ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

কারফিউ

ইভান অনিরুদ্ধ

প্রকাশিত: ২২:১৬, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কারফিউ

কারফিউ

জীবনানন্দ দাশ যেমন আক্ষেপ আর এক বুক হাহাকার নিয়ে বলেন- ‘জীবন বড়ই বিচিত্র। সন্ধ্যা কাটে না অথচ দিব্যি বছর কেটে যাচ্ছে!’ কিংবা টিএস এলিয়ট যখন বলেন- 
‘April is the cruelest month, breeding 
lilacs out of the dead land, mixing
memory and desire, stirring
dull roots with spring rain’
তখন মনে হয় এগুলো আমারই আক্ষেপ, আমারই হাহাকার! একটা ভয়াবহ বন্ধ্যা সময় বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদীর মতো এই ক’দিন ধরে। সারা দেশ উত্তাল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে। দুই শতাধিক কিশোর-তরুণের তাজা প্রাণ গুলিতে ঝরে গেছে। চারদিকে জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসযজ্ঞের পর এখন সারাদেশে কার্ফু চলছে, পথে পথে সেনাবাহিনী বন্দুক উঁচিয়ে টহল দিচ্ছে, দুষ্কৃতকারীদের দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এ রকম একটা অগ্নিগর্ভ অবস্থা দেশবাসী সর্বশেষ কবে দেখেছে কেউই সঠিকভাবে এক বসাতে মনে করতে পারছে না।

ইন্টারনেট বন্ধ, ফেসবুক বন্ধ, সকল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ। চারপাশে অজানা আতঙ্ক, নানা শঙ্কা। এই নারকীয় অবস্থা খুবই অসহ্য লাগছে। বীথির সঙ্গে এক সপ্তাহ যাবৎ যোগাযোগ নেই। সেও ফোন করে না, আমিও করি না। ঘরে বসে থেকে মনে হচ্ছে একটা দিন যেন একটা বছর! এই অসহনীয় অবস্থায় কিচ্ছু ভাগছে না- না পড়াশোনা, না লেখালেখি, না খাওয়া-দাওয়া কিংবা ঘুম।

এই কারণে জীবনানন্দের এই লাইনটা মাথায় হাতুড়িপেটা করছে। কিংবা টিএস এলিয়টের কবিতার লাইনগুলোর মতো মনে হচ্ছে সবকিছু। মনে হচ্ছে এপ্রিল নয়, এই জুলাই মাসটা সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম মাস! সবচেয়ে ভয়ংকর একটা মাস!
গত দুইদিন ধরে একটু একটু করে কার্ফু শিথিল হচ্ছে। বীথি ফোনে মেসেজ লিখে পাঠিয়েছে-‘আজ বিকেল চারটায় আমার বাসার সামনের ফাস্টফুডের দোকানটায় এসে কল দিও। দেখা করব।’ মেসেজটা পেয়ে মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে। অনেকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভেতরটা বেশ হাল্কা লাগছে। অব্যক্ত একটা খুশির আবেশ দেহ-মনে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল তার পাঠানো তেরো শব্দের এই মেসেজটা।

ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাড়ে তিনটা বাজে। ঝটপট রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে বীথির বাসার দিকে রওনা হলাম। পঁচিশ মিনিটের ভেতর তার বাসার সামনের সেই ফাস্টপুড অ্যান্ড কফিশপে পৌঁছে গেলাম। দোকানের নামটা কিন্তু বেশ- ‘রোমাঞ্চ’! ভেতরে ঢুকে নিরিবিলি কোনার একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম।

বেশ কিছু কাস্টমার টেবিলে-টেবিলে বসে আছে। সবাই যেন এই দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছে- তাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমার তাই মনে হলো। আমি বীথিকে ফোন দিলাম। কলটা রিসিভ করে মৃদু গলায় বললÑ ‘অপেক্ষা করো, আসছি।’ তার পর লাইন কেটে দিল। 

॥ দুই ॥
দশ মিনিটের ভেতর বীথি চলে এলো। একেবারেই হাল্কা সাজুগুজু করাÑ বেগুনি কালারের প্রিন্টের সালোয়ার কামিজ, খোলা চুল আর কপালে ম্যাচিং করা গোল টিপ। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলাম। সেও ঠোঁটের কোনায় একটা হাল্কা হাসির রেখা ফুটিয়ে চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল। মনে হচ্ছে এক আলোক বর্ষ পর তার আর আমার দেখা হলো আজ এই কার্ফুমাখা বিকেলে! আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম-
-কেমন আছ?
-জানি না, নিজে বোঝো না কেমন থাকতে পারি এই অবস্থায়!
-এই ক’দিন তো তোমার কোনো খবরই পাইনি।
-ইচ্ছা করেই তোমাকে কল করিনি। মুড ছিল না তোমার সঙ্গে কথা বলার।
-হুম, মনে হচ্ছে দেশের এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য আমি দায়ী! হা, হা, হা।
-ঢং করবা না হিমাদ্রী। তুমি কেন দায়ী হবা? 
-তুমি অহেতুক রেগে যাচ্ছ কেন? এনিথিং রং? 
-নাথিং রং। আসলে আসল দোষটা আমাদের এই প্রিয় সরকার বাহাদুরের। সরকার কি জানতো না এই আন্দোলনের মোড় ঘুরে যেতে পারে? কেন শুরুতেই এই ছাত্রদের সঙ্গে বসার পদক্ষেপ নিল না?
-হুম, ইউ আর রাইট। তা না করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই ছাত্রদের আরও উস্কে দেওয়া হয়েছে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করে। কোটার যৌক্তিক সংস্কারÑ এটা তো একটা অরাজনৈতিক দাবি ছিল ছাত্রদের। তাই নয় কি?
-হুম, একেবারেই যৌক্তিক দাবি। এনিওয়ে, কী খাবা? ঝাল নাকি ঠান্ডা জাতীয় কিছু?
-স্পাইসি চিকেন ফ্রাই, তোমার ফেভারিট এই আইটেম অর্ডার দাও। এটা দিয়েই কার্ফু সেলিব্রেট করি। হা, হা, হা।
-হুম, আবার কবে দেখা হয় কে জানে! আমার ছেলের বন্ধু, হাসিবও বেশিরভাগ সময় বাসায়ই থাকে। অফিসে গেলেও কেবল হাজিরা দিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর বাসায় চলে আসে। ইচ্ছা থাকলেও তোমাকে ফোন-টোন করা সম্ভব হয় না। 
-হুম। জটিলতা সব দিক থেকেই। দেশের এই পরিস্থিতিতে নিজের ভেতর অস্থিরতা, আবার তোমার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আরও বাড়ছে অস্থিরতা। 
-হুম, বাড়ুক অস্থিরতা। তবু আজকে তো দেখা হলো! আমিও ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলতে না পেরে!
আমাদের এসব কথার ভেতর ওয়েটার খাবার দিয়ে গেছে। গরম ঝাল চিকেন ফ্রাই থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সঙ্গে কোক আর শসার সালাদের বাটি। আমি আলতো করে গরম একটা টুকরায় কামড় দিলাম। বীথিও বেশ আয়েশ করে একটা লেগ পিস তুলে নিল। চুপচাপ দুজনেই খাচ্ছি। তারপর কোকের গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে সে আবার কথা শুরু করল।
-এত বছর দল ক্ষমতায়, তার পরও সাধারণ মানুষের একটা বিশাল অংশের প্রচ- রাগ-ক্ষোভ-হতাশা এই সরকারের প্রতি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্ব বেড়েছে এই দীর্ঘ সময়টায়। এই সত্যিটা মানতেই হবে। সরকার যেমন সাধারণ মানুষের ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করেনি, তেমনি এই কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের চাওয়াটাকেও বুঝতে চায়নি। নিজে এই সরকারকে সাপোর্ট করি, তাই বলে কি সরকারের ভুলগুলো বলতে পারব না? নিজেদের ভুলগুলোও দেশবাসীকে জানানো দরকার।
-আই অ্যাম এগ্রি উইথ ইউ। স্বাধীনতার এত বছর পর সরকারি চাকরিতে এত কোটা কেন বরাদ্দ রাখতে হবে? দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। তারা তো এমনিতেই হতাশ। তার ওপর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের পর তাদের নাতিপুতিদের জন্য কোটা রাখাটা এসব ছাত্রছাত্রী ভালোভাবে নেয়নি। তাই তারা শুরু থেকে সকল প্রকার কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছে। দুই হাজার আঠারো সালেও একই দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিল।
-অথচ এই চাওয়াটাকে নানাভাবে উপেক্ষা আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে সরকারের দায়িত্বশীল পদ থেকে। এটা খুবই বাজে একটা বিষয় ছিল। 
-কেন এদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারী ছাত্র সংগঠনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে নামাতে হবে? 
-হুম, ইট ওয়াজ আ ব্লান্ডার, নট মিসটেক।
-হ্যাঁ, মারাত্মক ভুল ছিল। 
-আচ্ছা, হিমাদ্রী, দেশের এই অবস্থা কবে স্বাভাবিক হবে? আমাদের মতো সাধারণ পরিবারের মানুষের যে কত যন্ত্রণা হচ্ছে! বাজারে গেলে আগুন। অনেক দিন ধরেই মানুষ জিম্মি হয়ে আছে এই বাজার-সন্ত্রাসীদের কাছে। প্রতিদিন ইচ্ছামতো বেড়েই যাচ্ছে জিনিসিপত্রের দাম। অথচ সরকার নির্লিপ্ত।
-হুম, বাজারে গেলে মনেই হয় না আমাদের দেশে কোনো সরকার আছে! সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। 
-সঙ্গে আছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সীমাহীন দুর্নীতি। সবকিছু ফ্রি স্টাইলে চলছে! যেন মগের রাজত্ব!
-হুম, মুখে কেবল বুলি আওড়ায়- দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স! 
-হা, হা, হা। বাদ দাও এসব ক্যাচাল। দেশ নিয়ে আমাদের এসব ভেবে কী লাভ? কোনো কিছুই বদল হবে না।
-হুম, তাই মনে হয় আমারও।

॥ তিন ॥

ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা ছয়টা প্রায় ছুঁই ছুঁই। এখনো সাত মিনিট বাকি। আমি বীথির দিকে তাকিয়ে বললাম- তোমার হাতটা একটু ধরে থাকি? এই শুনে সে আলতো করে আমার গাল টেনে দিয়ে তার ডান হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি চোখ বন্ধ করে তার হাত চেপে ধরলাম। সে ফিসফিস করে বলল- জাস্ট ছয়টায় উঠে পড়ব কিন্তু! আমিও অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলাম- হুম, কিছুক্ষণ পর আবার কার্ফু শুরু হবে। আবার বন্ধ্যা সময় শুরু হবে!

×