ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

গল্প ॥ মিছার মা

শেলী সেনগুপ্তা

প্রকাশিত: ২৩:২০, ২৯ আগস্ট ২০২৪

গল্প ॥ মিছার মা

মিছার মা

না আলো, না অন্ধকার ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা মায়াবী আলো ঢুকে পড়েছে। এটাই ঘরটাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে বোঝা যাচ্ছে বাইরে বেশ ঠান্ডা। পৌষ মাসের রাতে এতো ঠান্ডা পড়ার কথা না। এটা মফস্বল মতো জায়গা। তাই ঢাকায় যখন দুপুরে গরম আর রাতে হালকা চাদরে মানিয়ে যাওয়া ঠান্ডা।

সে সময় মফস্বলে মেঝেতে দাঁড়িয়ে টকটক করে কাঁপতে হয়। মাঝরাতে উঠে রাথরুমে যাওয়ার সময় এ অনুভূতিটা হয়। তখন ঢাকা শহরের জন্য মনটা আনচান করে ওঠে। আনচান মন নিয়েই বাথরুমে যাই, ফিরেও আসি। তারপর বিছানায় আসার পর যখন পাশ থেকে কেউ শরীরের ওপর লেপটা টেনে দেয়, তখন মনে হয় মফস্বলের শীতটা আসলেই উপভোগ্য।

আমি তমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যখন ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছিলাম, তখনই বাবা-মার বিবেচনায় খুব ভালো ছেলে রাদিবের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর পর আমি চলে এলাম মাধবদিতে।
বাবা-মার পছন্দে বিয়ে হলেও আমি রাদিবের সঙ্গে খুব সুখী। ওর মধ্যে বেশ দায়িত্বশীল একজন স্বামীর বসবাস।
রাদিব ব্যাংকে চাকরি করে। প্রতিদিন সকালে বের হয়ে যায়, সন্ধ্যার পর ফিরে আসে। কিন্তু সারাদিন আমাকে একা হতে দেয় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলে। খবর নেয় খেয়েছি কিনা, অফিসে মজার কিছু হলে ফোন করে আমাকে জানায়। তাই কখনোই আমার একা মনে হয় না।
ঘরের কাজ করতে করতে আমি ওর ফোনের অপেক্ষা করি। জমানো কথাগুলো দ্রুত বলতে থাকি। রাদিব ধৈর্য ধরে শোনে। যদি ফোন না আসে তাহলে নিজের মনে ওর সঙ্গে কথা বলতে থাকি, কখনোই আমার একা মনে হয় না।
আমাদের বিয়ের সব অনুষ্ঠান ঢাকাতে হয়েছে। ওর অফিসের কেউ যেতে পারেনি।
তাই ওর ব্রাঞ্চ ম্যানেজার আমাকে আর ওকে নিমন্ত্রণ করল চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। সঙ্গে অফিসের আরও কর্মকর্তাদেরও। সবাই সস্ত্রীক এসেছে। কর্মকর্তাদের স্ত্রীর কথা বলে বেশ ভালো লাগলো। অল্পসময়ের মধ্যে সবাই খুব আপন করে নিলো।
একজন তো বললো,
- ভাবী, বাসায় কাজের লোক রাখেননি?
- আমি তো কেউকে চিনি না, কাকে রাখবো?
- এতো কাজ একা করতে কষ্ট হয় না? একজন ছুটা বুয়া রেখে দিন।
-  দেখি , পেলে রাখবো।
- আচ্ছা, আমি একজনকে পাঠিয়ে দেবো। বয়স্ক মহিলা কিন্তু খুব ভালো। রাখতে পারেন।
- আচ্ছা।
রাতে বাসায় ফিরে রাদিবকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেল। বললো,
- ভালোই হবে, তাকে এমন সময় আসতে বলবে যখন আমি থাকবো না, তাহলে তোমারও সময় কাটবে ভালো।
- শুনেন স্যার, আমার সময় খুব ভালো কাটে, কখনো আমার একা মনে হয় না। সবসময় আপনি আমার সঙ্গে থাকেন। তবে আপনি যখন বলছেন তাকে সেভাবেই আসতে বলো।
- ওকে ম্যাডাম।
দুজনে একসঙ্গে হেসে উঠলাম।
 
দুদিন পর এক মধ্যবয়সী মহিলা এলো। জানালো ব্যাংক কলোনির এক ম্যাডাম কাছে পাঠিয়েছে আমার বাসার কাজের জন্য। মহিলার পোশাক আর কথাবলার ধরন দেখে এতো ভালো লাগলো যে আমি তাকে নিয়োগ দিয়ে দিলাম।
মহিলা খুব সুন্দর কাজ করে। আমাকে বলতে হয় না, নিজেই সবকাজ করে বাড়িঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। সবসময় হাসিমুখে থাকে।
আমার সঙ্গে টাকা নিয়ে কথায় বললো না। জানতে চাইলে বললো,
- আপনার যা মন যায় দেবেন।
আমি অবাক হলেও কিছু বললাম না। রাদিবকে জিজ্ঞেস করলাম,
-  বল না গো, মহিলাকে কতটাকা দেবো?
-  তুমি তাকে জিজ্ঞেস করো।
- করেছি , কিছুই বলে না, বলে, ‘যা মন চায় দেবেন’।
- তুমি এক কাজ করো মোশারফ ভাবীকে জিজ্ঞেস করে নাও।
- আচ্ছা।
সেদিনের মতো আর কথা হলো না।
পরের দিন খালা কাজ করে যাওয়ার পর আমি মোশারফ ভাবীকে ফোন করলাম।
- কেমন আছেন ভাবী?
- ভালো আছি ভাবী, আপনি কেমন আছেন?
-  আমিও ভালো, আপনি যে খালাকে কাজের জন্য পাঠালেন তাকে কত টাকা দেবো বুঝতে পারছি না, সেও তো কিছু বলে না।
- ও আচ্ছা, খালার তো আসলে তিন কুলে কেউ নেই, তাই টাকার লোভ কম। তবে আপনি এখানকার কাজের রেটে দেবেন।
- আচ্ছা , তাই দেবো।
মোশারফ ভাবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কে যেন কলিং বেল বাজালো।  ফোন রেখে দরজা খুলে দেখি এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে পাঁচমিশালী শাক। মহিলা খুব অস্থিরভাবে বললো,
- শাক নেন, আমি এ পথ দিয়ে যাবো শুইনা আমার দিয়ে মিছার মা পাডাইছে।
- মিছার মা আবার কে?
- আপনাগো বাসার বুয়া, হ্যার নাম তো মিছার মা।
- তাই নাকি? জানি না তো,
বলেই আমি হেসে দিলাম। মহিলাও হাসতে হাসতে চলে গেলো।
খালা বলেছিলো, ওর বাসার পাশে খালি জমিনে নানা ধরনের শাক হয়েছে। আমি পছন্দ করি শুনে নিয়ে আসবে বলেছিলো।
 
রাতে রাদিবের বুকে মাথা রেখে আমি বললাম,
- জানো , আজ একটা মজার কা- হয়েছে।
- কি হলো?
- আমাদের কাজের খালার নাম কি জানো?
- কি?
- মিছার মা।
- বলো কি, কারো কি এমন নাম হয়?
- তাতো জানি না, খালা যাকে দিয়ে শাক পাঠিয়েছে সেই বললো।
- অদ্ভুত তো!
 
পরদিন খালা মানে মিছার মা আসতেই আমি বললাম
- খালা, তোমার নাম কি মিছার মা?
লজ্জায় লাল হয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে বললো,
- হ, হেতাইনে মিছার মা বইলে ডাকতো।
- এর কারণ কী? এতো নাম থাকতে মিছার মা কেন?
- আমারে বিয়া কইরা রাইখাই হেতাইনে যুদ্ধ চইলা গেছেন। কতদিন দেহি না। একবার হেতাইনের দোস্তরা আইলো। রাইতের বেলায়ই আইছিলো, খাইয়া ঘুমাইলো, বেইন্যা কালে যাওনের সময় আমি কইলাম, ‘ হেতাইনরে কইয়েন পোলার নাম রাখন লাগলো’।
- তারপর কি হলো?
- হুইনাই চইলা আইলেন, আমারে কইলো, ‘ পোলা অইবো, শরীরের যতœ নিস’।
আমি কইলাম, ‘মিছা কইছি’।
‘ ক্যান মিছা কইলি?’
‘ আপনেরে দেখতে মন চাইলো’।
হেতাইনে আমার থুতনি নাইড়া দিয়া কইলো,
‘হোন রে মিছার মা, এমন মিছা আর কইস না, দেশের কামে যাইতাছি, পিছু ডাহিস না, আইসা হাঁচা হাঁচাই তোরে এক খান পোলা দিমু, স্বাধীন দেশের বীর পোলা, ততদিন তুই মিছার মা অইয়াই থাক’।
বলতে বলতে মিছার মার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল, সূর্যের প্রথম আলোতে আলোকিত হওয়ার মতো।
তারপর ধীরে ধীরে মাথা নুয়ে গেল হাঁটুর কাছে, ফিস ফিস করে বললো,
- হেইতো গেল, অহনও আইলো না, আমারে মিছার মা বানাইয়া রাইখা গেল।
 
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বললো,
- আইজ যাই খালা, আইজ আর কাম করণের তাগদ নাই, কাইল আইসা কইরা দিমুনে—-
পরাজিত সৈনিকের মতো ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে মিছার মা, ভালোবাসার কাছে হেরে যাওয়া মিছার মা।

×