ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

গল্প ॥ পুতুল

গালিব সৈয়দ

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ৮ আগস্ট ২০২৪

গল্প ॥ পুতুল

পুতুল

গভীর রাতে বৃষ্টি পতনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ফিরোজের। রাত কটা বাজে? তা অনুমান করতে পারল না সে। দেয়ালঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটাটি ক্রমশ ছুটেই চলছে। সেই শব্দ স্পষ্টত শোনা যাচ্ছে। অন্ধকারে সময় দেখা গেল না।
ঘরময় অন্ধকার। ফিরোজ আলগোছে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। শ্রাবণ মাস। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরছে। সেইসঙ্গে দমকা হাওয়া। বারান্দার এককোণায় রাখা পুরনো হাতল ভাঙা কাঠের চেয়ারটি খুঁজে পেতেই বসে পড়ল সে। চতুর্দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং বৃষ্টি পতনের অদ্ভুত শব্দ। গাছের পাতায় বৃষ্টি পতনের সুরে অপার্থিব এক সম্মোহন!
ফিরোজ সিগারেটে আগুন ধরিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফুঁকতে লাগল। ইদানীং তাকে বিক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে। কাজকর্মে তেমন মন নেই। সারাক্ষণ কেমন চুপচাপ বসে থাকে। কারও সঙ্গে কথাও বলতে চায় না তেমন। এমনিতে রোজ সন্ধ্যা হলে দেবীনগর বাজারের কাছাকাছি তালুকদারদের রাইস মিলে বসে আড্ডা দিত। শামীম সুরুজূ নঈমদের সঙ্গে তাস খেলত। মাঝেমধ্যে জুয়াও খেলত। জুয়ায় হেরে গেলে সেদিন আর বাড়ি ফিরত না। রাইস মিলের এককোণেই পাটের বস্তা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
চল্লিশে পা দেওয়ার পর ফিরোজ একটু নড়েচড়ে বসেছে। বয়সটা তো কম হলো না! আগে অবশ্য বয়স নিয়ে সে কোনোদিন ভাবেনি। ইদানীং বউয়ের মুখের দিকে তাকাতেই তার বয়সের কথা স্মরণ হয়। ভেতরটা কেমন কেঁপে ওঠে! সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ষোলো বছরের রোকেয়াকে বিবাহ করেছিল সে! তার মা অবশ্য তাকে আরও আগেই বিয়ে করার জন্য অনেকবার বলেছিলেন। কিন্তু সে তার মার কথায় তখন কর্ণপাত করত না।

তার মা অসুস্থ ছিলেন। জটিল অসুখে বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। তখন তার বড় খালা এসে রান্নাবান্না করে দিয়ে যেতেন। অসুখে শয্যাশায়ী মা তাকে প্রায়ই কান্নাজড়িত গলায় বলতেনূ ‘ফিরোজ! এইবার না হয় বিয়াডা কর বাপ আমার। তোর খালায় আর কদ্দিন আইব? বিয়া কর। আমি তোর বউয়ের হাতে সংসারডা বুঝাইয়া দিয়া যাই। আমি চক্ষু বুঝলে তো এই সংসারডা শ্যাষ! বানের জলে ভাইসা যাব...।’
ফিরোজের ছত্রিশ বছর বয়সে মা মারা যান। পরের বছরই তার বাবা তাকে রোকেয়ার সঙ্গে বিবাহ দেন। সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ষোলো বছরের রোকেয়াকে বিয়ে করাতে আশপাশের অনেকেই চোখ ঠাটিয়েছিল। এত কম বয়সের একটা মেয়েকে কি এমন ষাঁড়ের মতো ছেলের সঙ্গে কেউ বিয়ে দেয়? মেয়ের মা-বাবার কি চোখ নাই? অনেকেই এমন প্রশ্ন ছুঁড়েছিল। তবে বাস্তবতার কাছে মানুষ হেরে যায়। রোকেয়ার মা-বাবাও হেরেছেন। তাঁরা চোখে দেখেই এমন ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছেন।
রোকেয়ার বাবা দেবীনগর বাজারে মসলার কারবারি করেন। সামান্য আয় হয়। সে আয়ের টাকায় সংসার টানতে হিমশিম খান তিনি। তার ওপর তিন তিনটি মেয়ে। এক এক করে মেয়েদের ছাড়াতে গেলেও ব্যাপক খরচাপাতির ব্যাপার। এমনিতে আজকাল দিনে ছেলেপক্ষকে মোটা অঙ্কে যৌতুক না দিলে মেয়ে নিতে চায় না। সেখানে ফিরোজের বাবা একটা টাকাও যৌতুক নেননি। তিনি কেবল রোকেয়াকেই চেয়েছেন ছেলের জন্য। এমন সম্বন্ধ কে হাতছাড়া করে?
ফিরোজের বাবা প্রায়ই বিগলিত গলায় বলেন, ‘তোর মা বাঁইচ্যা থাকলে দেখতি বউরে কত্ত আদর করত। ভালোবাসত।’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘোলাটে চোখ দুটি নোনাজলে আরও ঘোলা হয়ে ওঠে।
ফিরোজের মা মারা যাবার পর সংসারটা বেনোজলে ভেসে যায়নি। রোকেয়া ভেসে যেতে দেয়নি। সে সপ্রতিভ হাতে সামলে নিয়েছে। অথচ ফিরোজের ধারণা সে ক্রমশ বেনোজলে কোথাও যেন ভেসে যাচ্ছে! দূরে কোথাও কে যেন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টিটা ধরে এলে ততক্ষণে ফিরোজের হাতের সিগারেটও ফুরিয়ে যায়। সে ফুরিয়ে যাওয়া সিগারেটটি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে প্যাকেট থেকে আরও একটি সিগারেট বের করে হাতে নেয়। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর স্বর্গীয় এক শীতল হাওয়ার আমেজ টের পেল সে। উঠানে একটি নেবুগাছ। গাছটি তার বাবা পুঁতেছিলেন। শীতল হাওয়ার সঙ্গে নেবুফুলের সৌরভ ভেসে আসছে তার নাকে।

নেবুফুলের সৌরভ নাকে এসে লাগতেই হঠাৎ বউয়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। রোকেয়ার প্রায়ই বমি বমি ভাব হয়। তখন সে দৌড়ে গিয়ে কয়েকটি নেবুপাতা ছিঁড়ে হাতের তেলোয় রেখে আঙুলে থেঁতলে নিয়ে নাকের কাছে ধরতেই বমি বমি ভাবটা কেটে যায়। ফিরোজের বাবা তখন ফিরোজের চোখে চোখ রাখেন। সাংকেতিক ভাষায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চেয়েও লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেন।
হঠাৎ রোকেয়ার কাশির শব্দ শোনা গেল। ফিরোজ উৎকর্ণ হয়ে চুপচাপ বসে রইল। রোকেয়ারও কি ঘুম ভেঙে গেল?
ফিরোজ বেড়ালের মতো সন্তর্পণে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটি লাগিয়ে দিল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে অনুমানে অন্ধকারে হেঁটেও তক্তপোশ অবধি পৌঁছে গেল।
অন্ধকার আর ভালো লাগছে না। ফিরোজ টেবিলের ওপর রাখা মোমবাতিটা জ্বেলে দিল। মোমের আলোয় ঘরটা ঝলমল করে উঠল। রোকেয়া নকশা আঁকা বালিশে তক্তপোশের এককোণ দক্ষিণের জানালার ধারে ঘুমিয়ে আছে। নিজের বউয়ের এমন ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য আগে কোনোদিন খেয়াল করেনি ফিরোজ। সে রোকেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো।

রোকেয়ার ফর্সা গালে মোমের আলো পড়াতে চকচক করছে। ফিরোজ মন্ত্রমুগ্ধের মতো একুশ বছরের যুবকের চোখে তাকিয়ে দেখছে রোকেয়াকে!
সম্বিত ফিরতেই ফিরোজ শামুকের মতো গুটিয়ে নিল নিজের পৌরুষকে। ইদানীং চল্লিশে পা দিয়ে উনিশ বছরের রোকেয়ার মুখের দিকে তাকাতেও ইতস্তত বোধ করে সে। বাতাসে নেবুফুলের সৌরভটা ভীষণ বিতিকিচ্ছিরি ঠেকল তার নাকে এসে! আচমকা এক ফুঁ-য়ে দপ করে মোমবাতিটা নিভিয়ে তক্তপোশের এককোণে জড়সড় হয়ে বসে রইল সে।
বিয়ের পর বন্ধুরা প্রায়ই ফিরোজকে ব্যঙ্গ করে বলত ‘শালা! এতদিন বিয়া করবি না বলে এখন তো ঘরে ডালিমের মতো টুকটুকে বউ আনলি...।’ তাস খেলে ফেরার পথে নঈম প্রায়ই ফিরোজকে চেপে ধরত। জানতে চাইত ওদের দাম্পত্য কথা। ফিরোজ অবশ্য বলতে চাইত না। লজ্জায় চুপসে যেত।
ইদানীং রোকেয়া ফিরোজকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। রাতে বাড়ি ফিরলে একটু দূরত্বেই থাকে সে। কিন্তু কেন? বিয়ের তিন বছর পেরিয়ে যাবার পর এমন কি হলো তাদের মধ্যে? পুরুষ মানুষ দূরত্ব সহ্য করতে পারে না। ফিরোজ তবুও দিব্যি সহ্য করে যাচ্ছে। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত। সে মাঝেমধ্যে দিনের বেলায় তার মার ঘরের ভাঙা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে অবলোকন করে নিজেকে।

আয়নায় ফুটে ওঠা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। গালভর্তি খোঁচাখোঁচা  কাঁচা-পাকা দাড়িগুলো আলতো করে ছুঁয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে। বুড়ো হয়ে গেলাম? হাতের ত্বক ছুঁয়ে দেখে কুঁচকে গেছে কিনা! চল্লিশেও তার পৌরুষ একবিন্দুও দমে যায়নি; এখনো সে টগবগে যুবকের মতো। 
বিয়ের বছর নঈম প্রায়ই ফিরোজকে বলতূ ‘এই বয়সে এমন পুতুলের লাহান বউ ঘরে তুললি। শালা! পরে বুঝবি ঠ্যালা কারে কয়। মাইয়া মানুষ যহন বাঁকাইয়া বইব...।’ প্রত্যুত্তরে ফিরোজ কিছুই বলত না। কেবল চুপ মেরে থাকত। তখন নঈমের কথার সারবত্তা সে যেন বুঝেও বুঝতে চাইত না।

॥ দুই ॥
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। সন্ধ্যা আসন্ন। আকাশে দোয়াতের মতো কালো মেঘ। ফিরোজ আর নঈম রাইস মিলের ভেতর টিনের বেড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। রাইস মিলের সামনেই একটি চালতাগাছ। গাছটিকে আবছা অন্ধকারে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ফিরোজ নির্লিপ্ত চোখে গাছটির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। নঈম পাশে বসেই দেদারসে সিগারেট ফুঁকছে।

হঠাৎ জ্বলন্ত সিগারেটটি ফিরোজের দিকে এগিয়ে ধরে বলল ‘নে! টান দে।’ ফিরোজ এতক্ষণে নঈমের দিকে মুখ ফেরায়। ফিরোজ কিছু বলার আগেই নঈম বলল, ‘এতদিন আইলি না ক্যান? কই ছিলি?’
ফিরোজ সিগারেটটি হাতে নিতে নিতে বলল, ‘শইল খারাপ ছিল।’
‘শইলে আবার কী হইল? বিষ-ব্যতা?’
‘হ। হাত-পা ব্যতা ছিল।’
ফিরোজ অবশ্য মিথ্যে বলেনি। সে ইদানীং হাত-পায়ে খানিকটা ব্যথাও অনুভব করেছিল। তবে মূল কারণ যে ব্যথা নয়। এটা সে নিজেও জানে। নঈমকে সে সত্যটা বলতে চায় না। নঈমের বেফাঁস মুখে কোনো কিছুই আটকায় না। কি বলতে কি বলে ফেলবে কে জানে!
মাগরিবের আজানের পর বৃষ্টির তোপটা একটু বেড়ে এল। রাইস মিলের সামনে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চালতাগাছটি অন্ধকার এবং বৃষ্টির কুয়াশার দেয়ালের ওপাশে আড়াল হয়ে গেল।
ফের গভীর রাতে বৃষ্টি পতনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ফিরোজের। রোকেয়া পাশেই ঘুমোচ্ছে। অন্ধকারে অবশ্য দেখা গেল না। কেবল অস্তিত্বটুকু টের পাওয়া গেল। হঠাৎ রোকেয়ার একটি পা ফিরোজের পায়ের ওপর এসে লাগতেই চমকে উঠল ফিরোজ। এতক্ষণে নিস্তরঙ্গ একটা নদী যেন মুহূর্তেই তরঙ্গিত হয়ে উঠল।
ফিরোজ খানিক বাদেই আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো তার পাশে রোকেয়া নয়Ñ স্রেফ তুলতুলে রক্তমাংসের একটা পুতুল ঘুমিয়ে রয়েছে। যার শরীরে নেবুফুলের গন্ধ।

×