কালো বিড়াল
(পূর্ব প্রকাশের পর)
মেজাজ রুক্ষ খিটখিটে হয়ে গেল। সবার প্রতি, সবকিছুর প্রতি অকারণ একটা ঘৃণা তৈরি হলোÑ ল্ডুদ্ধ আচরণ আর রাগারাগি করতে থাকলাম ঘন ঘন, যার পুরোটা গিয়ে পড়লো আমার গোবেচারা বউয়ের উপর।
একদিন বাড়ির বেসমেন্টে গেছি কী একটা কাজে, বউ সঙ্গে আছে। সিঁড়ি দিয়ে নামছি সেলারে। এমন সময় বিড়ালটা পেঁচিয়ে গেল পায়ের সঙ্গে, এমনভাবে পেঁচালোÑ আরেকটু হলেই সিঁড়ি থেকে হুড়মুড়িয়ে পড়ে মেঝেতে গোত্তা খেতাম। হঠাৎ উন্মত্ত রাগে শরীরটা জ্বলে গেল আমার।
একটা কুঠার হাতে নিলাম। বিড়ালকে লক্ষ্য করে হাত তুলেছিÑ জায়গামতো পড়লে বিড়াল অক্কা পাবে। কিন্তু উদ্যত হাতটা ধরে ফেললো আমার স্ত্রী। এবার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো স্ত্রীর উপর। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দানবীয় আল্ডোশে কুঠার বসিয়ে দিলাম স্ত্রীর মাথায়Ñ টুঁ শব্দ না করে সে ওখানেই লুটিয়ে পড়লো। নিজের স্ত্রীকে খুন করে ফেলেছি। মৃতদেহ পড়ে আছে মেঝেতে। দেহটা লুকিয়ে ফেলা দরকার। সেই কাজে লেগে গেলাম ঝটপট।
বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না মৃতদেহÑ প্রতিবেশীরা দেখে ফেলবে। কী করা যায় ভাবতে থাকলাম। একবার মনে হলো দেহটা টুকরো টুকরো করে কেটে আগুনে পুড়িয়ে ফেলি। আবার ভাবলাম মেঝেতে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দিই। তৃতীয় চিন্তাটা হলো এরকমÑ উঠোনের কুয়োর ভেতর লাশটা ফেলে দেওয়া যায় কিনা? বাক্সে ভরে বাইরে পাচার করার কথাও ভাবলাম একবার। শেষে সবচেয়ে ভালো সমাধানটা পেয়ে গেলাম। সেলারের দেয়ালের ভিতর লুকিয়ে রাখবো দেহটা।
দেয়ালগুলো এমনভাবে তৈরি যে কাজটা কঠিন হবে না। একপাশের দেয়ালে ফলস ফায়ারপ্লেস ছিলÑ ইঁট গেঁথে কিছুদিন আগে ফায়ারপ্লেসটা বুঁজে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে প্লাস্টারও করা হয়েছে। সেলারটা স্যাঁতসেঁতে বলে প্লাস্টার এখনো শুকায়নি। সেই জায়গাটা আমি বেছে নিলাম। ইটগুলো সরিয়ে মৃতদেহ রেখে দেয়ালটা আবার আগের মতো করে ফেলবোÑ বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাবে না। কাজে লেগে গেলাম।
শাবল দিয়ে ইটগুলো খসিয়ে ফেললাম প্রথমে। দেহটাকে ভেতরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দিলাম। ওভাবেই থাকলো দেহটা। এরপর এপাশে ইট গেঁথে, সিমেন্ট আর বালু দিয়ে প্লাস্টার তৈরি করে দেয়ালটা প্লাস্টার করে দিলামÑ দেখতে ঠিক আগের মতোই হয়ে গেল। পড়ে থাকা ইট-কাঠ-বালু-সিমেন্ট সরিয়ে সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেললাম। কেউ কিছু সন্দেহ করবে না আর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে বললাম- ‘যাক পরিশ্রম সার্থক হলো, এই কাজটা অন্তত ঠিকভাবে করতে পেরেছি।’
এরপর বিড়ালটাকে খুঁজতে থাকলাম। এবার ওটার পালা, ওটাকে এবার শেষ করবো। কিন্তু সে ঠিক টের পেয়ে গেছে আমার অভিসন্ধি। তাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঐ মুহূর্তে হাতের কাছে পেলে তখনই ওটাকে শেষ করতাম। সে পালিয়েছে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আবার, যাক বাঁচা গেল। রাতেও বিড়ালটা এলো না, দুঃস্বপ্নেও তাকে আর দেখলাম না। ঐ অভিশপ্ত বিড়াল বাড়িতে আসবার পর এই প্রথম আমি শান্তিতে ঘুমালামÑ হ্যাঁ, একটা খুন করার পরেও শান্তির ঘুম ঘুমালাম।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও পার হলো ঝামেলা ছাড়াই। ইবলিসটা পালিয়েছে। এতদিনে আমি মুক্ত হলাম ওটার হাত থেকে। শান্তি ফিরে এলো আমার মনে। অনুশোচনা, অপরাধবোধ অথবা বিবেকের দংশনও তেমন আর টের পাই না। ছোটখাটো তদন্ত হয়েছে, একবার সার্চ করতেও এসেছিল পুলিশÑ কিছুই খুঁজে পায়নি। আমার সামনে এখন ঝলমলে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
হত্যাকা-ের চতুর্থ দিন আবার একদল পুলিশ এলো অপ্রত্যাশিতভাবে। তদন্ত করে সার্চ করতে লাগলো সারা বাড়ি। আমি তাদের সঙ্গেই ছিলাম। ভিতরে ভিতরে নিশ্চিন্ত আমিÑ জানি কিছুই খুঁজে পাবে না। সব চেক করলো তারা। শেষমেশ তৃতীয় কী চতুর্থবারের মতো সেলারে নামলো। আমি তো নিরপরাধ, আমার হার্টবিট নর্মাল, মুখের একটা পেশিও কাঁপছে না।
হাত দুটো বুকের কাছে ভাঁজ করে সেলারে হাঁটাহাঁটি করছি। পুলিশ সবকিছু দেখেশুনে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যাচ্ছে। আমার মনে উল্লাস, চেপে রাখতে পারছি না। একটা কিছু বলতে ইচ্ছে করছেÑ যাতে আমার উপর থেকে সন্দেহটা পুরোপুরি সরে যায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেছে পুলিশ।
‘জেন্টেলমেন,’ আমি বললাম অবশেষে। ‘আপনাদের সন্দেহ দূর করতে পেরে যার-পর-নাই আনন্দিত আমি। আপনারা ভালো থাকুন, শুভকামনা জানাই। একটা কথা বলি শুনুনÑ এই বাড়িটা কিন্তু চমৎকার...(কী যে বলছিলাম নিজেই জানি না)...হ্যাঁ বুঝলেন, দারুণ চমৎকার করে বানানো হয়েছে এই বাড়ি। দেখুন না এই দেয়ালটা...চলে যাচ্ছেন নাকি? এই দেয়ালটা খুব সলিডÑ এই যে দেখুন...।’ সাহস দেখানোর নেশায় পেয়েছে আমাকে।
হাতের লাঠিটা দিয়ে আমি জোরে ঠুকে দিলাম দেয়ালের ঠিক সেই জায়গায়Ñ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃতদেহ।
ঈশ্বর আমায় রক্ষা করুন! এরপর যা ঘটলো তা আমার কল্পনার অতীত, বর্ণনারও অতীত। টোকার শব্দ মিলাতে না মিলাতেই ভিতর থেকে ভেসে এলো উত্তরÑ প্রথমে মনে হলো শিশুর চাপা কান্না, তারপর চিৎকার- নরকের গভীর থেকে উঠে আসা বিকট একটা চিৎকার। চিৎকারটা ক্রমশ তীক্ষè আর জোরালো হতে হতে সেলারে প্রতিধ্বনি তুলে ঘুরতে লাগলো...।
সেই চিৎকারের ধাক্কায় উল্টোদিকের দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেলাম আমি। পুলিশের দলটা ভয়ে বিস্ময়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির উপর। একটু পরেই দেখি ছয়-সাতজন পুলিশ দেয়ালের ইট খুলছে। দেখতে দেখতে নাই হয়ে গেল দেয়াল। গলিত মৃতদেহটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। মৃতদেহের মাথার উপর একটা কালো বিড়ালÑ বিড়ালের মুখটা খোলা, হাঁ করে আছে- তার একটা চোখ নাই। অন্য চোখ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে লাল আগুনের শিখা।