মোপাসাঁকে
বিশ্ব সাহিত্যে ছোট গল্পের নতুন আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা করেন ফ্রান্সের মোপাসাঁ। তাই ফ্রান্সে ছোট গল্পের জনক হিসেবে ধরা হয় মোপাসাঁকে। কারো কারো বক্তব্য অনুযায়ী মোপাসাঁর হাতে পৃথিবীর প্রথম ছোট গল্পের জন্ম। আমেরিকার এলেন পো এবং রাশিয়ার গোগোলকে বলা হয় সে দেশের ছোট গল্পের জনক।
তাছাড়াও ফরাসি সাহিত্যে এমিল জোলা, আলফাস দোঁদো, আনাতোল ফ্রাঁস, রুশ সাহিত্যে পুশকিন, গোগোল, তলস্তয়, চেকভ, তুর্গেনিভ, গোর্কি, ইংরেজি সাহিত্যে গলসওয়ার্দি, সমারসেট মম, পি. জি. ওডহাউস, ও হেনরি এরকম অনেকের হাতে ছোট গল্প, গল্প হয়ে উঠেছে। আর আমাদের বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষে আর্বিভাব ছোট গল্পের। তাই অনেকে বলেছেন, বাংলা সাহিত্যের কনিষ্ঠতম সন্তান ছোট গল্প। আবার কথাশিল্পী গাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেস গল্প ও উপন্যাসের সরল ও কৌতুকপ্রদ একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন-‘ছোট গল্প হচ্ছে প্রেম আর উপন্যাস হচ্ছে বিয়ে।’
বাংলা ছোট গল্পের প্রথম আভাস পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪) ও ‘রাধারাণী’ (১৮৭৫) গল্পে। তবে প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথের হাতেই ছোট গল্প প্রাণ পেয়েছে একথা সার্বজনীন। তাঁর প্রথম গল্প ‘ভিখারিণী’ এই গল্পটি ১৮৭৪ সালে ভারতী পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। ঠিক এই গল্পের ষোল বছরপর তিনি সার্থক ছোট গল্প উপহার দিলেন গল্প পাঠকদের। সেই গল্পটি হলো ‘দেনা পাওনা’। ১৮৮৪-৮৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘ঘাটের কথা’ রাজপথের কথা’
‘মকুট’। এরপর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) এর আর্বিভাব বাংলা ছোট গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর প্রথম ছোট গল্প ‘মন্দির’ তাকে অনেকটাই গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। জীবনসন্ধানী শিল্পী হিসেবে তিনি তাঁর গল্পগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়া সে সময় আমরা আরো বেশ কয়েকজন যেমন- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) এমনি অনেককে গল্পকার হিসেবে পেয়েছি।
বিভাগপূর্বকালে ছোট গল্প রচনায় খ্যাতি লাভ করেছেন এমন আরো কয়েকজন হলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, রাজশেখর বসু, সতীনাথ ভাদুড়ী, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ।
দেশবিভাগ পূর্বে এসব গল্পকারদের মধ্যে প্রকৃত ছোট গল্পের স্বাদ যে রবীন্দ্রনাথের গল্পের ভিতর পাঠক খুঁজে পেয়েছে, এটা ঐতিহাসিক সত্য। পাশাপাশি আজকে আমার লেখায় যে গল্গকারের গল্প নিয়ে মূল আলোচনায় ঢুকবো, তিনি রবীন্দ্রনাথ যখন গল্প লেখায় প্রায় থেমে গেছেন, ঠিক সে সময় তিনি গল্প রচনায় আত্মসমর্পণ করেছেন।
তিনি মনোজ বসু। জন্ম ১৯০১ সালের ২৫ জুলাই। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এই সুসাহিত্যিক উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনীর পাশাপাশি ছোট গল্পে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এমন এক সময়ে তিনি জন্মেছিলেন ঠিক যখন তাঁর যৌবন শুরু, সেই সময় শুরু হলো প্রথম বিশ^যুদ্ধ। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই সেই যুদ্ধের আগুনের আঁচ থেকে আমরা মুক্ত থাকবো সেটা কেমন করে। অর্থ্যাৎ প্রথম বিশ^যুদ্ধের রাজনৈতিক ক্ষুধা পর্যবসিত হলো এদেশের সাহিত্যিক ক্ষুধায়।
ফলে, দেখা গেল গ্রামীণ মানসিকতার পালাবদল। শিক্ষিত গ্রামীণ বাঙালি গ্রাম পরিত্যাগ করে শহরে ওঠার প্রবণতা যেমন দেখা দিল, তেমনি সাহিত্য সংস্কৃতিতে দেখা গেল এর প্রভাব। মনোজ বসু সেই উত্তাল সময়ের মানুষ হলেও তিনি স্বতন্ত্র রইলেন স্বতন্ত্রে।
মনোজ বসু ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন শিক্ষক। যে কারণে আদর্শের ক্ষেত্রে তিনি কখনো আপোস করেননি। শহর জীবনের উগ্র আকাক্সক্ষা তাঁকে গ্রাম থেকে বলা যায় আলাদা করতে পারেনি। তাইতো মনোজ বসুর সমগ্র সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করলে একথা নিশ্চিত বলা যায় যে, তিনি তাঁর যাপিত জীবনের ঘটনা প্রবাহ নিয়েই রচনা করেছেন তাঁর সাহিত্য সম্ভার।
১৯৩০ থেকে ১৯৪২ সালের কালপর্বকে আমরা যদি আধুনিক ছোটগল্পের বিস্তারকাল বলি, তাহলে দেখা যায় এই সময় প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, বদ্ধুদেব বসু, অন্নদাশংকর রায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যেপাধ্যায় প্রভৃতি লেখকগণ বাংলা সাহিত্যে অনেক বিখ্যাত গল্প উপহার দিয়েছেন। মনোজ বসুও ঠিক সেই সময়কার গল্প লেখক। একজন আধুনিক কথাশিল্পী। গ্রাম মনোজ বসুর রচনার প্রথম প্রেম। মনোজ বসুর সাহিত্য কর্মের পটভূমি সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন-‘আমার গ্রাম সুন্দরবন অঞ্চলে’। যে কারণে তাঁর রচনায় বাদাবন আর তৎকালীন সময়ের গ্রামীণ সরল জীবনকে তুলে ধরেছেন নিখুঁত ছোট গল্পকার হিসেবে। মনোজ বসুর ছোট গল্প গ্রন্থের সংখ্যা ১৫ টি।
প্রথম মুদ্রিত গল্প ‘গৃহহারা’ এই গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিলো বিকাশ ২য় বর্ষ ৩য় সংখ্যা ১৩২৭ বঙ্গাব্দ। দ্বিতীয় মুদ্রিত গল্প ‘ছাপ’। এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ‘বাঁশরী’ ফাল্গুন ১৩৩১ সংখ্যায়। মনোজ বসুর শ্রেষ্ঠ রচনা সম্ভারের শ্রেষ্ঠ গল্পের সম্পাদক বারিদবরণ ঘোষ উল্লেখ করেছেন-‘বিদ্যালয় জীবনে প্রকাশিত গল্প রচনার কাল বাদ দিয়ে এমনকি বিচিত্রায় (কার্তিক ১৩৩৭) ‘নতুন মানুষ’ গল্পকে ছেড়ে দিয়ে যদি প্রবাসীতে (১৩৩৮) প্রকাশিত তাঁর ‘বাঘ’ গল্পটিকে আদি সাহিত্য প্রতিষ্ঠা গল্প বলে ধরেন, তবে বলা যায় গল্পলেখক মনোজ বসুর সাহিত্যিক আর্বিভাব তাঁর ত্রিশ বছর বয়সে আরম্ভ হয়েছিলো।’
ঠিক সেই সময়টাকে বাংলা সাহিত্যের সুপ-িতরা অর্থ্যাৎ ১৯৩০ থেকে ১৯৪২ সালের কালপর্বকে আধুনিক বাংলা ছোট গল্পের বিস্তার কাল বলে উল্লেখ করেছেন। সেই সময় সব গল্পলেখকের গল্পে যখন সত্যিকার ছোট গল্পের স্বাদ পাঠক আহরণ করছিলো, সে সময়ই আসর জমেয়েছিলেন মনোজ বসু। তিনি ছিলেন পুরাটাই গ্রামের মানুষ। অজপাড়াগাঁয়ে তাঁর জন্ম (যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ডেঙ্গিঘাটা গ্রামে) ।
তাই গ্রাম মনোজ বসুর রচনার প্রথম প্রেম। পল্লীপ্রকৃতি ও মানুষের গলাজড়াজড়ি করে তিনি তাঁর গল্প উপন্যাসের প্লট তৈরি করেছেন। সে সময়কার শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের গল্প যখন গ্রাম থেকে শহরে উপনীত হয়েছে, মনোজ বসুর গল্প তখন শহর থেকে গ্রামকে কেন্দ্র করে পরিক্রমা করছে। গ্রাম জীবনের শাশ্বতরূপ, প্রেম রোমান্টাকিতায় ভরপুর, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কোন কিছুই গল্পকারের অনুসন্ধানী দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকেনি। যে কারণে পাঠক একদিকে যেমন বাস্তব জীবনের স্বাদ আহরণ করেছে, তেমনি গল্পগুলো হয়ে উঠেছে জীবন্ত।
তাঁর রচনাগুলোতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আদর্শের ছাপ সুস্পষ্ট। আমরা যদি এবার তাঁর গল্পগ্রন্থগুলোর দিকে একটু চোখ ফেরাই, তাহলে দেখা যাবে- ‘বনমর্মর’-১৩৩৯, ‘নরবাঁধ’-১৯৩৩, ‘দেবী কিশোরী’-১৯৪৩, ‘একদা নিশীথকালে’-১৯৪২ ‘দুঃখ নিশার শেষে’-১৩৮১, ‘পৃথিবী কাদের’-১৯৪০, ‘উলু’-১৯৪৮, ‘খদ্যোত’-১৩৫৭, ‘কাঁচের আকাশ’-১৯৫০, ‘দিল্লী অনেক দূর’-১৯৫১, ‘কুষ্কুম’-১৩৫৯, ‘কিংশুক’-১৩৬৪,‘মায়াকন্যা’-১৩৬৮,‘কল্পলতা’-১৯৬৬,‘ওনারা’ (ভৌতিক)-১৩৭৬।
এই সব গল্প নিয়ে পরবর্তীতে কয়েকটি গল্প সংগ্রহ গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। আমরা যদি সেগুলো একটু জানার চেষ্টা করি, তাহলে দেখবো- জগদীশ ভট্টাচার্য সম্পাদিত- ‘মনোজ বসুর শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৫০), রবীন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত ‘গল্প সংগ্রহ’ (১৩৬৪), ‘গল্প পঞ্চাশৎ’ (১৯৬২), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নির্বাচিত ‘মনোজ বসুর শ্রেষ্ঠ গল্প’ ১৩৭৮, ভূদেব চৌধুরী সম্পাদিত ‘গল্প সমগ্র’ (৪ খ-ে) প্রকাশিত হয়েছে।
এত গল্পসমগ্র প্রকাশিত হওয়া মানে তাঁর গল্পের পাঠক চাহিদা এবং পাঠকের আগ্রহ প্রমাণ করে নিঃসন্দেহে। মনোজ বসুর যত গল্প সঙ্কলিত হয়েছে, সেদিকে যদি একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করি, তাহলে দেখা যায় কয়েকটি শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে বিজ্ঞজনদের নিকট আলোচিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘বনমর্মর’ একটি। এই গল্পটির গঠন কৌশল ব্যঞ্জনাসমাবেশ সম্ভাবনীয়তার সীমার মধ্যে কল্পনাসঙ্কোচ এ তিনটি গুণের কারণে গল্পটিকে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনোজ বসুর সর্বপ্রধান গল্প বলে অভিহিত করেছেন। মাথুর, গয়না, একটি জমা খরচ, খাজাঞ্চিমশায় ও ভাইজি, পৃথিবী কাদের, দানবের গান, দিল্লী অনেক দূর, উলু, বীরপূজা, দিকপাল সরকার, হাসি হাসি মুখ, উত্তরের পথ দক্ষিণের পথ, একদা ছিলেন, কানু কাঙ্গুলির কবর, ভেজালের উৎপত্তি ইত্যাদি তাঁর উল্লেযোগ্য গল্প।
মনোজ বসুর একটি অন্যতম সেরা গল্প ‘উলু’। গল্পটি পারিবারিক ¯েœহ ভালবাসা আর রোমান্টিক রসে ভরপুর, তবে বেশ বিয়োগান্ত। গল্পটি নিয়ে লেখক পরবর্তীতে রচনা করেছেন ‘শেষলগ্ন’ নাটকটি। এ নাটকটি এত বেদনাদায়ক যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র লেখককে বলেছিলেন, “এত বেদনা দর্শকদের সহ্য হবে না।” গল্পের মূল বিষয় একজন বিয়ের কনেকে কেন্দ্র করে।
বিয়ের কনে গৌরি নির্দিষ্ট দিনে বিয়ের জন্য বউ সেজে বসে আছে। বর আসবে ধুমধাম করে, তার বিয়ে হবে। লগ্ন দুইটি একটি সন্ধ্যার পর আর একটি মধ্য রাত্রি। একে একে দুইটি লগ্নই পার হয়ে গেল, বর এলো না। সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এমন সময় খট-খট করে ঘোড়া ছুটিয়ে মধু চক্রবর্তী ও ঘটক ত্রিলোকতারণ এলেন। ঘোড়া থেকে ঘটক লাফিয়ে পড়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললেন- নৌকাডুবি হয়েছে।
লেখকের ভাষায়-‘ভারতের দেউলের ঐখানটায় এসে বাবুরা সব একদিকে ঝুঁকে পড়লেন। মাঝগাঙে কুমির ভেসে যাচ্ছিল। কোটালির গাঙ টনের মুখ”। তখন লগ্নভ্রষ্টার আশঙ্কাকে দূর করার জন্য ঠাকুরদাদার বয়সি বিপতœীক নিশি মল্লিককে ডেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হলো। কিন্তু বিয়েতে উলু দেওয়ার প্রথা থাকলেও কেউ উলু দিচ্ছে না। কারণ, তখন সকলের গলা শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে, কি হওয়ার কথা ছিলো আর কি হতে চলেছে এই ভেবে। গৌরি তখন নিজেই সকলের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে উলু দিতে আরম্ভ করলো। কি বেদনাদায়ক করুণ পরিণতি।
চমৎকারভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন গল্পকার মনোজ বসু। যা পাঠকের হৃদয়কে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে এবং একটি প্রকৃতি ছোট গল্প হিসেবে জয় করেছে বোদ্ধাপাঠকদের হৃদয়। আবার যদি ‘গয়না’ গল্পের কথা বলি খুব ছোট আকারের গল্প এটি। লেখক এই গল্পটিকে শুরু করেছেন ঠিক এভাবে- ঘোলের শরবত, দই আর পাতিলেবু এনে রেখেছিলাম বাজার থেকে। খাও, শরীর জুড়োবে। ইস-কী চেহারা করে এসেছ! আমার কান্না পায়।’ বেকার অখিল বাইরে থেকে আসলে তার স্ত্রী সুরমা বলছে কথাগুলো। অখিল তার স্ত্রীর কাছে দেখায় আশ্চর্য সতীপনা।
সংসার অচল তবু সে স্ত্রীর গয়নায় হাত দেবে না পণ করেছে। এমনকি সে তার আংটি বোতাম বন্ধক রাখবে, তবুও সে স্ত্রীর গয়না নষ্ট করবে না। এমন কথা শুনে সুরমা চোখের জল আড়াল করে তার স্বামীকে বলে, তোমার যদি কাজে না লাগে, তাহলে ও গয়না দিয়ে কি হবে? অথচ অখিল ঘুমিয়ে পড়লে সুরমা পাশের ফ্লাটের লিলির কাছে তার আংটি বোতাম রেখে এসেছে এ বলে-‘তুই রেখে দে ভাই, কি জানি তালা খুলে চুরি করে যদি বের করে নেয়। অভ্যাস আছে তো ? আরো অনুরোধ করে বলেছে, ও দুটোর বদলে যেন গিল্টি করা দুটো গয়না এনে দেয়।
‘আমার সর্বস্ব ঘুচিয়ে ও যেমন গিল্টির গয়নায় বাক্স ভরিয়ে রেখেছে ঠিক তেমনি।’ স্বামী আর স্ত্রীর কত প্রেম অথচ ভিতরে ভিতরে রয়েছে কত ব্যবধান। চলমান জীবনে এমনি নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে মনোজ বসু রচনা করেছেন তার ছোট গল্পগুলো। দারিদ্র্যের চরম যন্ত্রণা তাঁর ছাত্র জীবনটাকে টালমাটাল করে তুলেছিলো। তবুও তিনি আপোসহীন সংগ্রাম করে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতা জীবনে পররবর্তীতে যথেষ্ট সাফল্য আসলেও গ্রাম বাংলার স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেননি।
তাইতো তিনিই পেরেছেন অসাধারণ মুগ্ধতায় ও সহজ সরল ভাষায় গ্রাম বাংলার নানা ছবি অংকন করতে, যা পাঠক হৃদয় জয় করেছে। এক সময় গ্রাম বাংলায় ভূতের গল্প খুব বেশি প্রচলিত ছিলো, যে গুলো পড়ে ভয় পাবার সাথে সাথে কিছুটা দুঃখ বা মায়া জাগতো মনে। তাই গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যেন একটা রেশ থেকে যেত। আর মনোজ বসু এখানেই সার্থক। মনোজ বসুর ‘লালচুল’ গল্পটি হলো সেইরকম এক মর্মস্পর্শী ভূতের গল্প।
অতি সাধারণ বিষয়গুলো গল্পকার মনোজ বসুর চোখে প্রকৃত ছোট গল্প হয়ে উঠেছে- যদি ‘জমাখরচ’ গল্পের কথা বলি- ছোট মেয়ের বিয়ের রাত্রে রসময়বাবু আকস্মিকভাবে মারা গেলেন। মন্ত্রপড়া এবং কনের পিঁড়ি ঘোরানো ইত্যাকার অনুষ্ঠানগুলো হয়ে গিয়েছিলো, তাই রক্ষা হঠাৎ কি হলো- কোন ডাক্তার তার হদিস পায় না।’ কত চমৎকার নাটকীয় শুরু। গ্রামের একজন সাধরণ মানুষ সারা জীবনের সংসার খরচকে কিভাবে খাতায় হিসাব রেখেছেন, সেই অতি সাধারণ ঘটনাকে গল্পের প্লটে তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে।
এমনি ভাবে গ্রামজীবন সর্বস্বতা ও বৃত্তিকেন্দ্রিকতা নিয়েও তাঁর গল্পের কাহিনী। মনোজ বসুর কলম মানব-মানবী, সমসাময়িক রাজনীতি অতি সাধারণ সমাজ জীবনের রোমান্টিকতার যাদু সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন বলেই তিনি একজন বিভাগ পূর্বকালেই প্রকৃত ছোট গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন পাঠকমহলে। স্বাধীনতার পরবর্তী এত এত গল্পের মাঝেও মনোজ বসুর সেইসব ছোটগল্প যেন আজও পাঠককে টানে। পূর্বেই বলেছি মনোজ বসুর গল্প, উপন্যাসগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গ্রামই তাঁর রচনার প্রথম প্রেম।
তাঁর স্মৃতিমূলক রচনা ঝিলিমিলিতে তিনি নিজেই লিখেছেন- ‘গ্রাম আমার সুন্দরবন অঞ্চল থেকে দূরবর্তী নয়, এখন পাকিস্তানে (অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে -সম্পাদক) চলে গেছে। কাঠ কাঠতে মধু ভাঙতে জীবিকার শতধিক প্রয়োজনে লোকে বনে যায়- বাঘ কুমির-সাপের কবলে পড়ে তার মধ্যে কতজনে আর ফেরে না। জনালয় থেকে বিচ্ছিন্ন, বনবিবি ও বাঘের সওয়ার, গাজি-কালুর রাজ্য রহস্যময় সুন্দরবন ছোটবেলা থেকে আমায় আকর্ষণ করত। দেশ বিভাগের আগে সমগ্র সুন্দরবন আমি ঘুরেছি।...
ঠিক বাঘের গল্প নয়- কিন্তু রয়্যাল-বেঙ্গল টাইগারের আস্তানা সুন্দরবন নিয়ে দুটো উপন্যাস (‘জলজঙ্গল’ ও ‘বন কেটে বসত’) ও কতকগুলো গল্প লিখেছি আমি। কোন কোন অংশ একেবারে বনের ভিতর খালের উপর নৌকায় বসে লেখা। এসব লেখাও পাঠকেরা সমাদরে গ্রহণ করেছেন।’ ‘পৃথিবী কাদের’ ‘ধানবনের গান’ এমনি অনেক গল্প যা তিনি রচনা করেছেন গ্রাম জীবনের বাস্তব প্রেক্ষাপটে।
কালজয়ী এ সুসাহিত্যিক মনোজ বসু উপন্যাস, ভ্রমন কাহিনী, কবিতাতে যেমন পাঠক হৃদয় কেড়েছেন, তেমনি একজন ছোট গল্পকার হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছেন। যদি ধরে নেওয়া যায় ‘নিশিকুটুম্ব’ (আকাদেমী পুরস্কার প্রাপ্ত-১৯৬৬) ‘বন কেটে বসত’ ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ কিংবা ‘সেই গ্রাম সেই সব মানুষ’ এর মতো আলোচিত উপন্যাস মনোজ বসুর হাতে সৃষ্টি হয়নি, তাহলেও তিনি একজন বিখ্যাত গল্পকার হিসেবে বিভাগপূর্বকালে যে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন, একথা একজন পাঠক হিসেবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে নরসিংহদাস পুরস্কার, একাডেমী পুরস্কার, শরৎচন্দ্র পদক, মতিলাল ঘোষ পুরস্কারসহ বহু সম্মানজনক পুরস্কার তিনি অর্জন করেছেন। লেখক : সহকারী অধ্যাপক জামিরা কলেজ, ফুলতলা, খুলনা