ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

গল্প ॥ রক্ত

হাসান মাহমুদ বজ্র

প্রকাশিত: ২২:১৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গল্প ॥ রক্ত

তীব্র গরম,  ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেছে

তীব্র গরম,  ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেছে। আর হাঁটতে পারছি না। পা অবশ হয়ে আসছে। শরীরে আর শক্তি নেই। দশ মাইল হেঁটে আমি খুবই পরিশ্রান্ত। দুপাশে ধুধু ধানের খেত। আশপাশে কোন বসতি নেই। বিস্তৃত ফসলের মাঠের মাঝ দিয়ে কাঁচা সরু রাস্তা চলছে তো চলছেই। রাস্তায় মানুষের চলাচল খুবই কম। তারপর এখন দুপুর বেলা, এই খাঁখাঁ রোদে কেউই বের হয় না।

দূরের মসজিদে আজান হচ্ছে। পা দুটো আর চলছে না, সকাল থেকে হাঁটছি তো হাঁটছিই। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে হবে সীমান্তে। একবার বর্ডারটা ক্রস করতে পারলেই যেন বেঁচে যাই। পিঠের ভারী ব্যাগটা যেন কাল হয়ে উঠেছে। নিজের শরীরটাও এখন বোঝা মনে হচ্ছে। তার উপর এই ব্যাগ। আহ টাকা। এই টাকাকেই আপন ভেবেছিলাম, কত না কি করেছি এসব অর্জনের জন্য।

এই টাকাই এখন জীবন কেড়ে নিবে মনে হয়। মন চায় ছুড়ে পেলে দিই এই টাকা আর হীরা জহরত ভর্তি ব্যাগ। পিঠ থেকে ছুড়ে ফেলে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিই। কিন্তু এত কিছু করে অর্জন করা সম্পদ কিভাবেই বা ফেলে দিই। তাছাড়া টাকা ছাড়াতো বর্ডারও পার হওয়া যাবে না। বিনা লাভে কেইবা পার করে দিবে।
আর হাঁটতে পারছি না। থামারও সাহস নেই। কে জানে কখন সীমান্তরক্ষী বা পুলিশ এসে সামনে দাঁড়ায়। সবচেয়ে বড় ভয় সাধারণ মানুষের। একবার চিনে ফেললে নিস্তার নেই। পুলিশের হাত থেকে বাঁচলেও গণধোলাইয়ের হাত থেকে নিস্তার অসম্ভব। যদিও আমার আর আগের চেহারা নেই। সব কিছুর সাথে সাথে লিঙ্গটাও বদলিয়েছি। ঠিক লিঙ্গ না, লিঙ্গের বেশ। গোঁফ দাড়ি কামিয়ে মেকাপ করেছি, ঠোঁটে লিপস্টিক। কান নাক ফুটিয়ে দুল পড়তেও দ্বিধা করিনি। মাথায় চুল, পরনে শাড়ি।

নিজেকে আড়াল করতে কি না করেছি। এখন আর কেউ চিনবে না। একবার বর্ডারটা পার হই, তারপর সময় হলে বীর বিক্রমে ফিরে আসব। কোন্ শালাকে তখন দেখে নিবো।
রাস্তার পাশে একটি তালগাছ দেখে থামলাম। ছায়ায় পা ছড়িয়ে বসলাম তলায়। পকেট থেকে পানির বোতলটি নিলাম। তলায় খুবই অল্পই পানি আছে। ঢেলে দিলাম গলায়, তৃঞা মিটলো না, উল্টো তৃষ্ণায় গলা পুড়ে যাচ্ছে। গা এলিয়ে দিলাম গাছে। না শান্তি লাগছে না। কিছুটা দূরে কেউ একজন বসে আছে। উঠে দাঁড়ালাম।  ক্লান্ত পা দুটো টেনে নিয়ে চললাম সেদিকে। যদি একটু পানি পাই এই আশায়। পানির তৃষ্ণায় ধরা পড়ার ভয়ও মন থেকে উবে গেলো। লোকটার আপাদমস্তক কাপড়ে ডাকা।

নিঃশব্দে বসে আছে। ডাকলাম, -ভাই শুনছেন। লোকটি কোন সাড়া দিলো না। আবার ডাকলাম, আবার। -ভাই শুনছেন, একটু পানি হবে? তৃষ্ণায় গলাটা পুড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর লোকটি চাদরের নিচ থেকে একটি হাত বের করল। একটি গ্লাস উঁচিয়ে ধরল সামনে। চেহারা থেকে কাপড় সরালো না। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে।

ঢকঢক করে কিছুটা ঢেলে দিলাম গলায়। ছি, কেমন নোনতা স্বাদ, বিশ্রী পচা গন্ধ। পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসার উপক্রম। গ্লাসের দিকে তাকাতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। গ্লাসে তাজা রক্ত। চাদরের নিচ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। গোঙানির শব্দের সাথে ভেসে এলো, “
-খা। রক্তের নেশা জেগেছে না, এই নে রক্ত খা। 
হাত পা অবশ হয়ে আসছে আমার। নড়ছে না। যেন কেউ কোন্ মন্ত্রে পাথর করে দিয়েছে পা দুটো। চিৎকার করার শক্তি নেই। লোকটি বলেই যাচ্ছে একি কথা, খা রক্ত খা। আসতে আসতে তীব্র হচ্ছে তার গলা। আকাশে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হচ্ছে। খা রক্ত খা, খা রক্ত খা। লোকটি উঠে দাঁড়ালো। চেহারায় কাপড় সরতে লাগলো ধীরে ধীরে। মুখটি স্পষ্ট হতে লাগলো। বীভৎস, হিংস্র, ভয়ংকর সে মুখ অপরিচিত নয়।

এই সে ছেলে, আমার গুলিতে যে মারা গিয়েছিলো ছাত্র আন্দোলনে। হুম এই সে। গুলির ক্ষত এখনও তাজা তার। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, বিস্তৃত প্রান্তর ভেসে যাচ্ছে।  রক্ত পড়ছে, স্রোত উঠছে। চারপাশের ধুধু মাঠে গড়াচ্ছে সেই রক্ত। দূর বহুদূর ভেসে যাচ্ছে। টেউ উঠছে। লোকটি ক্রমাগত চিৎকার করেই যাচ্ছে, খা রক্ত খা। কান ফেটে যাচ্ছে সেই শব্দে।

সাথে সাথে চারদিকে স্রোত উঠছে, রক্তের। ঢেউ খেলছে রক্ত। যেন রক্তের সাগর চারদিকে। মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সামনে আমার  মৃত্যু দূত সেই তরুণ। যাকে আমি নিজ হাতে হত্যা করেছি। রক্তের স্রোত আছড়ে পড়ছে পায়ে। আমি ডুবছি। আমি ডুবে যাচ্ছি। আমি ডুবে যাচ্ছি রক্তের সাগরে, ধীরে ধীরে। ছেলেটি হাসছে। খুব হাসছে, আমি ডুবছি। রক্তে,,,,

×