাদী সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনায়। তার উপন্যাসে জীবনমুখিতার পাশাপাশি মৃত্যুর অনুষঙ্গ লক্ষ্য করা যায়।
মানুষকে ঘিরে তার চিন্তাভাবনা ও সুন্দর দর্শন প্রযুক্ত হয়েছে তার উপন্যাসে। মানুষের যাপিত জীবন, হৃদয়বৃত্তি প্রেম দহন তার সাহিত্যে ক্রিয়াশীল। ইন্দির, দুর্গা, হরহর, সর্বজয়া, অপর্ণার মৃত্যু বিভূতিভূষণ তার অনুভূতিপ্রবণ চেতনায় ধারণ করেছেন। চরিত্র সৃষ্টি করে লৈখিক দক্ষতায় কাহিনী বর্ণনা এবং সংলাপের মাধ্যমে তিনি তার উপন্যাসকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন।
উপন্যাসের চরিত্রের ভেতর প্রতিনিয়ত নতুন বোধের জাগরণ ঘটে। তখন কাহিনী নতুন পথে এগিয়ে যায়। সরস্বতী পূজা কিশোর মনকে আলোড়িত করে। এ সময় নীলকণ্ঠ পাখি দেখার জন্য বিকেলের যাত্রা খুব আনন্দময় হয়ে ওঠে। এ যাত্রা তীর্থযাত্রার পুণ্যবাসের চেয়েও অধিক সুখকর হয়ে ওঠে। বিভূতিভূষণ বলেন ‘মূর্খ বালক, পথ তোমার শেষ হয়নি, তোমাদের গ্রামের বাশর বনে।
ঠ্যাঙাতে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলবিতের খেয়াঘাটের সীমানায়... পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে শুধুই সামনে। দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে। সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে। জানার গ-ি এড়িয়ে আত্মপরিচয়ের উদ্দেশ্যে...। এ ধরনের উচ্চারণ পাঠকদের বোধের ভুবন উন্মোচিত করে। হৃদয় বিস্ময় আর আনন্দময় অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। বিভূতিভূষণের কাছে গ্রামীণ জনপদের মানুষ, প্রকৃতি ধরা দিয়েছে।
তার রচিত উপন্যাস অপাজিতা, আরণ্যক, দেবযান এবং গল্প পুইমাচা, নদীবালা, কিন্নরদল, বুধীর বাড়ি ফেরা, দ্রবময়ীর কাশিবাস, এ গ্রামীণ জনপদের দৃশ্যপট মানুষের অন্তর্জগতের নানা ধরনের পরিবর্তনের বর্ণনা মূর্ত হয়ে ওঠে। বিভূতিভূষণ রচনা পাঠকদের চেতনাকে আলোড়িত করে। বিভূতিভূষণ তার উপন্যাসের মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য, দৃষ্টি প্রদীপ, আদর্শ হিন্দু হোটেল, বিপনের সংসার, দুই বাড়ি, অনুর্ববর্তন, ইছামতি, অশনিসঙ্কেত, অনশ্বর। ছোটোদের উপন্যাস; চাঁদের পাহাড়, মরণের ডঙ্কাবাজে, ছোটোদের পথের পাঁচালী, হিরামালিকের জলে, ছোটোদের আরণ্যক, ছোটোদের দেবযান।
বিভূতিভূষণের সাহিত্যে প্রকৃতি ও মানুষ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তার গল্পগ্রন্থ; মৌরিফুল, জন্ম ও মৃত্যু, বেনীগির ফুলবাড়ি, বিধু মাস্টার, অসাধারণ, মুখোশ ও মুখশ্রী, রূপ হলুদ, অনুসন্ধান, ছায়াছবি, নীল গ-েতর, ফালমান সাহেব, কুয়াশার রঙ, মুলোচনা, অলৌকিক বাক্যবদল, ও ভৌতিক গল্প। প্রতিদিনের লিখিত ঘটনার উল্লেখযোগ্য বিবরণ প্রকাশ করেছেন তিনি যেসব গ্রন্থে সেগুলো হলো; স্মৃতিরেখা, তৃণাঙ্কুর, উর্মিমুখর, উৎকর্ণ, হে অরণ্য কথা কও, অন্তরঙ্গ দিনলিপি।
অনুবাদ গ্রন্থ আইনভ্যান হো টমাস বাটার এর আত্মজীবনী। ব্যক্তি জীবনর নানা টানাপড়েন সামাজিক রাজনৈতিক ঘুর্ণি মানুষকে যেভাবে বেদনার্ত করে যেভাবে বদলে দেয় রাষ্ট্রের চেহারা তা তিনি তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন শিল্পিতভাবে। সমাজ সচেতন পর্যবেক্ষণ আধুনিক জীবন জিঙ্গাসা বিভূতিভূষণের সাহিত্যের অন্তর্গত উপাদান। রাষ্ট্র ভাবনা ও সমাজের ভগ্নদশাকে তিনি চিত্রিত করেছেন।
দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের প্রেম, বিরহ, তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা, সরলতা বিভূতিভূষণ গভীর মমতায় তার রচনায় ধারণ করেছেন। প্রতিটি মানুষকেই মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে এ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নেই। এই অনিবার্য সত্যকে উপলব্ধি বরে যাপিত জীবনের আনন্দকে উপভোগ করা এবং বেদনায় দগ্ধ হওয়া বিভূতিভূষণের সাহিত্যে বিধৃত হয়েছে। তার রচনায় জীবনের সঙ্গে জীবনের বহুমাত্রিক মিলনকে প্রত্যক্ষ করা যায়।
বিভূতিভূষণ পথের পাঁচালী এবং অপরাজিতা উপন্যাসের মাঝে যে সব চরিত্রের দুঃখ কষ্টকে তুলে ধরেছেন তা আমাদের হৃদয়কে খুব সহজে স্পর্শ করে যায়। মনে হয় এই সব চরিত্রগুলো আমাদের পরিচিত আপন জন। অপরাজিত উপন্যাসের শেষ ভাগে নিখুঁভাবে জীবন চিত্রের বিবরণী উঠে এসেছে। ‘এক জায়গায় বনের ধারে ঝোপের মধ্যে অনেক লতা গাছের গায়ে লুকাইয়া আছে একটা তেলাকচুর গাছ... একদিন দেখিল গাছটা শিকাইয়া গিয়াছে।
ফলটার বোটাও শুকাইয়া গাছে ঝুলিতেছে, তুলতুলে পাকা সিঁদুরের মতো টুকটুকে রাঙা....যে লতাটা এতোদিন ধরিয়া নকোটি দূরের সূর্য হইতে তাপ সংগ্রহ করিয়া চারপাশের বাঢুম-ল হইতে উপাদান লইয়া মৃত জড় পদার্থ হইতে এ উপাদেয় খাবার তৈরি হরিয়াছিল তাহার জীবনের উদ্দেশ্য শেষ হইয়া গিয়াছে। এ পাকা টকটকে ফলটাই তার জীবনের চরম পরিণতি। বিভূতিভূষণ তার রচনায় শিল্পিতভাবে প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ বর্ণনা করেছেন।এবং সাবলীলভাবে গ্রামীন জনপদের মানুষদের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম, তাদের চাওয়া পাওয়ার প্রকাশ বিভূতিভূষণের উপন্যাসকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
অপরাজিত উপন্যাসে সাঁওয়ালের কয়েকটি বেগুন ও কাঠবিড়ালি ঝলসে খাওয়ার দৃশ্য ফুটে ওঠে। আরণ্যক উপন্যাসে কৃষিজীবী মানুষের বিচিত্র জীবন তাদের আবেগ অনুভূতির পাশাপাশি জঙ্গলে পশুপাখির উপস্থিতি বর্ণনা ভিন্নমাত্র যোগ করেছে। আরণ্যক একটি ধ্রুপদি ধারার উপন্যাস। এটি প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে তা গ্রন্থ হিসাবে প্রকাশিত হয়। চাকরি সুবাদে ভাগলপুর থাকাকালে প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য এবং এখানকার মানুষদের মনোভঙ্গি তাদের বিচিত্র জীবন তার চিত্তে আলোড়ন তোলে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন আরণ্যক রচনার ।
তিনি ছিলেন নিসর্গ প্রেমিক। চাকরি করার সময় অরণ্য পরিবেশে অবস্থানের কারণে বিভূতিভূষণ অরণ্যে পরিভ্রমণ করার সুযোগ পান। তিনি নানা বিষয় পর্যবেঙ্গণে নিমগ্ন হন। অরণ্যের মানুষদের প্রেম, হৃদয়বৃত্তি, তাদের যাপিত জীবন ঘিরে তার আগ্রহ তৈরি হয়।বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসে প্রকৃতির সৌন্দর্য মূূর্ত হয়ে উঠেছে।
বিহারের পূর্ণিয়া জেলায় কুশী আজমাবাদ, লবটুলিয়া, ইসমাইলপুর সংলগ্ন বিস্তৃত অরণ্যময় অঞ্চলটির চিত্ররূপ আরণ্যক উপন্যাসে অঙ্কন করেছন।
প্রকৃতির সৌন্দর্যময়তা, অশিক্ষিত, বন্য, দরিদ্র অসহায় মানুষের জীবন যাপনের আখ্যান নিয়ে রচিত আরণ্যক উপন্যাসটি। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য গ্রামের মায়াময় পরিবেশ সোঁদা মাটির চেনা গন্ধ, সহজ সরল মানুষের জীবন প্রবাহ, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন তিনি নিপুণ কুশলতায় তার সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁর গদ্য প্রতিভা, রচনা শৈলী, কাহিনী বর্ণনা ভিন্নতার কারণে তিনি সাহিত্যে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। বিভূতিভূষণের কালজয়ী উপন্যাস পথের পাঁচালী গ্রামীণ পটভূমিকায় রচিত। বিভূতিভূষণ প্রচলিত ধারাকে পরিহার করে নতুন ধারার সাহিত্য সৃষ্টিতে প্রত্যয়ী ছিলেন। তারই প্রতিফলন আমরা পাই পথের পাঁচালীতে।
সাহিত্যে তিনি স্নিগ্ধ প্রকৃতির কোমল, সৌন্দর্যময় রূপ তুলে ধরেছিলেন। বিভূতিভূষণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি , আকাশ বাতাস, রৌদ্র বৃষ্টি, নদী মাঠ, গাছপালা তার সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন। পথের পাঁচালী তাকে বিখ্যাত করেছে এ কথা অবশ্যই বলতে হবে। এটা তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি পাঠক হৃদয়ে জায়গা দখল করে নিতে পেরেছেন। পরিবার, সমাজ ও দেশ গঠনে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের বিশাল অবদান থাকে। তবু নানাভাবে নারীরা নিগ্রহের শিকার হয়।
বিভূতিভূষণ অবহেলিত নারীদের কাতরতা তুলে ধরেছেন তার সাহিত্যে। সীমাহীন দরিদ্রতা সংসারের সবার জীবনকে দুর্বিষহ করে দেয়। তবু থেমে থাকে না জীবন। অবিরাম সংগ্রামী নারীরা সংসারের চাকাকে সচল রাখতে চেষ্টা করে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত নারীদের সংগ্রামী জীবন কাহিনী বিভূতিভূষণ তার উপন্যাস ও গল্পে সন্নিবেশিত করেছেন।পথের পাঁচালীর সর্বজয়া দুঃখ কষ্টের ভেতর তুলসিতলায় প্রদীপ রেখে পূজা দেয়ার সময় সে সন্তানের কল্যাণ চিন্তা করে “ঠাকুর, নারকোল ওরা শত্তুরতা করে কুড়োতে যায়নি, সেতো তুমি জানো। এ গাল যেন ওদের না লাগে।
দোহাই ঠাকুর, ওদের তুমি বাঁচিয়ে বত্তে রাখো। ওদের তুমি মঙ্গল করো। ওদের মুখের দিকে তুমি চেও। ‘মা সব সময় ঈশ্বরের কাছে সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। সর্বজয়া ইন্দির ঠাকুরণের সঙ্গে শোভন ব্যবহার করতো না সবসময়। সর্বজয়া ইন্দির ঠাকুরণের প্রতি সর্বজয়ার আচরণ ছিলো নিষ্ঠুর ও নির্মম। সর্বজয়া ইন্দির ঠাকুরণকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে তার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারটা দুর্গা ও অপুর মনে ধাক্কা দেয়। দুর্গা ও অপুর জীবনে এ এেকটা কষ্টের অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করে। কিন্তু তাদের মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার জোয়ারে ভাটা পড়ে না একটুও।
নিরুপায় ইন্দির ঠাকুরণের আর্তি ও বেদনা বোধকে বিভূতিভূষণ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। নানির মমতাময়ী অবস্থান চিহ্নিত। তার উপন্যাসের কাহিনী বিষয় গভীরতায় সম্প্রসারিত। পথের পাঁচালী উপন্যাসের কাহিনী অগ্রসর হয় অপুকে কেন্দ্র করে। দূর্গা ও অপুর শৈশব কাহিনী অত্যন্ত সুসজ্জিতভাবে এ উপন্যাসে উপাস্থাপিত হয়েছে। লাবণ্যময় গ্রামীণ প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা আবেগ অনুভূতি ও তাদের শৈশবের স্নিগ্ধ গতিধারার রূপায়ণ ঘটেছে এ উপন্যাসে। অপার আনন্দ ও নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মধ্য দিয়ে অপু দুর্গার কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
দুর্গার মৃত্যু অপুকে প্রচ- আঘাত করে। বোনের মৃত্যুতে ভাই শোকে আত্মহারা হয়ে যায়। পথের পাঁচালী উপন্যাসে শিশু অপুর বড় হয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথের সহযাত্রী যারা তাদের প্রসঙ্গ সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিভূতিভূষণ প্রকৃতি মাটি ও মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে সাহিত্য চর্চায় অগ্রবর্তী থেকেছেন। বিভূতিভূষণ সাহিত্যে মমতাময়ী নারীর ছবি নানাভাবে দুলে ওঠে। উপেক্ষিতা গল্পেও আমরা তাইই দেখতে পাই। নারীর প্রতি সম্মান বোধের অভিব্যক্তির বহির্প্রকাশ ঘটেছে। বিমলের সঙ্গে দেখা মেলে কল্যাণী দিদির। আরব সাগরের তীরে বসে বিমল পল্লীবধূ দিদির ভাবনায় আবিষ্ট থাকে। ‘ওগো লক্ষ্মী ওগো স্নেহময়ী পল্লীবধূ তুমি কি আজো আছো?
মনে আসছে অনেক দূরের যেন কোনো খড়ের ঘর...মিটমিটে কোনো মাটির প্রদীপের আলো মৌনসন্ধ্যা... নীরব ব্যথার অশ্রু শান্ত সৌন্দর্য... হেমন্ত মাখা রাঙা শাড়ির আঁচল...। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৃত্ত থেকে অনেক সময় নারীরা বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে নারীদের অনেক সময় অবহেলা অপমান নীরবে সহ্য করতে হয়। বিভূতিভূষণের রচনায় নারীরা স্নেহ মায়া মমতা আর ভালোবাসায় উদ্ভাসিত হয়েছে।
প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আর মানুষের বিচিত্র বোধ তার জীবন সংলগ্ন রচনায় আবর্তিত হয়েছে। প্রকৃতির নয়ন জুড়ানো দৃশ্য সবুজের সমাহার, দরিদ্র নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা প্রেম, বিরহ, কর্তব্যনিষ্ঠা, বেদনাবোধ, আর্তি বিভূতিভূষণ তার নিবিড় লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্যে তার স্থান অনেক উঁচুতে। বিভূতিভূষণের অনন্য সৃষ্টি, তার সাহিত্যের বিচিত্রতা ও গভীরতা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তার রচনা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।