শামসুর রাহমান
বাংলা কবিতার পালা বদলে তাঁর স্বতন্ত্র উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। নামের সঙ্গে ‘প্রধান কবি’ অভিধা সংযুক্ত হওয়ার অনিবার্যতা তাঁর সৃষ্টি কুশলতায়। শামসুর রাহমান পঞ্চাশ দশকে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হয়ে কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য, বর্ণনারীতি ও রূপব্যঞ্জনা নির্মাণে আধুনিক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন।
তিরিশ দশকের পাঁচ কবির আধুনিক কাব্যভূমি নির্মাণ ও নিরীক্ষার যাত্রা চল্লিশের দশকের ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন ও আহসান হাবীবের ভিন্নতর সীমা চিহ্নিত করায় পাঠক পাশ্চাত্য কবিতার নতুন সুর অনুরণিত হতে দেখে। সাত চল্লিশের দেশ ভাগের পর রাজনীতি,অর্থনীতি, সমাজ জীবনের যে পরিবর্তন ঘটে, তা এ অঞ্চলের কবিচিত্তে আলোড়ন তোলে।
ঐতিহ্য চেতনা, গণমানসের প্রতিক্রিয়া নিয়ে যে কয়েকজন কবি কবিতা চর্চায় মনোযোগী, তাদের মধ্যে শামসুর রাহমান ও হাসান হাফিজুর রহমান অন্যতম। স্বদেশ, সমকাল ও স্বাজাত্যবোধ এদের কবিতার আরাধ্য বিষয়। ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের উদ্ভব কবির চেতনায় যে আলোড়ন তোলে, তা পরবর্তীকালে ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চায় এক নতুন গতিবেগের সঞ্চার করে।
বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিবেশ, বাঙালির অধিকার বঞ্চনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবিরা ১৯৫০-এর দশকের আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খান সম্পাদিত ‘নতুন কবিতা’ গ্রন্থে তেরো জন কবি নতুন একটি পথ আবিষ্কারে প্রয়াসী হয়েছিলেন। অনেক কবিই কালের ¯্রােতে হারিয়ে গিয়েছেন। কাব্য প্রতিভার ব্যতিক্রমদীপ্তি ও মেধার স্ফুরণ ঘটে কবি শামসুর রাহমানের কবিতার মধ্যে। শামসুর রাহমান দিন দিন কবিতা সৃষ্টিতে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে একদল কবি স্বদেশ প্রেরণাজাত কবিতায় পাঠককে আকৃষ্ট করেন। কবিতা ভুবনের ভূগোল বদলে দেন গ্রন্থবদ্ধ কবিরা। শামসুর রাহমান এদের মধ্যে অগ্রসর। তাঁর পর্যবেক্ষণ অন্য কবিদের কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করে কবিতার ভাষা নির্মাণ, উপমা প্রয়োগ ও বর্ণনারীতির পরিবর্তনে। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০-এ।
তাঁর কবিতায় আধুনিক জীবনযাপনের সূক্ষ্ম কল্লোল ও নতুন চিন্তাচেতনার অনুপ্রবেশ ঘটে। শামসুর রাহমান সমাজমনস্ক, প্রকৃতিপ্রেমিক ও আত্মজৈবনিক বিষয় তাঁর কবিতায় ধারণ করে ব্যতিক্রমী হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে।
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’-তে মানুষের সৌন্দর্যপ্রিয়তা, স্মৃতি ও অন্ধকার থেকে আলোতে প্রত্যাবর্তনের তৃষ্ণাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। বিষণœতা, নিঃসঙ্গ চেতনা, প্রেম ও নতুন পৃথিবীতে প্রবেশের প্রবল স্পৃহা তাঁর গ্রন্থভুক্ত কবিতাতে এক নতুন জগতের উন্মোচন করে। আত্মমগ্ন সৌন্দর্য পিয়াসী কবি নিজের চারপাশের সবকিছু পরখ করে দেখেছেন। অবিরত উল্লাস ও আনন্দ ধ্বনি উচ্চারণে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন কবি।
মনোজগৎ ও স্বপ্নময় পৃথিবীতে বিচরণ করে শামসুর রাহমান রচনা করেছেন তাঁর ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’, ‘জর্নাল’,‘এ্যাপোলোর জন্য’, ‘রূপালী ¯œান’, ‘কবর খোঁড়ার গান’,‘একান্ত গোলাপ’, ‘সেই ঘোড়াটা’, ‘তিনশ টাকার আমি’ ইত্যাদি গ্রন্থ। পৃথিবী তাঁর সৌন্দর্য ও স্বপ্ন এবং চারপাশের ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে শামসুর রাহমান তাঁর পাঠককে পরিচিত করে তোলেন এক নতুন জগতের সঙ্গে। তাঁর কণ্ঠ আর্দ্র:
ভাস্করের অসম্পূর্ণ মূর্তিরা ঘরে ফিরে
উল্লোল নগরে কতো বিলোল উৎসবে, কিন্তু তবু
পারিনা মেলাতে আপনাকে প্রমোদের মোহময়
বিচিত্র বিকট স্বর্গে;
[প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে]
শামসুর রাহমান তাঁর আত্মমগ্নতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বদেশ, মানুষ, রাজনীতির ঘূর্ণি ও ব্যক্তিগত সুখ দুঃখে লীন হয়েছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে ‘রৌদ্র করোটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’, ‘নিজ বাসভূমে’, ‘বন্দী শিবির থেকে’, ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’, ‘একধরনের অহঙ্কার’, ‘আমি অনাহারী’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’, ‘মাতাল ঋত্বিক’, ‘ইকারুশের আকাশ’, ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘নায়কের ছায়া’, ও ‘একফোঁটা কেমন অনল’ কাব্যগ্রন্থের বিপুল ঐশ্বর্যম-িত কবিতায় তাঁকে অন্য কবি পরিচিতি বহন করে।
ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তে শামসুর রাহমান তাঁর কবিতার চারণ ভূমিকে প্রচ-ভাবে শস্যশ্যামল ও গতিময় করে তুলেছেন। দুঃখিনী বর্ণমালা, আসাদের শার্ট, স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতাকে ঘিরে তাঁর আবেগ প্রকাশ, বর্ণনা উত্তরোত্তর আমাদের চেতনাকে শাণিত করেছে তীব্রভাবে।
একীভূত পাঠক যে কবিকে তার কবিতার মাধ্যমে চেনে সে প্রথম কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্র থেকে পৃথক ও দৃঢ়চেতা একজন। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’র উৎসর্গ অংশে উল্লেখ করেছিলেন: ‘আমার খামার নেই, নেই কোনো শস্যকণা/ আছে ধুধু একটি আকাশ/ তার কিছু আলো আজো সুদূরতমা/ ভালোবেসে তোমাকে দিলাম’।
শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, কবিতা দুইটি রচনা করেছিলেন অবরুদ্ধ বাংলাদেশের এক মধ্য দুপুরে। আর কোনো কবিতা না লিখলেও তিনি এই দুইটি কবিতার জন্য অমরতা পেতেন। আবেগ, ভাষাশৈলী ও আবেদন কবিতা দুইটিকে মহিমান্বিত করেছে। শামসুর রাহমান দেশের চলমান রাজনীতি, দুঃশাসন ও সাধারণ মানুষের মর্ম যাতনায় সমব্যথী ছিলেন।
প্রলোভনের কাছে নত না হয়ে অটল দ্রোহী হয়ে ওঠা ছিল তাঁর স্বভাবগত। প্রকৃতি ও নারীপ্রীতি ছিল তাঁর অন্তর্গত সত্তার একটা অংশ। ক্রমাগত পরিণত হয়ে উঠে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সত্য ও সুন্দরকে। চিত্রকল্প, সুষমা ও বাক কুশলতা তাঁর কবিতায় অঙ্গীভূত হয়েছিল:
স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল,
স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের
অবাধ সাঁতার।
................................
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা
[স্বাধীনতা তুমি]
শামসুর রাহমান আত্মপ্রত্যয়ী। তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় আত্মমগ্নতা থেকে বেরিয়ে এসে পরবর্তীতে দেশের দুঃসময়ে তিনি উচ্চকিত কণ্ঠে সোচ্চার হয়েছেন: ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্য আর কতোকাল ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়/ আর কতোবার দেখতে হবে খা-ব দাহন/ তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা/ সখিনা বিবির কপাল ভাঙলো/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেলো হরিদাসীর।
এ কবিতায় তিনি দরিদ্র মেহনতি মানুষের দুর্দশা তুলে ধরেছেন অতি সযতনে। শেষে দীপ্ত উচ্চারণ: পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে দামামা বাজিয়ে দিক বিদিক/ এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে/ হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা।
শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে উদ্দেশ করে সিকান্দার অবু জাফর সম্পাদিত সমকালে ১৯৫৮ সালে লেখেন ‘হাতির শুঁড়’। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কীর্তি নিয়ে বহু কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর স্মরণযোগ্য কবিতাটি হচ্ছে ‘টেলেমেকাস’। স্বৈরাচার পতনের পর সালে তিনি রচনা করেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। তার আগে প্রতিবাদে উচ্চারণ করেন ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’।
শামসুর রাহমান অসংখ্য কবিতায় স্বদেশ, স্বাধীনতা, পূর্বপুরুষের গৌরব ও বাঙালির অহংকারকে ধারণ করেছেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতায় তাঁর বেদনার্ত কণ্ঠ থেকে উৎসারিত হয়েছে ‘বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে/ সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা/ দেখলাম রাজপথে দেখলাম আমরা সবাই জনসাধারণ/ দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো/ ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা/ আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে/ এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে/ ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে’।
শামসুর রাহমান জীবনানন্দের চোখে পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষ একাকার হয়ে আছে। তিনি ‘ধূসর সন্ধ্যা’, ‘ইঁদুরের মতো মৃত্যু’, ‘এ্যাপোলোর জন্য কবিতা’য় যে রূপক ব্যঞ্জনা তৈরি করেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। ভোরের শিশিরের চাকচিক্যে কবি মনোমুগ্ধতা খুঁজে পান এবং রাতের শিশিরের বিন্দু বিন্দু জলের মধ্যে কবি অজ¯্র তারাকে দেখতে পান ‘জর্নাল শ্রাবণ’-এ। শামসুর রাহমান কবিতার পথ ধরে দীর্ঘসময় পরিভ্রমণ করেছেন। অতিবাহিত করেছেন সারাটি জীবন।
তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩)’। সৌন্দর্য রহিত এক পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে কবির চোখের সামনে। ঢাকা নগরের রুগ্নতা ও রুক্ষতার প্রতিভাস তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। ভিখেরি, মাতাল, বিধ্বস্ত কোলাহল, বস্তির ব্যথিত রুগ্ন পরিবেশ ও মানুষের আহাজারি কবিতার ভাষাকে আরো বিষণœ করে তোলে। ‘সর্বনাম’-এর বিপুল ব্যবহার বারবার উঠে আসে শামসুর রাহমানের কবিতার মধ্য দিয়ে:
দুঃখ ভারাক্রান্ত এই কবি উচ্চারণ করেন:
আমাদের বারান্দার ঘরে চৌকাঠে
কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর ঘাটে
দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি
ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়
দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি
এবং বুলোয়
তুলি বাঁশি-বাজা আমাদের এই নাটে।
আমাদের এক রত্তি উঠোনের কোণে
উড়ে আসা চৈত্রের পাতায়
পা-ুলিপি বই ছেঁড়া মলিন খাতায়
গ্রীষ্মের দুপুরে ঢকঢক
জল খাওয়া কুঁজোয় গেলাশে, শীত ঠক ঠক
রাত্রির নরম লেকে দুঃখ তার বোনে
নাম
অবিরাম। ...
কখনো না দেখা নীল দূর আকাশের
মিহি বাতাসের
সুন্দর পাখির মতো আমার আশায়
হৃদয়ের নির্ভৃত ভাষায়
দুঃখ তার লেখে নাম
[দুঃখ : রৌদ্র করোটিতে]
‘দুঃখ’ শামসুর রাহমানের চোখে সর্বদা সর্বব্যাপী গ্রাস করে আছে মানবের জীবনে। একজন দুঃখী মানুষ চারপাশের সব স্থানে তার বেদনাকে জাগ্রত করে রাখে প্রতিনিয়ত। যাপিত জীবনে সে বারবার যে কোনো প্রকারের সুন্দরকে স্পর্শ করার আকাক্সক্ষায় যেমন ব্যাকুল থাকে, তেমনি আনন্দকে ভাগ করে নেয়ার শক্তি তার মধ্যে ক্রিয়াশীলভাবেই থাকে দিন শেষেও। বেদনা ও দুঃখ সমার্থক অর্থ বহন করে কবির সারা জীবনে। দুঃখের মধ্যেও একধরনের ব্যাপকতা, স্পর্শ চেতনাকে শামসুর রাহমান জাগরিত রাখেন তাঁর হৃদয়ের গহীনে।
শামসুর রাহমান আত্মপ্রত্যয়ী এক কবি। তাঁর সৌন্দর্যপিয়াসু কবিসত্তা স্বদেশ ও সমকালের চিত্রসমূহ একত্রিত করে যে ক্রমবহমান সেলুলয়েডের ফিতায় আটকে দেয়, সমাজ জীবনে তা আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত। ‘রৌদ্র করোটিতে’ বস্তুবাদী বিশ্বেও যে পরিচিত ব্যাপ্ত হয়, তা তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’তে প্রসারমান হয়ে ঢাকা নগরের ব্যস্ত জীবনে অনায়াসেই ঢুকে পড়ে।
শামসুর রাহমান কঙ্কাল সঙ্গে নিয়ে হাঁটেন। নিজেকে আবিষ্কার করেন শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিবাহী ঘটনার মধ্য দিয়ে। সে জীবনের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন তৈরি করে কবি তাঁর সময়কে চিত্রিত করেন এক অপূর্ব কাল্পনিক জগতের ধারাবাহিকতায়। কল্পনা আর বাস্তবের সমকাল প্রবাহিত জীবন, অতীত ভবিষ্যতের দিকে তাঁর হাতখানি তুলে ধরে। কবির নিবিড় সমাজলগ্নতা অন্তরঙ্গময়। তিনি বলেন:
আমি এক কঙ্কালকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটি, প্রাণখুলে
কথা বলি পরস্পর। বুরুশ চালাই তার চুলে,
উড়াই সযতনে মুখে পাউডার, দর্জির দোকানে নিয়ে তাকে
ট্রাউজার, শার্ট, কোট ইত্যাদি বানিয়ে ভদ্রতাকে
সঙ্গীর ধাতস্থ করি। দু’বেলা এগিয়ে দিই নিজে
প্রত্যহ যা খাই তাই। কখনো বৃষ্টিতে বেশি ভিজে . . .
আমি এক কঙ্কালকে সঙ্গে নিয়ে চলি দিন রাত
অসঙ্কোচে, আতঙ্কের মুখোমুখি কখনো হঠাৎ
তাকে করি আলিঙ্গন, প্রাণপণ ডাক নামে ডাকি
দাঁড়িয়ে সত্তার দ্বীপে নি-শিকড় একা আর ঢাকি . . .
দু’জনের অস্তিত্বের গ্রন্থিল জগতে, বুঝি তাই
ঘৃণায় পোড়ায় তাকে, কখনো হৃদয়ে দিই ঠাঁই।
[যে আমার সহচর : বিধ্বস্ত নীলিমা]
শামসুর রাহমান অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন। প্রত্যেক কবিতায় তাঁর নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি রয়েছে, যা তাকে পাঠকের কাছে নিয়ে গেছে একেকবার একেক রূপে। তবু বলতে হবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও পরবর্তী সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনাবর্তে তিনি যা কিছু কবিতার উপাদান সংগ্রহ করেছেন, তা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যঞ্জনাময়ী। দুঃসময় যখন আসে নীলিমা ধূসর হয়ে মানুষ বদলে যায়। যে বিশ্বাস ও ঐক্যবদ্ধতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিল বাস্তবে তা লীন হয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে তা ম্লান হয়ে পড়ে স্বার্থ চিন্তায়। কবি মাত্রই দুঃসময়ের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। শামসুর রাহমানও সচেতনভাবে দুঃসময়কে মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে তৈরি করে আরো সামনে এগিয়ে গেছেন। তাঁর নিজস্ব দুঃখ, জীবনযাপন ও পরিবেশ কবিতাগুলোকে স্পর্শকাতর করে তোলে। স্বপ্ন, প্রেম ও জাগতিক তৃষ্ণায় ব্যাকুল কবি যেনো সংবাদ পৌঁছে দেন একজন নিষ্ঠাবান সংবাদকর্মীর মতো। তাঁর সহজ সরল স্বীকারোক্তি:
যখন তোমার সঙ্গে আমার হলো দেখা
লেকের ধারে সঙ্গোপনে,
বিশ্বে তখন মন্দা ভীষণ, রাজায় রাজায়
চলছে লড়াই উলুর বনে।
[প্রেমের কবিতা]
শামসুর রাহমানের কবিতায় পিতা পুত্র ও স্বজনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ব্যাপকভাবে। তিনি ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক সম্পর্ক ও সমাজের উত্থান-পতনকে তাঁর কবিতায় বন্দী করেন অনায়াসে, সহজ সরলভাবে। একজন সচেতন কবি তাঁর সময় থেকে দূরে থাকতে পারেন না। পিতার মুখ উদ্ভাসিত হয় এভাবে ‘সেদিন দেখেছি স্বপ্নে এলেন তিনি ম্লান/ জটিল পাঁচিল ঘেঁষে এলেন আমার পিতা/ মৃত/ ক্রুদ্ধ/ অনুযোগে কম্পমান/ তবে কি বেয়াড়া কিছু ঘটেছে শহরে; [অধমর্ণের গান]
শামসুর রাহমান ‘হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো’, ও শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থে রূপময় স্বদেশ, শস্যশ্যামল ভূমি ও কাক্সিক্ষত স্বপ্নের উদ্দেশ্যে তাঁর অভিসারের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তিমির বিনাশী কবি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন এই সুন্দর জীবনানন্দের রূপসী বাংলায়। শামসুর রাহমান তাঁর চোখের সামনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন দীর্ঘদিন।
আশা তাঁকে প্রবলভাবে তাড়িত করেছে। মাঝে মধ্যে নিরাশা ও দুর্ভাবনার জালে তিনি আলোড়িত হয়েছেন দুঃস্বপ্নের মতো। দীর্ঘ সাধনার পর একটা সময় তিনি দুঃসময় ও অন্ধকার থেকে আলোর মোহনায় পৌঁছে গেছেন। তাইতো শামসুর রাহমানের প্রত্যেকটা কবিতায় আমরা দেখতে পাই স্বদেশ উর্বরা, শত্রুমুক্ত ও নিরাপদ জীবনের গল্প। কবি হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন স্বপ্ন জ্বালিয়ে রাখতে হয়।
ভবিষ্যৎ কোনো না কোনো সময় আশায় আলোময় হয়ে উঠবে- এ বিশ্বাস থেকে কবির কবিতা হয়ে ওঠে মানুষের পথচলার প্রতিচ্ছবি, আলোকবর্তিকা। কবি তো ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। সমকাল ও স্বাজাত্যবোধ এদের কবিতায় আরাধ্য।
শামসুর রাহমান একজন প্রকৃত নাগরিক কবি। নগরে বাস করা প্রতিটি মানুষের মতো ক্লান্তি, নৈরাশ্য ও আত্মমগ্নতা তাঁকেও মাঝে মধ্যে গ্রাস করে। তাঁর কবিতায় আত্মমগ্নতা ও দুঃখ বারবার হানা দিয়েছে। ক্রমে তিনি অতিক্রম করেছেন নিজেকে। সমাজলগ্ন সচেতন এক কবির আনন্দ-বেদনায় লীন হয়ে স্বদেশের পুণ্যভূমিতে তিনি ফিরে এসেছেন বারবার।