সাহিত্য ও শিল্প কিংবা ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্ক এ-যুগে বিদ্বানদের ধারণা বদলে গেছে
সাহিত্য ও শিল্প কিংবা ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্ক এ-যুগে বিদ্বানদের ধারণা বদলে গেছে। আগেকার যুগে যে- কিছু সুন্দর করে আঁকলে-শিখলেই শিল্প বা সাহিত্যরূপে গৃহীত হতো। তেমনি তথ্যের সমাবেশে হতো ইতিহাস এবং তত্ত্বের উপস্থাপনায় হতো দর্শন।
এখনকার যুগে ঘনিষ্ঠ জীবন-প্রতিবেশের নিরিখেই এগুলোর গুণাগুণ ও উপযোগ নির্ধারিত হয়। যেহেতু মানুষ তার সমকালীন স্বদেশে আনন্দ ও যন্ত্রণা এবং সম্পদ ও সমস্যা নিয়েই বাঁচে সেজন্যে তার সাহিত্যে ও শিল্পে কিংবা ইতিহাসে ও দর্শনে দেশ-কাল-সমাজ-প্রতিবেশপ্রসূত চেতনার স্বরূপ বিধৃত হবে, পাঠক-দর্শক এই প্রত্যাশাই রাখে। যদি সে প্রত্যাশা পূরণ না হয়, তাহলে রচিত শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস-দর্শন উপযোগ হারায়। কেননা উপযোগই সব সাধনার ও গুরুত্ব নিরূপণের মাপকাঠি।
গবেষণাও আজ আর তথ্যের উদঘাটনে ও সমাবেশে সমাপ্ত নয়। দেশগত কালিক জীবন প্রতিবেশের উন্মোচন ও বিশ্লেষণই গবেষকের লক্ষ্য। তাই ইতিহাসের ক্ষেত্রে কেবল বাহ্য ঘটনা কিংবা আচরণ ও তার ফলাফলই শুধু জ্ঞাতব্য নয়।
স্থানিক ও কালিক পরিবেশ, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক মান, ধার্মিক প্রত্যয় ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রভৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সামষ্টিক প্রভাব জন-চৈতন্যে কিভাবে প্রতিফলিত এবং ভাব-চিন্তা-কর্মে কিরূপে অভিব্যক্ত তা দেখা-জানা-বোঝার জন্যই ইতিহাস চর্চায় আজকের মানুষ আগ্রহী। দর্শনও আজ জীবন-নিরপেক্ষ তত্ত্বসর্বস্ব চিন্তার প্রসূন নয়, জগৎ প্রতিবেশে জীবন-চেতনার গভীরতর স্বরূপ যাচাইয়ের উপায় মাত্র।
॥ দুই ॥
গবেষক ড. আহমদ শরীফের মতে, গবেষণার ক্ষেত্রে যারা বিচরণ করেন, সঙ্গত কারণেই তারা হয় অধ্যাপক নয়তো হবু অধ্যাপক। তাই গবেষণা আজো বিশ্ববিদ্যালয়- কেন্দ্রিক। এবং অপ্রিয় হলেও এ-কথা সত্য যে গবেষণা আমাদের দেশে আজো বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতম উপাধি পরীক্ষার স্তর অতিক্রম করেনি। অর্থাৎ জ্ঞানের ক্ষেত্র প্রসারের জন্য গবেষণার অঙ্গনে আজো কেউ তেমন বিচরণ করেন না।
পেশাগত প্রয়াস নেশাগত না হলে আমাদের গবেষণার ক্ষেত্র অভীষ্ট ফসল-প্রসূ হবে না। তাছাড়া বিভিন্ন বিদ্যা আজো ইংরেজির মাধ্যমে অর্জন সাপেক্ষ বলেই গবেষণালব্ধ জ্ঞান, তথ্য ও তত্ত্ব পরিবেশিত হয়। ইংরেজি গ্রন্থেই এবং কিছু অসুবিধে ও কতকাংশে আমাদের হীনম্মন্যতার দরুন গবেষণা-স্থানও ইউরোপ-আমেরিকা। তাই বাংলাভাষা আজো গবেষণা-সাহিত্যে সমৃদ্ধ নয়।
তবু ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কিত কিছু কিছু গবেষণা গ্রন্থ গত চল্লিশ বছরের মধ্যে বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অধ্যাপকরাই প্রধানত এ কৃতিত্বের দাবিদার। এসব গবেষণামূলক রচনা তথ্যে ও তত্ত্বে ঋদ্ধ বটে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বহু প্রত্যাশিত স্থানিক ও কালিক জীবন-প্রতিবেশ নিরপেক্ষ। ফলে এসব গবেষণার উপযোগগত গুরুত্ব সামান্য। দেশগত ও কালগত জীবনের পটে উপস্থাপিত না হলে কোনো জ্ঞানই পূর্ণ জ্ঞানের মর্যাদা লাভ করে না।
॥ তিন ॥
আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্যের দৈন্য ঘুচতে মনে হয় আরো দেরি আছে। অবশ্য পত্র-পত্রিকার প্রয়োজনে প্রবন্ধও প্রায় গল্প-কবিতার মতোই অজ¯্র লিখিত হয়। বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক উৎসব পার্বণ উপলক্ষে স্কুলের ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অবধি সবাই প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু এদের প্রবন্ধ যে প্রতিবেশ সচেতন লেখকের জ্ঞান, মন, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের সমন্বিত অভিব্যক্তির ধারক তা বুঝতে হবে। তাই বক্তব্যহীন বঁাঁচালতা কেবলই আবর্তিত হয়; চিন্তা রুচি কিংবা দৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন ঘোষণা করে না।
প্রবন্ধে যদি লেখকের ব্যক্তিত্বের ছাপ না রইল অর্থাৎ কে বলছে ও কী বলছে, এ দুটোর সমন্বয় না হলো, তাহলে পাঠক মনে সে লেখার কোনো প্রভাবই পড়ে না। যে-কথা কেজো নয়, সে কথা পাগলে ছাড়া কেউ বলে না। বক্তব্য মাত্রেরই উদ্দিষ্ট থাকে শ্রোতা, যে-বক্তব্য বিভিন্ন মুখে বহু শ্রুত তা তাৎপর্যহীন ও আটপৌরে। বহু মনের স্পর্শ তা মলিন ও তুচ্ছ।
প্রবন্ধ যে সবসময় সাহিত্য হবে তা নয়, কিন্তু শোনার মতো বক্তব্য হবে তার প্রাণ। স্বদেশের ও স্বকালের জীবন-প্রতিবেশের আনন্দ ও যন্ত্রণার, সম্পদ ও সমস্যার অভিঘাত যদি মন-বুদ্ধিকে বিচলিত করে, প্রাগ্রসর চেতনায় উল্লাস কিংবা যন্ত্রণা এনে দেয় অথবা কোনো পুরনো ভাব-চিন্তা কর্ম বা তত্ত্ব, তথ্য ও বস্তু নতুন তাৎপর্যে চমকপ্রদ হয়ে ওঠে অথবা চেতনায় নতুন দৃষ্টি দান করে তখনই কেবল বলবার মতো বক্তব্য প্রকাশের আবেগ সৃষ্টি হয়। এবং তেমন প্রবন্ধই কেবল পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করে।
স্বদেশের স্বকালীন মানুষের জীবন ও জীবিকার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির, মত ও পথের, ধর্ম ও সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের সমস্যা ও সংকট যাদের চেতনায় জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে যন্ত্রণা জাগিয়েছে অথবা গভীর উল্লাস ও আবেগ সৃষ্টি করেছে, তারাই কেবল সার্থক প্রবন্ধ রচনা করতে পেরেছেন। তেমন প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রবন্ধকারেরা দেশে চিন্তা- নায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেন, অতুল জ্ঞান-প্রজ্ঞা তত্ত্বের-ভাব-চিন্তাকর্মের ও মত-পথের দিশা দিয়ে তারা জাতিকে যুগোপযোগী ও কল্যাণাভিসারী করে তোলেন।
আমাদের সমাজ-সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমস্যা ও সংকট-সচেতন, যারা শোষিত পীড়িত নির্যাতিত ও মূঢ় দেশবাসীর জন্যে বেদনা-ক্লিষ্ট হৃদয়ে উদ্বিগ্ন চিত্তে প্রতিকার-পন্থা সন্ধানে সদানিরত।
তারা অজ্ঞের অজ্ঞতা, অন্ধের অন্ধতা, মূঢ়ের মোহ, পথভ্রষ্টের যন্ত্রণা ঘুচানোর কাজে তাদের মন-মনন নিয়োজিত করেছেন।
প্রবন্ধ সুচিন্তিত, সুযৌক্তিক ও সুলিখিত হবে বটে, কিন্তু সাহিত্য হওয়া জরুরি নয়। কেননা প্রবন্ধ হচ্ছে চিন্তার ও যুক্তির প্রসূন-গরজের সৃষ্টি। তাই সমকালীন সমাজজীবনের ও জীবিকার যে- কোনো বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচিত হতে পারে। জ্ঞানগর্ভ ও নৈতিক-তাত্ত্বিক প্রবন্ধই কেবল দীর্ঘায়ুর দাবিদার।
অবশ্য জ্ঞান পূর্ণসাপেক্ষ আর নীতিচেতনা এবং তত্ত্ববোধও আপেক্ষিক এবং সে কারণে পরিবর্তনশীল। যেমন চুরি করা অপরাধ; তার শাস্তি হস্ত কর্তন। মানুষের ভাষা, ভঙ্গি ও চেতনা বদলায় বলে সৃজনশীল সাহিত্যও অবিনশ্বর হয় না। যদি সাহিত্যগুণও থাকে তাহলেও বক্তব্যের সাময়িকতা তাকে স্বল্পায়ু করবে। শিল্পগুণের ও বক্তব্যের চিরন্তনত্বের সহ-স্থিতি সুদুর্লভ মহামুহূর্তের দান। তেমন প্রবন্ধ অবশ্যই স্থায়ী সাহিত্য।
বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক
বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম প্রমথ চৌধুরী। তিনি বাংলা সাহিত্যে চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক। তার সাহিত্য রচনার সুনিপুণতা, সৃষ্টিশৈলিতা, গাম্ভীর্যতা, যুক্তিনিষ্ঠতা সাহিত্যের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্য অঙ্গনে প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম ছিল ‘বীরবল। প্রমথ চৌধুরীকে বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।
তিনি প্রবন্ধ রচনা ও সাহিত্য সমালোচনার পাশাপাশি কবিতা, গল্প, চুটকি রচনায় খুব পারদর্শী ছিলেন। ব্যঙ্গাত্মক রচনাতেও তার জুড়ি নেই এবং তার কবিতাগুলো ছিল খুবই বাস্তববাদী এবং রূঢ়। তিনি মূলত সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে সাহিত্য রচনা করতেন। পাঠকের মনোভাব উপলব্ধি করে তাদের অব্যক্ত কথাগুলো তিনি তার ছোট গল্প ও প্রবন্ধে লিখেছেন।
তাই তো তিনি বলেছিলেন, ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়। তিনি রবীন্দ্র যুগে নিজেকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং প্রশংসিত হয়েছেন। প্রথম চৌধুরী সেই সময়কার জনপ্রিয় সবুজপত্র পত্রিকার একজন স্বনামধন্য সম্পাদক ছিলেন।
সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব বেশ সফলভাবে পালন করেন। তার ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি নব্য লেখকদের একটি শক্তিশালী সংঘ তৈরি করেছিলেন। এ পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যের বিকাশে তিনি ব্যাপকভাবে অবদান রাখেন এবং তরুণ প্রজন্মের লেখক ও পাঠকদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোরে তার পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে স্থানীয় জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে সমালোচনার নামে যদিও অনেকে নিন্দা করে, ব্যক্তিকে খাটো করে, তার সৃষ্ট কর্মকে তুলোধুনো করে ব্যক্তি আক্রোশে। প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তার উল্টো গোত্রের যাত্রী।
ব্যক্তি আক্রোশ তার সমালোচনায় ছিল না বললেই চলে। তিনি সাহিত্যের গঠনমূলক সমালোচনা করতেন। যা এখনো তাকে প্রথম শ্রেণির সমালোচকের আসনেই অপরিবর্তিত রেখেছে। নিঃসন্দেহে তার লেখার ধাঁচ বাংলা সাহিত্যের জন্য মাইলফলক।
প্রমথ চৌধুরী ছিলেন মননশীল ও প্রচ- যুক্তিবাদী। তিনি বলেছেন, জ্ঞানের প্রদীপ যেখানেই জ্বালো না কেন, তাহার আলোক চারদিক ছড়াইয়া পড়িবে। মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্যে সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন। স্বদেশপ্রীতি সম্পর্কে তার অভিমত, আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশী না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। তিনি মানসিক যৌবনকেই সমাজে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছেন।
কাব্যসাধনা যে কখনো জোর-করা ভাব, আর ধার-করা ভাষায় পরিণত না হয়, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন। পাবনার বিখ্যাত চৌধুরী বংশের সন্তান প্রমথ চৌধুরী কেবল কুলে-মানে অভিজাত ছিলেন তা নয়, মনের দিক থেকেও ছিলেন উদার। কোন কোন সমালোচক মনে করেন, প্রমথ চৌধুরীর লেখা প্যারাডকসে আক্রান্ত অর্থাৎ যে উক্তি আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয়। কিন্তু সত্য হলো তার লেখার ধরন খুবই বুদ্ধিবৃত্তিক, যুক্তিনিষ্ঠ।
পারিবারিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী-জামাতা এবং বয়োকনিষ্ঠ হয়েও গদ্য রচনারীতিতে রবী ঠাকুরকে প্রভাবিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। যা কবিগুরু নিজেই স্বীকার করে ছিলেন। তিনি খুব উদার মানসিকতা থেকে বলেছিলেন, তার গল্প ও সনেট বাংলা সাহিত্যে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ এবং ভাষাভঙ্গি আর ভাবনার ধারা পরবর্তী একটি গোষ্ঠীর ওপর বিশেষ ক্রিয়াশীল হয়েছে।
বাংলায় কথ্যরীতি তারই হাতে সাহিত্যিক স্বীকৃতি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের জোর সমর্থন এবং ব্যক্তিগত চেষ্টায় সে রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত, প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই এই দুজনের প্রচেষ্টাতে এই কথ্যরীতির পূর্ণতম প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে। সবুজপত্র’ পত্রিকার মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যে নবরীতি প্রবর্তন করেন।
প্রবন্ধ গবেষণার মৌলিক অথচ প্রাথমিক কিছু আলোচনা এখানে আলোচিত হয়েছে। গবেষণা ও প্রবন্ধের কাঠামোগত ও বৈজ্ঞানিক শাস্ত্রগত ব্যাপক বক্তব্য এ পরিসরে অনুপস্থিত।