কবি হেলাল হাফিজ লৌহ
কবি হেলাল হাফিজ লৌহ অভিমানী’ কবি। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই একটা বিশেষ লক্ষ্য অভিসারী। কবির ২০১৯ সালে প্রকাশিত কবিতা সমগ্র ‘এক জীবনের জন্মজখম’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত ৯০টি কবিতা পাঠ করে মনে হলো, এ এক বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র কাব্যসুর। প্রেম-বিরহের বিরল গরল আখ্যান।
এক জীবনের জন্মজখম-বিরহের মহাকাব্য। ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রেমিকবরের এক দহন জর্জরিত বিরহনামা। প্রেম বিপর্যয়ের অমৃত দলিল।
জন্মদাগ যেভাবে মানবশিশু সারাজীবন বয়ে বেড়ায়। কবির জন্মজখম প্রাণপ্রেয়সীকে সারাজীবন না পাওয়ার বেদনা বয়ে বেড়ানো। বোহেমিয়ান বা বাউ-ুলে (মানস জগতে ভবঘুরে) জীবন যাপন। প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা না করে কবি চিরকুমার ব্রতে জীবন পার করলেন। যে¤িœ বাংলাদেশে প্রয়াত কবি জাহিদুল হক। মানবতাবাদী মার্কিন জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান ছিলেন চিরকুমার। হুইটম্যান ছিলেন প্রথাবিরোধী। তবে মানবতাবাদী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শাসক কর্তৃক নির্যাতিত।
এবার কবির কবিতা রাজ্যে প্রবেশ লাভের চেষ্টা করি। প্রথমেই সুবিখ্যাত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ থেকে
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
‘ইচ্ছে ছিল’ শিরোনামে কবিতায় প্রেমের পরাজয় নাকি বিপর্যয়? যখন কবি উচ্চারণ করেন :
ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো/
তোমাকে সম্রাজী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,/
আজ দেখি রাজ্য আছে /
রাজা আছে / ইচ্ছে আছে,/ শুধু তুমি অন্য ঘরে।
কবির জীবনের জন্মজখম এখানেই।
প্রতিমা কবিতায় প্রথম পঙ্ক্তি:
প্রেমের প্রতিমা তুমি, প্রণয়ের তীর্থ আমার।
শেষ পঙ্ক্তিঃ
তুমি জানো, পাড়া-প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে/ অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে।
ভিন্ন মেজাজের একটি কবিতা ‘ভূমিহীন কৃষকের গান’। চিরকুমার কবি যেন যৌবনের সার্থকতা নিয়ে শঙ্কিতঃ
একদিন দিন চলে যাবে মৌসুম ফুরাবে,/ জরা আর খরায় পীড়িত খাঁ খাঁ/ অকর্ষিত ওলো জমি/ কেঁদে- কেটে কৃষক পাবে না।
কবুতর নামের কবিতা পাঠককে পড়ে স্বাদ নিতে অনুরোধ জানাবো। কবির জীবনদর্শন প্রিয়তমাকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন কবুতরের কাঁধে। যে¤িœ কালিদাস তাঁর প্রিয়ার কাছে বার্তা পৌঁছাবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মেঘকে।
‘নেত্রকোনা’ কবিতায় রয়েছে নির্মল কাব্য ভাবাবেগ। এতে মরণকে অদ্ভুত বলে জীবনের প্রতি গভীর মমত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ক্যামোফ্লাজ ছদ্মবেশ ধারণ বা লুকিয়ে যাবার সূত্র। গোপনীয়তা রক্ষার্থে মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করা। অস্ত্র লুকিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে স্বাভাবিক সাজার এ কৌশল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কবি উক্ত কবিতায় বলতে চান, জীবন মরণকে ক্যামোফ্লাজের মতো (ছদ্মাবেশের মতো) আড়াল করে রাখে। প্রিয় জন্মস্থান নেত্রকোনাকে আদরের বোনের সাথে তুলনা করে স্মৃতিতে আত্মস্থ করেছেন কবি।
অভিমান ভুলে প্রাণপ্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হবার প্রবল আকাক্সক্ষার চিত্রল পঙ্ক্তিগুচ্ছ“তুমি ডাক দিলে’। তাছাড়া, হিজলতলীর সুখ, রাখাল, ব্যবধান, কে, অমীমাংসিত সন্ধি, ক্যাকটাস, হৃদয়ের ঋণ, প্রস্থান, ডাকাত প্রভৃতি কবিতা পাঠক নন্দিত বহুল পঠিত কবিতা। বিরহ ও অভিসার আকাক্সক্ষার হৃদয়গ্রাহী কবিতা।
দুঃখবাদকে আত্মস্থ করে বিরহের জপমালা জপেছেন কবি। একাকীত্বের সাধনায় শিল্পসাধনায় উত্তরণের এক অত্যাশ্চর্য সাধক হেলাল হাফিজ। দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪) প্রমুখের সঙ্গে জড়িয়ে যতোই না এ কবির তুলনা খোঁজা হোক। হেলাল হাফিজ নিজেই নিজের তুলনা। স্বতোৎসারিত ঝর্ণার ন্যায় নিখুঁত। জীবন যাপনে এবং কাব্যচর্চায় উভয় ক্ষেত্রে তিনি একান্ত নিজস্ব বৃত্তভিত্তিক।