ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন

হীরেন পণ্ডিত

প্রকাশিত: ২২:৩৩, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন

আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অসামান্য সুন্দর এই সৌধটি  তৈরি করা হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে

আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অসামান্য সুন্দর এই সৌধটি  তৈরি করা হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি ধরে রাখতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন। ইট, লাল রংয়ের পাথর এবং সাদা মার্বেলের তৈরি সৌধটিজুড়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য আর শিল্পকলা সারা পৃথিবীর মানুষকে মুগ্ধ করেছে। সম্রাট শাহজাহান অনেক সময় যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে তাজমহলে আসতেন। সিঁড়িবাঁধা একটি ঘাটে নেমে তাজমহলে ঢুকতেন তিনি।
তাজমহলের নিচে ভূগর্ভস্থ ঐ কক্ষগুলো  তৈরি করা হয়েছিল তাহখানার অংশ হিসেবে। মোগলরা গরমের মাসগুলোতে শরীর শীতল রাখতে এমন ভূগর্ভস্থ কক্ষ  তৈরি করত। এটা নিশ্চিত যে, স¤্রাট যখন এই সৌধে আসতেন তখন এসব প্রশস্ত, সুন্দর এবং শীতল কক্ষ ছিল তার সহযোগীদের এবং তার নারীদের আদর্শ বিশ্রামের জায়গা।
ভারতীয় প্রতœতত্ত্ব সংরক্ষকগণ ২০ বছর আগে তাজমহলের ভূগর্ভস্থ একটি অংশে ঢুকেছিলেন। সেখানে গিয়ে চমৎকার কারুকার্যে মোড়া একটি করিডরের সন্ধান পেয়েছিলেন। ঐ করিডর দিয়ে প্রশস্ত একটি চত্বরে যেতে হয়। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় সম্রাট এই করিডরে গিয়ে ঢুকতেন।

দিল্লিতে ইতিহাসবিদ রানা সাফাভি, যিনি আগ্রায় বড় হয়েছেন, তিনি বলেন, ১৯৭৮ সালে এক বন্যার আগ পর্যন্ত তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে পর্যটকরা যেতে পারতেন। একবার বন্যার পানি তাজমহলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। পানি নামার পর মাটির নিচের ঐ ঘরগুলোর মেঝেতে পলির আস্তরণ পড়েছিল। দেওয়ালে, মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। তারপরই কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য ঘরগুলোতে ঢোকা বন্ধ করে দেয়। ওগুলোর ভেতর কিছুই নেই। 
অনেক পুরনো সৌধের মতো তাজমহলকে ঘিরেও অনেক গল্প, জনশ্রুতি রয়েছে। যেমন, কথিত রয়েছে যে, শাহজাহান মূল তাজমহলের ঠিক উল্টোদিকে একটি ‘কালোরঙের তাজমহল’ বানাতে চেয়েছিলেন। এমন বিশ্বাস রয়েছে, তাজমহলের স্থপতি ছিলেন একজন ইউরোপীয়। অনেক পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সময় বলেছেন যে, মুসলিম সমাজে নারীদের নিচু অবস্থান ছিল। তাতে এটা অসম্ভব যে শাহজাহান তাঁর মৃত স্ত্রীর স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখাতে তাজমহল  তৈরি করেছিলেন। 
তাজমহল নিয়ে জনমনে কৌতূহলের শেষ  নেই। তাজমহলকে সত্যিকারের ভালোবাসার এক প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যমুনা নদীর তীরে অসামান্য সুন্দর এই সৌধটি  তৈরি হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি ধরে রাখতে তাজমহল  তৈরি করেছিলেন। ১৯৮২ সালে তাজমহলকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে ইউনেস্কো। তাজমহল শুধু ভারত নয়, সারাবিশ্বের মধ্যেই পর্যটনের অন্যতম প্রধান একটি আকর্ষণ। 

ভারতীয়, ফরাসি ও ইসলামিক শৈলীর স্থাপত্যের সংমিশ্রণে নির্মাণ করা হয় তাজমহল। তাজমহলের স্থপতির নাম আহমেদ লাহৌরি। তাজমহল নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। টানা ২২ বছর ধরে তারা সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে নির্মাণ করেন এই স্মৃতিস্তম্ভ¢। তাজমহল নির্মাণে খরচ হয় প্রায় ৩২০ মিলিয়ন রুপি। তাজমহলে ব্যবহৃত মার্বেল পাথর রাজস্থান, তিব্বত, আফগানিস্তান ও চীন থেকে আনা হয়েছিল।

দিনের বিভিন্ন সময় তাজমহলকে ভিন্ন রঙে দেখা যায়। অনেকের ধারণা, এই পরিবর্তিত রংগুলো নারীর পরিবর্তনশীল মেজাজকে চিত্রিত করে। তাজমহল বিশ্বের সেরা বিস্ময়গুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে চিহ্নিত। তাজমহল প্রাঙ্গণে একটি মসজিদ আছে। তাজমহল শুক্রবারে বন্ধ থাকলেও নামাজ পড়তে যাওয়া ব্যক্তিদের তাজমহলের ভেতরে অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯ শতকের শেষের দিকে তাজমহল ব্রিটিশ  সৈন্যদের দ্বারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।

স্মৃতিস্তম্ভের দেওয়াল থেকে মূল্যবান পাথর বের করা হয়েছিল। তাজমহলের ৪টি মিনার একটু বাইরে  তৈরি করা হয়েছে। যাতে মিনারগুলো পড়ে গেলেও মূল কাঠামোতে আঘাত লাগবে না। 
তাজমহলকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আপনাকে জুতোর ওপর কাপড়ের বানানো বিশেষ জুতা পায়ে প্রবেশ করতে হবে। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। সারিবদ্ধভাবে মমতাজ বেগম ও শাহজাহানের কবর জিয়ারত করতে হবে।

আকারে শাহজাহানের কবরের চেয়ে মমতাজ বেগমের কবর একটু বড়। তবে নিরপত্তা ব্যবস্থা খুব চমৎকার।  সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার নিদর্শন আজো দৃশ্যমান সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে। তাজমহল দাঁড়িয়ে আছে বিশে^র সপ্তম আশ্চর্যের একটি হয়ে।
তাজমহল শুধু একটি স্মৃতিস্তম্ভ নয় এর চেয়ে বেশি; এটি প্রেম এবং দুঃখের একটি গভীর অভিব্যক্তি। এটি শোকাহত সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয় বেগম মমতাজ মহলের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন। এই দম্পতি, যাদের চৌদ্দ সন্তান ছিল। তার পরের সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন মমতাজ বেগম। যার কারণে মমতাজ বেগম মারা গেলে সম্রাট শহাজাহান একটি করুণ পরিণতির সম্মুখীন হন।

শোকে কাতর ও আবেগতাড়িত শাহজাহান তার আবেগকে একটি স্মৃতিস্তম্ভে¢ রূপান্তরিত করেছিলেন যা তার স্ত্রীর প্রতি তার অবিরাম ভালোবাসার প্রমাণ হিসাবে আজো দাঁড়িয়ে আছে। তাজমহল। একটি বিশ্বব্যাপী খ্যাত সাদা মার্বেল পাথরের সমাধি, স্থাপত্য নকশার এক বিস্ময়।
 মোগল বাদশাহ শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মরণে নির্মিত এই মাস্টারপিসটি মানুষের সৃজনশীলতা ও নিষ্ঠার প্রমাণ।

তাজমহলের স্থাপত্য সৌন্দর্য অতুলনীয়, কঠিন পদার্থ এবং শূন্যতা, অবতল এবং উত্তল উপাদান এবং আলো ও ছায়ার পারস্পরিক সংমিশ্রণ। এর খিলান এবং গম্বুজগুলো এর নান্দনিক আবেদনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এটিকে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন করে তুলেছে। তাজমহল হলো প্রেম এবং স্থাপত্যের উজ্জ্বলতার এক অত্যাশ্চর্য প্রতীক। ১৬৩২ সালে  মোগল সম্রাট শাহজাহান তার প্রয়াত স্ত্রী মমতাজ মহলের দেহাবশেষ রাখার জন্য এটি স্থাপন করেছিলেন।
ভারতীয়, ফরাসি এবং ইসলামিক স্থাপত্য রীতি দ্বারা প্রভাবিত তাজমহল সমাধিটি সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি, যার রং দিনের সময় অনুসারে পরিবর্তিত হয় বলে মনে হয়। সমাধি কমপ্লেক্স প্রায় ১৭ হেক্টর এবং ৪২ একর বা প্রায় ২০টি বড় ফুটবল মাঠজুড়ে বিস্তৃৃত। শাহজাহান ছিলেন পঞ্চম  মোগল সম্রাট এবং ১৬২৮ থেকে ১৬৫৮ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন।

যখন তার তৃতীয় এবং প্রিয় স্ত্রী মমতাজÑপারস্যের আভিজাত্যের রাজকন্যা এবং আগ্রার বাসিন্দা মারা গেলে, শাহজাহান এতটাই শোকে কাবু হয়েছিলেন যে তিনি এই স্থাপত্যশৈলীর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তাজমহল তার প্রতি তার অবিরাম ভালোবাসার প্রমাণ হিসাবে। তাজমহল সংলগ্ন, একই কমপ্লেক্সের মধ্যে আরও কয়েকটি সমাধি রয়েছে যেখানে শাহজাহানের অন্যান্য স্ত্রী এবং প্রিয় দাসদের সমাধিস্থ করা  হয়েছে।
এটি তাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা এবং চিন্তাশীলতার প্রমাণ। কালো তাজ, কালা তাজ বা দ্বিতীয় তাজ নামেও পরিচিত, একটি কিংবদন্তি কালো মার্বেল সমাধি। কথিত আছে যে, শাহজাহান মমতাজ মহলের প্রতি তার ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি হিসাবে তাজমহলের বিপরীতে যমুনা নদীর ওপারে এটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। শাহজাহান এই কালো মার্বেল সমাধিটিকে নিজের জন্য একটি সমাধি হিসেবে নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানা যায় এবং তিনি চেয়েছিলেন যে দু’টি কাঠামো, কালো তাজ এবং মমতাজ মহলের জন্য তিনি যে তাজ নির্মাণ করেছিলেন, সেটি একটি সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত করা হোক।

ইতিহাসবিদরা এখনো এই দাবির  বৈধতা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। যদিও আগ্রার লোকেরা, যাদের পরিবার  মোগল আমল থেকে সেখানে বসবাস করে আসছে, তারা আজও কালো তাজের কিংবদন্তিকে অব্যাহত রেখেছে।
অনেক লোক বিশ্বাস করে যে প্রতœতাত্ত্বিকরা কালো তাজের প্রমাণ খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ শাহজাহানের পুত্র, যিনি তাকে উৎখাত ও বন্দী করেছিলেন, তা ভেঙে ফেলেছিলেন। তাজমহলকে ১৯৮৩ সালে ‘ভারতের মুসলিম শিল্পের রতœ এবং বিশ্বের ঐতিহ্যের সর্বজনীনভাবে প্রশংসিত মাস্টারপিসগুলোর মধ্যে একটি’ হওয়ার জন্য ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান মনোনীত করে। অনেকে এটিকে  মোগল স্থাপত্যের সর্বোত্তম উদাহরণ এবং ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রতীক বলে মনে করেন।

তাজমহল, ভারতের সবচেয়ে বিশিষ্ট স্মৃতিস্তম্ভ, ভালোবাসার একটি চিরন্তন প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাজমহলের স্রষ্টা  মোগল সম্রাট শাহজাহান বলেছিলেন, এটি ‘সূর্য এবং চাঁদ তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরিয়েছে।’
জনশ্রুতি আছে যে, শাহজাহান নিজের জন্য একটি কালো মার্বেল তাজ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। আগ্রায় নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের জন্য এক হাজার হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল। তাজমহলের রং সারাদিন প্রতিনিয়ত বদলায়। তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ হতে ২০ বছর এবং ২০,০০০ শ্রমিক লেগেছিল। ১০০০ হাতি ব্যবহার করা হয় মালামাল বহন করার জন্য। সমাধিতে শুধু মমতাজ মহলের মরদেহ নয়, শাহজাহানেরও মরদেহ রয়েছে।

×