ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

পড়ুয়া প্রজন্ম প্রয়োজন

মো. গোলাম মোর্তুজা

প্রকাশিত: ২২:২২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পড়ুয়া প্রজন্ম প্রয়োজন

অবসরকে অলংকারে ভরিয়ে দেয় বই

অবসরকে অলংকারে ভরিয়ে দেয় বই। একটি নির্মল বই আপনাকে বিশুদ্ধতার বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দেয়।
আমাদের প্রজন্ম বই পড়া থেকে অনেক দূর দ্বীপের বাসিন্দা। পরীক্ষা পাসের জন্য হাতেগোনা কটা বই পড়ার জন্যই যেন ওদের জন্ম হয়েছে। আসলে পরিবার থেকেই প্রথম বই পড়ার আগ্রহ জন্মায়। যে পরিবারে বাবা-মা ও অন্য সদস্যরা বইমুখি তাদের সন্তানরাও বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়।
সন্তানের নাকে আদর্শ কিছু বইয়ের (বয়স ও সময়োপযোগী) সুঘ্রাণ দিয়ে দিতে পারলে সন্তানরা পথ ভুল করবে না। সন্তান নরম মাটির মতো।

ওদেরকে মনের মতো অবয়ব দিয়ে তৈরি করা যায়। ফুল নিজেকে বা নিজের জন্য কিছু করে না। ওর জন্ম তো অন্যকে সুরভিত করা। নিজেকে বিলিয়ে অন্যকে মাতোয়ারা করা। ঠিক তেমনি একটি সন্তান ফুলের মতো। শুধু একবার ফুল ফোটানোর ম্যাজিক্যাল শক্তিটা শিখিয়ে দিলেই ব্যাস সে সন্তানটি সারাজীবন সুরভি ছড়াতেই থাকবে। আর আপনি পায়ের উপর পা তুলে সন্তানের গৌরব গাথা গাইতে গাইতে আরাম নিদ্রায় যাবেন। কিন্তু না,  বাস্তবে তা হচ্ছে না। ছোটবেলায় শিশুরা যা দেখে, তাই করবার চেষ্টা করে।

আমরা ভালো বই সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে বলেছি যে, বাবা এই বইটি পড়ো। কিংবা সন্তানের পাঠ সংশ্লিষ্ট পাঠোদ্ধার করেছি? কিংবা বর্ণমালা পরিচয়ের ‘অ’ তে অজগরটি আসছে তেড়ে, ‘আ’ তে আমটি আমি খাব পেড়ে, ‘ই’ তে ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে ইত্যাদি না পড়িয়ে বলেছি কী ‘বাবা নতুন কোনো বাক্য তৈরি করতে পারো কি না চেষ্টা কর। পারলেই পুরস্কার পাবে। পুরস্কারের কথা বললে সন্তান ভাবনায় আপ্লুত হবে।

আর না পারলেও দেখবেন ওর মাঝে নতুন বাক্য তৈরির আকুলতা সৃষ্টি হচ্ছে। না পারার ব্যথা ওরা সয়তে পারে না তাই পরিবারের বড়দের কাছে নতুন শব্দের গাঁথুনি বুঝবার জন্য উদগ্রীব হয়ে যায়। এতে আপনার উচ্ছ্বসিত হওয়া চাই। সন্তানদের যতদূর সম্ভব বোঝানো যে, ওদেরকে ভালোবেসে, আগ্রহদীপ্ত হয়ে যা দিচ্ছেন, তা ওদের জীবনকে আলোকিত ও সম্মানিতই করবে। প্রথম প্রথম ওরা ভাবতেও পারে, বাবা আমাকে খেলনা-টেলনা না দিয়ে বই দিচ্ছেন। ক্লাসেও বই, উপহারেও বই, শুধু বই আর বই।

কিছু ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে আপনাকে নাবিকের ভূমিকায় থাকতে হবে। শুধু দিকনির্ণয়কারী কাঁটা কম্পাসের দিকে তাকিয়ে জাহাজ চালালেই চলবে না। নিজের বিবেক, বুদ্ধি ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে। বই নিয়ে টুক করে ওদের (শিশুর) মনের  প্রদেশে ঢুকতে হবে। কিছু ভালো বই উপহার দিন। দেখবেন, বিষয়টি বাড়িতে একপ্রকার শোরের জন্ম দিয়েছে। উপহার পাওয়া বইগুলোর সৌরভ পাবার জন্য সন্তানটি কিন্তু আকুলি-বিকুলি করবে।

এভাবে যদি ছোটবেলায়ই সন্তানের মন ও মননে বই নামক জ্ঞানের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়, তবে সন্তানটি জ্ঞানপিপাসু হবে। কিন্তু হায়! হয় কই। একটা ভালো বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা ঢেলে ঢেলে সন্তানটিকে কিন্তু আসল মানুষ বানানো যাবে না। প্রাইভেট দিয়ে, কোচিং করিয়ে হয়তো বিদ্যালয়ের বই শেষ করানো যাবে।

হয়তো রেজাল্টও ভালো হবে। পাঠোন্নতির বিবরণে অনেক অনেক নম্বরও আসবে। কিন্তু মানুষ হবার জন্য তো আর শুধু নম্বর বা সার্টিফিকেট সর্বস্ব হলে চলে না। মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের আয়না ওদের সামনে প্রথম থেকেই মেলে ধরতে হবে। যা করবার শৈশব থেকেই শুরু করতে হবে। 
লোহা ওজনের দিক দিয়ে ভারি হলে ওর দাম হাতের নাগালে আবার স্বর্ণের ওজন অল্পতেই বেশি বলে লোহার চেয়ে স্বর্ণের দাম হাজার গুণে বেশি। আর তাই সবাই লোহাকে চায় না, লোভনীয় চাওয়া হচ্ছে স্বর্ণ। সন্তান লোহা নয়, লোহার মতো ভাবাও ঠিক নয়। আমাদের সন্তানদের পাঠে মনোযোগী করাতেই হবে। কিছু বই নিজে পড়তে হবে। কিছু বই সন্তানদের পড়াতে হবে। কিছু বইয়ের সঙ্গে শুধু পরিচয় ঘটিয়ে দিতে হবে।

তাহলে হয়তো একদিন না একদিন কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে আপনার পরিচয় করিয়ে দেয়া বইটির সন্ধানে নামবে। একদিন এমনো হতে পারে, বইটি মনোযোগের সঙ্গে পড়ে ফেলছে। এক্ষেত্রে  পরামর্শ হচ্ছে, আপনার বাড়িতে একটি লাইব্রেরি থাকলে মন্দ হয় না। আপনি সেখানে অবসরে সময়টাকে অর্থবহ করতে পারেন। এত আপনার সন্তানও সেখানে হইচই করে না ঢুকলেও, একসময় দেখবেন আপনার অবর্তমানে ‘বাবার লাইব্রেরিটা একটু দেখি।

বাবা  কী কী বই পড়েন;- এরকম নানান কথায় উত্তর জানার আগ্রহ জন্মাবে। আর তা হলে আপনার জন্ম সার্থক বলে জানব। অবশ্য লাইব্রেরি পরিবারের রুচি ও পছন্দের ক্রমানুযায়ী সাজানো উচিত হবে। একটি পারিারিক লাইব্রেরি হচ্ছে রঙধনুযুক্ত ভাবাবেগের আকাশ। সাতরঙের সৌন্দর্য আর আশ্চর্যের নরম আঘাতে হাজার হাজার মানুষের মনকে দোলায়িত করে। রঙধনু দেখতে মানুষ ঘর হতে বাহির হয়। আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে, আকাশের সৌন্দর্যের বর্ণনায় প্রাণঅলা মানুষরা আপ্লুত হয়।

আকাশের এই সৌন্দর্য দেখার জন্য কিন্তু কাউকে ভাড়া করে বা টাকার বিনিময়ে আনতে হয় না। এখানে সবাই আসে প্রাণের উচ্ছ্বাসে। মনের খোরাক মেটাতে। ঠিক তেমনিভাবে একটি পারিবারিক লাইব্রেরি কিন্তু আপনার পরিবারকে জাগাবে-এটা দৃঢ় বিশ্বাস। গ্রাম্য কথা আছে, একথা-ওকথা দেরে বুবু আলাপাতা-এ কথার তাৎপর্য বহুগুণ। গ্রামীণ মা-বোনেরা কারো বাসায় গেলে অনেক কথার গুঞ্জন করলেও শেষে পানপাতা বা আলাপাতা চেয়ে ফেলতেন।

মূলকথা, অনেক কথার মাঝেও নিজের প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে এসে সমাধান করে নেওয়া। অভিভাবকদেরও এমনি এক অভিনব কায়দার প্রয়োগ করতে হবে। কথার পরিচর্যা করতে করতে একসময় বই প্রসঙ্গ টেনে বইয়ের প্রতি আগ্রহ জাগাতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো  আমাদের সন্তানেরা শ্রেণি বই এর পাশাপাশি রাখবে আলোকিত বইয়ের সারি। দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধি সাধনের জন্য যেমন সুষম পরিমাণে খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি মনকে স্বাস্থ্যবান করতে বই পড়ার সবিশেষ প্রয়োজন।

তবে তা অবশ্যই ভালো, আলোকিত, রুচিশীল, মার্জিত ও সুখপাঠ্য বই হওয়া চাই। বুদ্ধির অপরিপূর্ণতা যদি একটি রোগ হিসেবে বিবেচনা করি, তবে ভালো বই সেই অপরিপক্বতার মোক্ষম ঔষধ। সুঅভ্যাস করে বই পড়া, নিষ্ঠার সঙ্গে বইকে গ্রহণ করা দরকার। বলাও দরকার, বই পড়ার জন্য এখনো অনেকেই বই কিনেন, পড়েন।  ভালো  সন্তানরা আজও বই পড়ে। অবশ্য তা নিতান্তই কম। বই পড়ানোর অভ্যাস যত বাড়ানো যাবে, ততই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টিশীলতার সূর্যালোকে পেঁৗঁছে যাবে।   
আসুন, আমরা প্রজন্মকে বইপাঠে আগ্রহী করে তুলি।

×