ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

ন্যায্যতার অস্তিত্ব সংকট

এলিজা খাতুন

প্রকাশিত: ০০:৪০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ন্যায্যতার অস্তিত্ব সংকট

ন্যায্যতার অস্তিত্ব সংকট

সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিরাজমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে সম্পর্কিত। বলার অবকাশ নেই যে, নৈরাজ্য কী ভয়ানক রূপে বিদ্যমান আমাদের দেশ, কাল ও জনজীবনে! একাত্তরে নিপীড়িত মানুষের আশা-আকাক্সক্ষারই স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছিল। আর সেই স্বীকৃতিই জনঅধিকার ও ন্যায্যতার ধারণা। 
একের পর এক শাসনামল এসেছে কিন্তু বাংলার মূলধারা কখনোই আত্মসমর্পণ করেনি, বাংলাকে এগোতে হয়েছে বিদ্রোহ করেই। ইংরেজ চলে গেল, বঙ্গভাগ হলো, উর্দুর দাপট গলা চেপে ধরেছিল বাংলা ভাষার, ভাষা আন্দোলন হলো, মুক্তিযুদ্ধ হলো। ভিনদেশীদের সঙ্গে বারবার বিদ্রোহ। তবে ক্রমশ তীব্র। অভ্যন্তরীণ সংকটও কম নয়। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। আর সম্প্রতি হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। 
বাঙালির অস্তিত্ব-অবস্থান-স্বপ্ন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লেখচিত্র করা না গেলেও শতাব্দীকালের বাঙালিকে প্রকারান্তরে যদি দেখি- হতদরিদ্র-শ্রমজীবী শ্রেণি, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, নারী ও সংখ্যালঘু ভিন্ন ভিন্ন রূপে সমস্যাসংকুল জীবন অতিবাহিত করে আসছে। দৃশ্যত সমস্যাগুলো মাত্রায় তফাৎ, সংজ্ঞায় তফাৎ। কিন্তু অন্তর্বস্তুতে অভিন্ন। 
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলতে গেলে বাঙালি ও বাংলা ভাষা প্রসঙ্গ অপরিহার্যরূপে সম্মুখে আসবে এ আর নতুন কী! এ জাতির সংস্কৃতিকে লক্ষ্য করলে যতটা বৈচিত্র্য ধরা পড়ে, সেসবের সমন্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতি যে স্বতন্ত্র চেহারা পেয়েছে- তা বিশেষত ভাষার স্বকীয়তায়। বাংলা ভাষার। 
এ ভাষা অগ্রসর হয়েছে, পরিণত হয়েছে, গভীর হয়েছে- কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ ছিলই। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এগোতে হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই। এত উত্থান-পতন যুদ্ধ, ঝড়-ঝঞ্ঝা সংকটের পরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও রাষ্ট্রের ওপর কি বাঙালির কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছে!
বাঙালি অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষই বাঙালি। বাংলা তাদেরই ভাষা। ভাষা বলতে কেবল বর্ণ-অক্ষর-শব্দের সম্মিলিত বাক্য নয়, ভাষা মানেই বুকের ভেতরের কথা বলতে পারা। ভাষা মানে অধিকারের দৃঢ় উচ্চারণ। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, পুঁজিবাদী দেশে শ্রমজীবীদের সমস্যা আজন্মকালের। কৃষক ভূমিহীন হয়েছে। ফলে, তারা ভিটেমাটি ছেড়ে জীবিকার জন্য শহরে পাড়ি জমিয়েছে উদ্বাস্তু হয়ে। শহরে তাদের ভূমিগৃহ কোথায়! তাদের ভাসমান জীবন যাপন বস্তিতে। অন্যদিকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ভাগ করেছে মানুষ ও মাটিকে। রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ধর্মের অপব্যবহার বিচ্ছিন্ন করে তুলছে বাঙালিত্ব থেকে। 
বাংলাদেশ ও বাঙালির বর্তমান দুর্দশার কারণ এক ও অভিন্ন। কতিপয় ক্ষমতাসীনের সীমাহীন ভোগবিলাস। বাঙালিপনা যেটুকু অবশিষ্ট তা ভাতে; আমরা অধিকাংশ জনগণ মোটা চালের ভাত খাই বলেই বলছি। যেটার সঙ্গে কৃষকের প্রত্যক্ষ সংযোগ। কৃষকের মুক্তি ছাড়া দেশের মুক্তি নেই। অথচ এ দেশে মাঠের ধান ঘরে তোলার খরচের চেয়ে ধানখেত আগুনে পুড়িয়ে কৃষককে মুক্ত হতে হয়। কৃষকের শত্রু যে সামন্তবাদ, তারই রক্ষাকর্তা সাম্রাজ্যবাদ। 
বছরের পর বছর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করার জন্য নানা শ্রেণির গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার গোষ্ঠী থাকেনি কখনও। সামাজিক রাজনৈতিক সকল অসঙ্গতির প্রতিফলন দেখা যায় প্রতিবার বাংলাদেশের নির্বাচিত জাতীয় সংসদের অবস্থার মধ্যে। যেন নির্বাচনের একমাত্র মুখ্য কাজ কোনো একটা সরকারকে গদি পাইয়ে দেয়া। সেই সঙ্গে অগ্নিসংযোগ, হত্যা, জবরদখলের বীভৎসতার প্রতিযোগিতা! এ দেশে ওপরতলার দুর্নীতি গড়াতে গড়াতে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বস্তরে। 
যে সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ নিমজ্জিত; মুক্তিযুুদ্ধ পরবর্তী দেশের একের পর এক শাসকশ্রেণি ধনিকশ্রেণি হিসেবে লুটতরাজ, চোরাচালান, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি অপকর্মের মাধ্যমে সৃষ্টি হলেও, তার গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যেই ভাঙনের শর্ত নিহিত ছিল, ফলাফলস্বরূপ দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক অবস্থা ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে। 
সমস্যাটা কোথায়? বৈষম্য। মূল বৈষম্যটা হচ্ছে ধনী দরিদ্রের। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ লিঙ্গবৈষম্য ইত্যাদি এইসব বিভাজন খ- খ- চিত্র।

পুরুষের চেয়েও বড় পুরুষ আছে, সেটা হচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থা; পুুঁজিবাদের। যে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে, সেখানে পুরুষও বন্দি। নারী পুরুষ উভয়েই বন্দি। এইসব বিভাজনে প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহকে বৈষম্যের আওতায় ফেলে উস্কানি সৃষ্টি করা পুুঁজিবাদের এক ধরনের কৌশল। এই বৈষম্যের হট্টগোলে গোটা দুনিয়াকে ভাঙনের খেলায় ডুবিয়ে রাখা তাদের পক্ষে খুুব সোজা। 
বিশ্বব্যাপী জাতি ধর্ম বর্ণ নিয়ে যে সংকট, বাংলাদেশেও তার স্বরূপ প্রকট। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও দুুর্বল দেশকে অতীত হতে এখনও অব্দি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ভোগদখলের প্রতিযোগিতা। কারা করছে? ঘুরেফিরে সেই কাহন! পরিবেশকে মানবিক করে তোলার নিমিত্তে উন্নয়ন করবে কি, দিনের পর দিন অবাধ লুটের সুযোগ সৃষ্টি করেছে আমলারা- রাজনৈতিক আশ্রয়কে ব্যবহার করতে পারার মধ্য দিয়ে। ব্যাংকের জনগণের সঞ্চিত টাকা বিত্তবান ব্যবসায়ী, ধনিক ঋণখেলাপিদের হাতে। ঔপনিবেশিক শাসকরা যে কাজ করতো, বাংলাদেশের ধনীরা একই কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশ এখন বাংলাদেশী ধনীদের উপনিবেশ। 
বলা যাবে বাঙালী মনস্তাত্ত্বিকভাবেও উদ্বাস্তু। অস্বীকার করবার জো নেই যে- দারিদ্র্যের সঙ্গে মৌলবাদের যোগসূত্র আছে। এ কথাও ঠিক- দারিদ্র্যের সংজ্ঞা আপেক্ষিক; দারিদ্র্য তো আজকের নয়, যুগযুগান্তের। এই অন্তহীন দারিদ্র্য ব্যক্তির জীবনে এমন অভ্যাস তৈরি করে রেখেছে যে, ঈর্ষা অবিশ্বাস ক্ষুদ্র স্বার্থের কলহ ঝগড়া ফ্যাসাদ নিত্য সঙ্গি হিসেবে পর্যবসিত। কাজেই দারিদ্র্য যখন সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাকে কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটেনি। দরিদ্র মানুষের ভরসা করার মতো আশ্রয় কোথায়? ন্যায়বিচার কোথায়? ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি কোথায়? কতভাবে উদ্বাস্তু! 
তো অভাব, দারিদ্র্য, দুরবস্থা... এইসব অত্যন্ত কঠিন ও জটিল ব্যাধির জন্য দায়ী কী? নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না, তা হলো- অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রভাবশালীর দুর্নীতি, ধনীর ভোগবাদিতা। পুঁজিবাদী বিশ্ব জিঁইয়ে রাখতে চায় এ ব্যাধি। সাম্প্রদায়িকতা ঘোচানোর চেষ্টাও নেই। তার গভীরতর কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদই মৌলবাদের বিকাশের প্রধান উৎস। মানুষ ধর্মপ্রাণ, অদৃষ্টে বিশ্বাসী। কিন্তু সে বিশ্বাসের অন্তরালে যে প্রচ- অবিশ্বাস লুকিয়ে আছে, সেটা অসত্য নয়। ধর্মে আস্থা রাখার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে জগতের প্রতি আস্থাহীনতা। অধিকাংশ মানুষ সংকটকালে দৈব শক্তির উপরে ভরসা করে। 
আমাদের সংস্কৃতিতে বিবিধ মানবিক গুণ রয়েছে। যেমন- সামাজিক প্রীতি, ধর্মে-বর্ণে অসাম্প্রদায়িকতা। এ কথা জোর দিয়ে বলবো- মানুষ মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কেননা, পুুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অবস্থা কোনোটিই সংঘবদ্ধতা চায় না। চায় বিচ্ছিন্নতা। বিশ্বায়ন কি বাংলাদেশকে বিশ্বের দিকে নিচ্ছে? না-কি পুুঁজিবাদী বিশ্বকে আমাদের দেশে আনাচে-কানাচে ঢুকিয়ে দিয়েছে দিনের পর দিন! 
বিগত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জাতি গঠন বিষয়ক নানা কথা হয়েছে, কিন্তু বড় সত্য হলো- জাতি নয়, গঠিত হয়েছে শ্রেণি। যে জিনিসটা খুবই দর্শনীয়রূপে ঘটে এসেছে, তাহলো বিদেশে গমনরীতি। শ্রমজীবীরা বিদেশে গেলে ক্ষতি নেই, বরং লাভ। কেননা, তারা অর্থ পাঠাবে বিদেশ থেকে। ক্ষতি বিত্তবানদের যাওয়াতে। এরা বিদেশে গিয়ে দেশের টাকায় বাড়ি কেনে। 
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মর্মান্তিক সত্য যন্ত্রণা- আকাশে উঠতে থাকা দ্রব্যমূল্য। মূল্য যতই বৃদ্ধি পাক কতিপয় বিত্তবানের ভোগবিলাসে বাধা পড়ে না। 
এই যে উন্নতির ধারা, এরই প্রতিফল হচ্ছে বৈষম্য ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি। দেশে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে, আর অধিকাংশ মানুষই নিজেকে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্রব্যের এই উচ্চমূল্যের বাজারে অভাব যে কত মাত্রায়, কত গভীরে বেশিরভাগ মানুষ টের পাচ্ছে। 
প্রথমেই ধরি যদি উৎপাদন কম হয়, তাহলে উৎপাদনের প্রধান অন্তরায় কী এবং কারা? অবশ্যই দরিদ্র মানুষ নয়। দরিদ্র মানুষ পরিশ্রম করতে চায়। অভাব শ্রমের নয়, অভাব হলো পুঁজির। আমাদের অর্থনীতি পুঁজিবাদী কিন্তু এখানেও পুঁজিরই অভাব। অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত কম। যখন যেটুকু উদ্বৃত্ত থেকেছে- তা কেবল অধিপতি শ্রেণির জন্য কোটি কোটি টাকার ভবন নির্মাণে। তার মানে উৎপাদনের রাজনীতি অনুৎপাদক শ্রেণিকে দিয়ে হবার নয়। 
সবকিছুকে ব্যক্তিগত মালিকানায় তুলে দেবার যে ব্যবস্থা বা সুপারিশ বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অনবরত করেছে, ক্রমশ সেই নীতিতে বাংলাদেশও দীক্ষিত। ব্যক্তিগতকরণের উন্মত্ততায় সমষ্টিগত কাজ তলানিতে। বিপন্ন মানুষের দুঃখ নিরসনে মানবাধিকার সংগঠন, সিভিল সোসাইটি, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও অনেককিছু তৎপর, কিন্তু তারা কেউই ভোগবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়। তাদের কাজ এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করা। শোষণ আগেও ছিলো, কিন্তু গত দীর্ঘ সময়ের মতো সুনসান নীরব থাকার নজির নেই ইতিহাসে।

আনন্দ সমাগম হোক কিংবা বিবাদে-বিতর্কে মানুষ ভিড় করেছে ঠিকই, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। দীর্ঘ নীরবতায় মনে হয়েছে, বাঙালি বাংলাভাষা ভুলে গেছে। দিনের পর দিন চুপ থেকেছে। যদি চাকরি চলে যায়, যদি কর্তাবাবুরা বিরূপ হয়! অথচ কত অজ¯্র কথা বাঙালির বলবার কথা!
একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধ কেন হয়েছিল? স্বাধীনতা হলো সুরক্ষিত হবার অধিকার। দেশ, দেশের সম্পদ ও দেশের জনগণের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবার অধিকার। দেশের সকল শৈশব, তারুণ্য সুরক্ষার অধিকার। প্রতিটি মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, জ্ঞান অর্জন করার এবং বিকশিত হবার অধিকার। ব্যক্তি নয়, সমষ্টির সার্বিক উন্নয়নের অধিকার। দানবীয়তা, হীনম্মন্যতা, প্রতিহিংসা-লোভকে ঘৃণা করার অধিকার। লুটেরা, ধোঁকাবাজ, মিথ্যাচারীকে প্রতিহত করার অধিকার।

স্বাধীনতা হলো দেশের মানুষের ভূমির অধিকার। সামষ্টিক এবং সার্বিক উন্নয়নের জন্য ভূমির যথোপযুক্ত ব্যবহারের অধিকার। সম্পদ উৎপাদন, আহরণ, সুষম বণ্টন ও প্রাপ্তির অধিকার। উৎপাদক শ্রেণির মুনাফার অংশ প্রাপ্তির অধিকার। জনস্বার্থে অনুৎপাদনশীল প্রমোদকে প্রতিহত করার অধিকার। ভোগবাদীদের, মজুতকারীদের, যথেচ্ছাচারকারীদের মিথ্যা প্রপাগান্ডার শাস্তি বিধানের অধিকার। জ্ঞান প্রসারের সকল মাধ্যমকে মুক্ত রাখার অধিকার।

সকল মানুষের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভা বিকাশের পথ প্রশস্ত রাখার অধিকার। এই সকল অধিকারই- মানুষের সুরক্ষিত হবার অধিকার। এই সুরক্ষা নিশ্চিৎ করবে সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা। বহিঃশত্রু, বহির্বিশ্বের কূটচাল কিংবা আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সশস্ত্র বাহিনী জাগ্রত থাকবে, তারাও পাবেন জাতীয় সুরক্ষা। যুদ্ধ ছিল নিশ্চিতভাবে অন্ন, বস্ত্রের অধিকার। যুদ্ধটা ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ। 
ভাবতেই দুঃখ হয় ক্ষোভ হয়- একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, বিদেশী ডাকাতরা প্রকাশ্যে চলে গেছে। কিন্তু দেশী লুটপাটকারীরা থেকে গেছে। নতুন করেও আবির্ভূত হয়েছে। সংখ্যা বেড়েছে। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। এক অংশ ক্রমাগত সুযোগ নিয়েছে, অন্য অংশ ক্রমাগত বঞ্চিত হয়েছে। একাত্তরের পর বাঙালি আর ঐক্যবদ্ধ নয়, সে বিভক্ত। ঐক্যবদ্ধ ছিল না বলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।

কাদের জন্য করা দেশের নিয়মনীতি? বাংলাদেশের সমস্যা গরিবরা নয়, যদিও সেভাবে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের সমস্যা  ধনীরা। যাদের বোঝা বহন করতে গিয়ে অর্থনীতি ক্রমাগত ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। ঐ যে ধনীকে ধনী করা আর গরিবকে গরিব করার নীতি। এখানেই বৈষম্য। মুক্তিযুদ্ধের এ এক ঐতিহাসিক, প্রায় অবিশ^াস্য পরাজয়। রাষ্ট্র ভাঙলো, শোষণ ভাঙলো না। কর্তাব্যক্তিদের লুণ্ঠন (ভূমি, আকাশ, নদী, বন সব) অত্যন্ত ভদ্রভাবেই হয়েছে ব্যাংকের মারফতে। 
বাহাত্তর সালের পর থেকে বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে। সবকিছুই ঐ ব্যবস্থার খপ্পরে। আমলারা কেবল যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পছন্দ করেছে তা নয়, তারও আগে তারা নিজেদেরটা গোছাতে ভালোবেসেছে। 
আশা মানুষের স্বভাবজাত। আজ যা দৃশ্যমান, কাল তা কোনোভাবেই একইরকম থাকবে না। সময়ের মতোই সমাজ ব্যবস্থা এবং তার সংস্কৃতি প্রবহমান নদীর মতো।

নিয়ত পরিবর্তনশীল। এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কীসের রাজনীতি করে, কিছুদিন আগেও তা নিয়ে মনে সংশয় বিরাজ করেছে। কিন্তু এখন যে তারা দেশের কথা ভাবছে, অধিকারের কথা ভাবছে, সেটা গাছের আধমরা শিকড়ে জল পাইয়ে দেওয়া। 
তারুণ্যকে উপেক্ষা করে আমাদের না সম্ভব এগুনো, না সম্ভব আশাবাদী হওয়া। দেশের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ তরুণ। তরুণদের রাজনৈতিক ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তরুণদের জীবনে রাজনীতি বা রাজনীতিহীনতা যে প্রভাব ফেলে, তা অনুধাবন করাও অত্যাবশ্যকীয়। রাজনীতি করা আর রাজনৈতিক জ্ঞানে ঋদ্ধ হওয়া- দুটো বিষয় তো এক নয়! তফাৎ আছে। 
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ২০২৪-এর অভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। কিন্তু প্রক্রিয়াগত দিক থেকে ভাবলে এটা ছাত্রদের/শিক্ষার্থীদের অভ্যুত্থান। ছাত্র-আন্দোলন না হলে এবং ‘ছাত্র’ মারা না গেলে এ শোক এবং প্রতিরোধ এত সর্বব্যাপী হতে পারত না। 
হলগুলো থেকে প্রায় সব শিক্ষার্থী যখন হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো, ভিন্নমাত্রা পেলো আন্দোলনের সর্বজনীনতা। বলার অবকাশ থাকে না, আন্দোলন তার সবচেয়ে কার্যকর চিত্রটি পেয়ে গেছে আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে গুলির সামনে এগিয়ে যাওয়া। ১৭/১৮ জুলাইয়ের পরে আন্দোলন রুখবার কোনো উপায় ছিল না সরকারের হাতে। অন্যদিকে এ আন্দোলনের সঙ্গে দেশের প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠী একাত্ম হয়ে ওঠার পেছনের কারণস্বরূপ- প্রথমত, ঢাকা ও বাংলাদেশের নাগরিক-মধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তৈরি। দ্বিতীয়ত, ব্যাপক প্রাণহানির মধ্য দিয়ে খুনি শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের সর্বশেষ পরিচয় জাতির সামনে উন্মোচিত করা। 

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান যে সফল হবে তা আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকা-ের পরেই ধারণা করা যাচ্ছিলো; সেটা শাসকপক্ষের বোধগম্য হয়নি। কোটা আন্দোলনের বদলে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ নামের অন্তর্গত বিস্তার খুব সহজেই শাসকগোষ্ঠীর তৈরি করা সার্বিক বৈষম্যকে ধারণ করতে পেরেছে। ফলে, সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তা দ্রুত এক দফায় উন্নীত হয়। সেই সঙ্গে অগণতান্ত্রিক শাসককুলের মনোভাব ও উচ্চারণভঙ্গি আন্দোলনে আরও দ্রোহ জ্বালিয়ে দিয়েছে।

কেননা, দুঃশাসনের দৌলতে সমাজে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল আগে থেকেই। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গোটা দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সাধারণ জনতার একাত্মতা প্রকাশ- এই গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে স্বৈরাচারের নিশ্চিত পতন। 
রাষ্ট্রের যে সংস্কারগুলো স্বপ্নগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা করতে চাইছেন, তাতে যুক্ত হয়ে গেছে সাধারণ জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা এবং কর্মোদ্যোগ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা যখন ব্যস্ত, এরই মধ্যে কিছু ন্যক্কারজনক ঘটনা আমরা ঘটতে দেখি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনকালীন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মবিরতিতে যারা ভাঙচুর-লুটপাট এবং হামলা চালিয়েছে, তারা যে সুযোগসন্ধানী লুটেরা বলার অপেক্ষা থাকে না। 
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা আসলেই পূরণ হবে কতটা, তা সময়ের বিষয়। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, তারা একটা বৈষম্যহীন সমাজ তথা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে কোনো সরকার চাইলেই ফ্যাসিস্ট হতে পারবে না। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে যুক্ত পেশাজীবীরা এবং জনসাধারণ ঐক্য ধরে রাখতে পারবেন কতটুকু- এ প্রশ্নও বিরাজ করছে জনতার ভেতরে। কারণ, আমাদের প্রবণতায় ব্যক্তিস্বার্থ শিকড় গেড়ে বসে আছে। ছাত্রদের এই আন্দোলন সিস্টেমের বিরুদ্ধে, যা বরাবরের মতো দমন পীড়ন দিয়ে বন্ধ করা যায়নি।

যারাই দানব হয়ে উঠবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের রোধ করতে বারবার উঠে দাঁড়াবে, অর্থাৎ রাষ্ট্র মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা, মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে- এমনই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরতে চায় সাধারণ জনতা। এই অভ্যুত্থান নিয়ে বিস্তারিত লেখার প্রয়াস থাকবে আগামীতে। বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে কি এবার!? ধনী ও দরিদ্রের আকাশ-মাটি ব্যবধান ঘুচবে কি!! অপেক্ষায়... 

×