দিলারা হাশেম
গতকাল ছিল কথাসাহিত্যিক ও সম্প্রচার-সাংবাদিক দিলারা হাশেমের (২৫ আগস্ট ১৯৩৬–২০ মার্চ ২০২২) জন্মদিন। কেবল এইটুকু বললে তাঁর পরিচয় সম্পন্ন হয় না। লেখক হিসেবে তাঁর যে সাধারণ পরিচয় রয়েছে তার চেয়ে তিনি বড়। বাঙালি মুসলমান সমাজে জন্মে ও বিকশিত হয়ে যে জীবনদৃষ্টি তিনি অর্জন করতে পেরেছিলেন, তা ছিল বিরল দৃষ্টান্ত। সাহিত্যিক হিসেবে যাত্রাশুরুর লগ্নে তাঁর দিকে সাহিত্যসমাজের যথার্থই দৃষ্টি পড়েছিল।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসায় এবং সম্প্রচার-সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি বাড়ায় তাঁর ওপর থেকে দৃষ্টি সরে যায়। যদিও দীর্ঘকাল বাংলাদেশের বাইরে থাকলেও বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টিতে তিনি নিস্পৃহ ছিলেন না। কেবল এটুকু বলাও যথেষ্ট নয় যে, তিনি লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। বাংলাদেশের বাইরে তাঁর যাপিত জীবন নিজের জীবনবোধে যা যোগ করেছে, উত্তরকালে তা ছিল তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তার উজ্জীবক।
আমাদের দেশের সাহিত্য সমালোচনা সামগ্রিকভাবে বিকশিত না হওয়ায় দিলারা হাশেমকে লেখক হিসেবে প্রথম দিকে কিছুটা মর্যাদা দেয়া হলেও তাঁর সৃষ্টিকর্মকে সামগ্রিকভাবে যথার্থ বিশ্লেষণ করা হয়ে ওঠেনি। তাঁর সাহিত্য নিয়ে একটি পিএইচডি ডিগ্রির খবর জানি যা তাঁর মাত্র একটি খণ্ডসত্তার ওপর ভিত্তি করে হয়েছে। যা হোক, দিলারা হাশেমদের মতো লেখকের সাহিত্যিক কারণে যেভাবে বিশ্লেষিত হওয়া জরুরি ছিল, তা একদিন হবে এই আশা আমাদের করতে হবে।
কিছু সুবেদী মানুষ হয়তো তাঁর ব্যাপারে জানতে চাইবেন। নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের পরিচয় সন্ধান করতে গিয়ে কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলাম। এর অংশ হিসেবে যা লিখতে পেরেছিলাম তা এখানে সামান্য পরিমার্জনাসহ যুক্ত করলাম!
ইংরেজি সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (১৯৫৬) ও স্নাতকোত্তর (১৯৫৭) দিলারা হাশেম (জন্ম: ২৫ আগস্ট, ১৯৩৬) খ্যাতনামা বাংলাভাষী কথাসাহিত্যিক।
প্রথম উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ (১৯৬৫) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক ও সমালোচক মহলে বিপুল সমাদৃত; রুশ ও চীনা ভাষায় অনূদিত উপন্যাসটি চলচ্চিত্ররূপও পায় (১৯৭৩)। ১৯৭২ সাল থেকে আমেরিকাবাসী দিলারা হাশেম ১৯৭৬ সাল থেকে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগে কর্মরত। ভিনদেশবাসী হয়েও বাংলা ভাষার প্রতি শেকড়ের টানে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলা সাহিত্য চর্চায় মগ্ন ছিলেন।
‘একদা এবং অনন্ত’ (১৯৭৫), ‘স্তব্ধতার কানে কানে’ (১৯৭৭), ‘আমলকীর মৌ’ (১৯৭৮), ‘বাদামী বিকেলের গল্প’ (১৯৮৩), ‘কাকতালীয়’ (১৯৮৫), ‘মুরাল’ (১৯৮৬), ‘শঙ্খ করাত’ (১৯৯৫), ‘অনুক্ত পদাবলী’ (১৯৯৮), ‘সদর অন্দর’ (১৯৯৮), ‘সেতু’ (২০০০), শেষরাতের সংলাপ : টুইন টাওয়ার (২০০৩), ‘হামেলা’ (২০০৬) তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এ ছাড়াও তাঁর রয়েছে গল্প-সংকলন ‘হলদে পাখির কান্না’ (১৯৭০), ‘সিন্ধু পারের উপাখ্যান’ (১৯৮৮), ‘নায়ক’ (১৯৮৯) এবং কবিতা-সংকলন ‘ফেরারি’ (১৯৭৭)।
দিলারা হাশেমের সৃষ্ট কথাসাহিত্যে চরিত্র ও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য পাঠককে আকৃষ্ট করে; তবে প্রধানত নগর জীবন ও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশার ছবিটিই তুলে আনেন। বাংলাদেশের বাইরে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মনোজগৎও তাঁর কথাসাহিত্যের বিশিষ্ট উপজীব্য। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
এ ছাড়া উত্তর শিকাগো ‘কালচারাল এ্যান্ড লিটারারি ইঙ্ক’ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮), অলক্ত পুরস্কার (২০০৪) এবং মুক্তধারা জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯) অর্জন করেন। নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলা ১৯৯৯-এর তিনি ছিলেন উদ্বোধক। নিউইয়র্ক বইমেলার গোড়া থেকেই জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের কার্যকরী কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা।
কেবল লেখকই ছিলেন না, ছিলেন কণ্ঠশিল্পী, তাঁর পরিশীলিত কণ্ঠের গান শুনেছি ঢাকা বেতার থেকে প্রচারিত। তিনি কবিতাও লিখতেন! যদ্দুর মনে পড়ে ছিলেন বেতারের অভিনয়শিল্পী
নিউইয়র্ক বইমেলার পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে তাঁকে লেখক-সম্মাননা দেয়া হয়। সেবার তাঁকে সামনা সামনি দেখলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠেনি। তবে নব্বইয়ের দশকে তাঁর সঙ্গে একদিনের একটা স্মৃতি মনে পড়ছে। দিন-তারিখ মনে নেই- শিরীন বকুল ও আমাদের বন্ধু এহসানুল হক ইসমাইল সেঞ্চুরি টাওয়ারের সামনের পার্কিং প্লেসে গাড়িতে উঠব বলে সেদিন দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সমসাময়িক বন্ধুদের মধ্যে তখন কেবল ইসমাইলেরই গাড়ি ছিল।
মাঝে মাঝে ওর গাড়িতেই আমরা ঘোরাঘুরি করতাম। সেই সময়ই আরেকজন নারীসহ দিলারা হাশেম আমাদের সামনে উপস্থিত। আমরা সকলেই তাঁকে চিনতাম লেখক ও সম্প্রচার-সাংবাদিক হিসেবে পেশায় ব্যবসায়ী হলেও ইসমাইল ছিল আমাদের পড়ুয়া বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম। বকুল তখনই অভিনয়সূত্রে সামান্য পরিচিত হলেও দিলারা হাশেমের তা জানবার কথা নয়।
তিনি কোনো রকম দ্বিধা না করে হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন; বললেন, ‘যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা বলি, আমরা ট্রান্সপোর্ট না পাওয়ায় একটু সংকটে পড়েছি। আমাদের যেতে হবে রামপুরা টেলিভিশন সেন্টারে। আমাদের একটা রাইড দিতে পারলে খুব ভালো হতো।’
ইতোমধ্যে দূর থেকে তাঁকে দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলিও করে নিয়েছিলাম যে, ইনি দিলারা হাশেম। অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি সহজ স্বাভাবিক ভাবে কোনো জড়তা ছাড়াই আমাদের সঙ্গে কথা বললেন।
একে তো তিনি রূপসী, অন্য দিকে চির পরিচয় তাঁর সামগ্রিক ব্যক্তিত্বে। আমরা তিনজনই তাঁর উপস্থিতিতে তখন মুগ্ধ! সত্যি বলতে কি আমাদের নাগরিক জীবনে তখনো সৌজন্যসংস্কৃতি খুব একটা পরিশীলিত রূপ পায়নি বলে এমন অভিজ্ঞতার ঝুলি আমাদের বেশ খালি। হয়তো নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ বলে আমার অভিজ্ঞতা ছিল আরো কম। কথা বলল ইসমাইলই,
‘আমরা তিনজনই আপনার’ লখা পড়েছি। ‘আমলকীর মৌ’ আর ‘ঘর-মন-জানালা।’ ‘স্তব্ধতার কানে কানে’ নামটা বোধ হয় আমি যোগ করেছিলাম। মনে হলো দিলারা হাশেমও আমাদের কথায় অভিভূত ও উচ্ছ্বসিত। আমরা আগেই অভিভূত তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভায়! তিনি বললেন,
‘আমরা যেখানে থাকি সেখানে রাইড চাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। বাংলাদেশে তো তেমনটা এখনো হয়নি। আপনাদের দেখে অনেকটা মনে মনে ভরসা করেই এগিয়ে এসেছিলাম।’
ইসমাইল নিজেই ড্রাইভ করে। বলাবাহুল্য, ইসমাইল আমাদের সঙ্গে নিয়েই তাঁদের রামপুরায় পৌঁছে দিয়েছিল। ঐ সময়টুকু আমাদের তিনজনেরই জীবনের উল্লেখযোগ্য স্মৃতি!
তাঁর লেখাপত্র দীর্ঘকাল আমার পড়ায় অগ্রাধিকার পায়নি। নিউইয়র্কে বাস করতে এসে কিছু পড়েছি। বিশেষ করে তাঁর ‘হামেলা’ উপন্যাসটিকে বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি ব্যতিক্রমী ধারার পথিকৃৎ রচনা মনে হয়েছে। মনে হয়েছে তাঁকে পড়া জরুরি।
আজ তাঁর জন্মদিন। অনেকেই তাঁর কথা মনে করছেন। তাঁর কথা মনে পড়ল বলে আমার এই কথাগুলো লিখে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখলাম!
[দিলারা হাশেমকে নিয়ে আমার ২০২৩ সালের লেখার সামান্য পরিমার্জিত রূপ এটি। রচনাটি গত ফেব্রুয়ারির বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বই ‘মৌহূর্তিকী’তে অন্তর্ভুক্ত আছে! প্রকাশক : সংবেদ, ঢাকা। রকমারিডটকমেও পাওয়া যায়!]