ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

গল্প ॥ বর্ষা যার মেয়ের নাম

রাফাতুল আরাফাত

প্রকাশিত: ২২:২৮, ২৫ জুলাই ২০২৪; আপডেট: ২২:৩৫, ২৫ জুলাই ২০২৪

গল্প ॥ বর্ষা যার মেয়ের নাম

বর্ষা যার মেয়ের নাম

আষাঢ় মাস। সাজিদ বাসা পরিবর্তন করেছে সপ্তাহখানেক হলো। এরপর থেকেই বৃষ্টি। থেমে থেমে, কখনো মুষলধারে, কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি। বৃষ্টিতে টিউশনগুলোতেও যাওয়া হচ্ছে না। ছাত্ররা নিজেরাই না করে দিচ্ছে। শহরে তেমন বন্ধুবান্ধবও না থাকায় পুরো সময় ঘরেই কাটছে। বন্ধু যে একেবারেই নেই তা নয়, দুয়েকজন আছে। তারা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। 
সাজিদ সদ্য বেকার একজন যুবক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। এখন রাজশাহীতে থেকেই চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। খুব দ্রুতই হবে এমন বোঝা যাচ্ছে না। বন্ধুদের কারও কারও চাকরি হয়ে গেছে। ফেসবুকে ঢুকলেই এর ওর চাকরির পোস্ট। সেজন্য ফেসবুকেও ঢোকা কমিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত বেকার। কিছুদিন হলো টুকটাক সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে। সিগারেট খেলে নাকি মাথা কিছুটা হালকা হয়।

এর আগে একটা মেসে দীর্ঘদিন ছিল। সেখানে পড়ার পরিবেশ নেই, পড়ার পরিবেশ নেই বললে ভুল হবে, ন্যূনতম থাকার পরিবেশ নেই। তাই একা বাসা নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বাসা নেওয়ার সময় আর কিছু না দেখলেও বেলকুনি আছে কিনা ঠিকঠাক গুরুত্ব দিয়ে দেখে নিয়েছে। এ বাসাটা সুন্দর। পাশে বড় কোনো বিল্ডিং নেই বিধায় প্রচুর আলো-বাতাস আসে। তিন পাশেই ফাঁকা, বেলকুনির সামনে পাশের বাসার চিলেকোঠা। ওর চিলেকোঠা নিয়েও ফ্যান্টাসি ছিল। এই ফ্যান্টাসিতে কলেজে পড়ার সময় ঝিগাতলায় একটা চিলেকোঠায় ভাড়াও নিয়েছিল।

শেষে গরমে এমন অবস্থা, এক রকম পালিয়ে আসতে হয়েছে বাসা থেকে। আপাতত ওর চিলেকোঠা নিয়ে ফ্যান্টাসি নেই। এ বাসাটার আরেকটা সুবিধা হলোÑ পাশেই প্রচুর গাছগাছালি আছে। সকাল শুরু হয় পাখির ডাক দিয়ে আর বিকেলে ছোটখাটো পাখির সমাবেশ বসে এখানে। 
আজ দুপুর থেকে বৃষ্টি নেই। সাজিদ বেলকুনিতে বসে সিরিয়াস ভঙ্গিতে সিগারেট খাচ্ছে। সিরিয়াস ভঙ্গিতে সিগারেট খাবার ব্যাপারটা সে উপভোগ করছে। ও যখন ছোট ছিল, তার বাবা বাসায় টাকা-পয়সার টানাটানি হলে উঠানে বসে এমন সিরিয়াস ভঙ্গিতে সিগারেট খেত। তার বসার ভঙ্গির জন্যেই কেউ তার আশপাশে যাবার সাহস করত না। সাজিদ কি এখন তার বাবার ভূমিকায় অভিনয় করছে? পারতপক্ষে সে সুযোগ আসলে নেই। তার বাবার ব্যক্তিত্বের কিছুই সে পায়নি। সংসার নিয়েও সে ভাবে না।

কিছুক্ষণ বসে থেকে যেন বসে থাকাতেও বিরক্তি আসছে। বর্ষায় এমন কিছু হয় বোধহয়। ওর বেডরুমের জানালা দিয়ে পাশের বাসার চিলেকোঠার ছাদ দেখা যায়। রুমে এসে চোখ লেগে লেগে আসছিল। হঠাৎ নূপুরের শব্দ আসছে কানে। আধোঘুমে নূপুরের শব্দ ইল্যুশন তৈরি হবে হবে এমন সময় সাজিদের ঘুম ভেঙে যায়। 
বাইশ-তেইশ বছরের একটা মেয়ে চিলেকোঠার ছাদে নাচের প্র্যাক্টিস করছে। সাজিদ রুমের জানালা দিয়ে মেয়েটার নাচ দেখছে। খুব রূপবতী এমন মনে হচ্ছে না। নাচের মুদ্রাটাও ভালো লাগছে না তার। ক্লাসিক ধরনের কোনো একটা মুদ্রা। তবু ওর মেয়েটার দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে। তাকানোতে কিছুটা ক্লান্তি, কিছুটা কৌতূহল। বিকেলের ঘুম হঠাৎ ভেঙে যাবার পর সবচেয়ে বেশি কাজ করা উচিত বিরক্তি। তা কেনো কাজ করছে না তা ভেবেই কৌতূহল হচ্ছে সাজিদের। সে উঠে চা বানায়। ইদানীং চা খুব বেশিই খাওয়া হচ্ছে। চা না খেলে মাথা ধরে থাকে। চা হাতে নিজের বারান্দায় দাঁড়ায় সাজিদ। মেয়েটা নাচ করা থামিয়ে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সাজিদ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে।
-আমি সাজিদ। এ বাসায় নতুন এসেছি। আপাতত ফুল টাইম বেকার। আপনার নাম জানতে পারি?
সাজিদ মেয়েটার কাছে খুব বেশি পাত্তা পেলো না। মেয়েটা একবার তার দিকে তাকিয়েই ভেতরে চলে গেল। সাজিদের অপমানিত হওয়ার কথা থাকলেই অপমানিত বোধ হচ্ছে না। সেদিন বিকেল পেরিয়ে রাত হলো। সাজিদের মা ফোন দিয়েছিল। টানা বৃষ্টিতে তাদের বাসায় পানি উঠেছে। তার মা অনেকক্ষণ ধরে পানি উঠার বর্ণনা দিলেও সে শুধু হু আচ্ছা বলেছে। তার দুনিয়ার কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই, ব্যাপারটা এমন নয় মোটেও। এমন দিনে ঘরে পানি উঠার মতো একটা বোরিং ব্যাপারে আগ্রহ পাচ্ছিল না আর কি। তার উপর আজ তার বুয়া আসেনি। হয় রান্না করে খেতে হবে, না হয় না খেয়ে থাকতে হবে। সে টুকটাক রান্না পারে কিন্তু আজ ইচ্ছা করছে না।
সকাল থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মুষলধারে পড়ছে। বৃষ্টি নিয়ে জীবনানন্দ দাশের কোনো কবিতা আছে কিনা সাজিদ মনে করার চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। আপাতত মনে করার চেষ্টা না করাই ভালো মনে হচ্ছে। কখনো কখনো এমন চিন্তা মনকে অস্থির করে তুলতে পারে। হঠাৎ অদ্ভুত একটা চিন্তা মাথায় ঘুরছে তার। বনলতা সিনেমা হলের ছাঁদে শুয়ে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠিক কেমন লাগতে পারে? সাজিদ সৈকতকে ফোন দেয়। সৈকত তার কলেজের বন্ধু। এমনিতে যোগাযোগ নেই।

হুটহাট এমন অদ্ভুত প্রশ্ন মাথায় আসলে সে সৈকতকে ফোন দেয়। সৈকত এতোদিনে বুঝতে পেরে গেছে ব্যাপারটা। সে তার প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে উত্তর দেয়- আমার ধারণা মরা মানুষের মতো লাগবে। তবে ঠিক না ভিজলে বুঝা যাচ্ছে না। এ বলে ফোন কেঁটে দেয়। 
বিকেলে মেয়েটা চিলেকোঠার ছাদে আসে। সাজিদ নিজের বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সে আড়চোখে মেয়েটাকে দেখে। আজ আর কথা বলতে চাওয়া ঠিক হবে না। গতকাল বেশ অপমানিত হতে হয়েছে। 
- আপনার সিগারেটের গন্ধে আমাদের বাসাতেও থাকতে কষ্ট হয়। 
মেয়েটার কথা শুনে সাজিদ থতমত খেয়ে সিগারেট ফেলে দেয়। 
- আচ্ছা আর খাবো না। 
মেয়েটার কিছুটা ভাবলেশহীনভাবে বলে- আপনাকে কেউ সিগারেট না খেতে বলেনি। শুধু বারান্দায় বসে না খেলে আমাদের জন্য সুবিধা হয় আর কি। 
সাজিদ কিছুটা বিব্রতবোধ নিয়ে ঠিক আছে বলে রুমে চলে আসে। 
বেশ কয়েকদিন আর মেয়েটার সঙ্গে দেখা নেই। বিকেলে সাজিদ টিউশন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, বাসায় ফিরতে রাত নয়টা। এসে টুকটাক কাজ সেড়ে ঘুম। শুক্রবার বিকেলে তাদের আবার দেখা হয় চিলেকোঠা ছাঁদ আর বেলকনিতে। দুইজন দুই সীমানায়। 
- আমার নাম অর্পা। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বাংলা ডিপার্টমেন্টে। 
অর্পার আগ বাড়িয়ে পরিচিত হতে আসা সাজিদকে কিছুটা অবাক করে। এই প্রথম মেয়েটাকে তার রূপবতী মনে হচ্ছে। 
- আসলে আমি চেইন স্মোকার নই। কিছুদিন বাসায় থেকে বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। 
সাজিদের মাথায় সেদিনের ব্যাপারটাই ঘুরছে। 
অর্পা সাজিদের কথার উত্তর না দিয়ে বললো - 
এখানে আমরা এসেছি মাস তিনেক হলো। প্রচুর কাঠবিড়ালি এখানে। কাঠবিড়ালি প্রাণীটার মানুষের প্রতি প্রবল অবিশ্বাস। 
সাজিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে- এমন মনে হলো কেনো?
- ওরা মানুষের আনাগোনা পেলেই পালিয়ে যায়। সেজন্য মনে হলো আর কি। 
- আমার আসলে প্রাণী নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। দোয়েল পাখি নিয়ে ছোটবেলায় শুনতাম এরা মানুষের কাছাকাছি আসে না। এখানে এসে দেখি আমার জানালায় বসে থাকে!
- আপনাকে দোয়েল মন হয় মানুষ ভাবছে না। 
দুইজন একসঙ্গে হেসে উঠে। 
সাজিদ কথা বাড়ায়। আপনি নাচ করেন দেখেছি। ক্লাসিক নাচ সম্ভবত। আমি নাচেরও কিছু বুঝি না। হা হা
অর্পা এই কথার উত্তর দেয় না। মুচকি হেসেই কথোপকথন শেষ করে।
এরপর মাঝেমধ্যে সাজিদ অর্পার দেখা হয়েছে। চোখাচোখি, ছোটো ছোটো আলাপ। সাজিদ একবার অবশ্য ভেবেছিল অর্পাকে কফির দাওয়াত দেবে। সময় সুযোগ করে আর বলা হয়ে উঠেনি। 
সাজিদ মাস দুয়েকের জন্য বাসায় ছিল না। গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। তার বাবা মারা গেছে। বাবার রেখে যাওয়া ঋণ আর বাড়ির জমি সংক্রান্ত ঝামেলা মিলিয়ে একটা দুর্বিষহ সময় কাটিয়ে সে রাজশাহীতে ফিরল। ফিরে সব নতুন লাগছে। পাশের বাড়ির চিলেকোঠায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। অর্পারা চিলেকোঠা ছেড়েছে সে বুঝতে পারে বিকেলে। চিলেকোঠার ছাদে নতুন বাচ্চা দেখে। বাচ্চার সঙ্গে সে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছে, খুব বেশি পাত্তা পায়নি। 
- তোমার নাম কী?
বাচ্চাটা কোনো রকম বিচলিত না হয়ে উত্তর দেয়- অপরিচিত লোকের সঙ্গে আমি কথা বলি। মা নিষেধ করেছে। 
- তোমরা এ বাসায় কবে এসেছো এটা বলা যাবে?
- হ্যাঁ, এটা বলা যাবে। এ মাসেই উঠেছি। 
সাজিদ আর কথা বাড়ায় না। বেডরুমে চলে আসে। 
বাবার মৃত্যুর পর সব কেমন বদলে যেতে শুরু করেছে। চাচাদের ব্যবহারগুলো এখনো চোখে ভাসছে। কবরস্থান নিয়ে ঝামেলা হলো। ভাইয়ের লাশ মাটিতে রেখে কবরস্থান নিয়ে কেউ ঝামেলা করতে পারে সে এটা কয়েকদিন আগেও বিশ্বাস করত না। এখন আপাতত এগুলো ভাবতে ভালো লাগছে না। সে কিছু ভালো স্মৃতি ভাবতে চাইছে। তার মন আরও বিষণœ হচ্ছে। এই বিষণœতার কারণ অর্পা। হঠাৎ করেই অর্পার জন্য তার খারাপ লাগছে। সাজিদের বাবার জন্যেও মন খারাপ লাগছে। এই লোকটাকে সারাজীবন এগিয়ে চলেছে ও। বাবা মাঝেমধ্যে বলতেন- বিষণœতাকে পাত্তা দিতে নেই। এটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। 
সাজিদের দুঃখ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সকাল গড়িয়ে বিকাল। এ সময়ের বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। তবু কেমন আষাঢ় মাসের মতো বৃষ্টি হচ্ছে। সাজিদ অর্পাকে মিস করছে। এই মিস করার নাম ভালোবাসা কিনা জানা নেই ওর। হতে পারে তীব্র বিষণœতায় ওর মাথা কোনো নিরাপদ আশ্রয় পেতে চাইছে। এই নিরাপদ আশ্রয় কি অর্পা? অর্পা যদি নিরাপদ আশ্রয় হয়, তাহলে তো তা ভালোবাসাই। 
দিন গড়ায়, রাত গড়ায়। কয়েক বর্ষা চলে গেছে। এর মধ্যে সাজিদের মাও গত হয়েছেন। চাকরির কিছু হয়নি। আজ একটা চাকরির পরীক্ষা সাজিদের। পরীক্ষার কেন্দ্র রাজশাহী নিউ গভ. স্কুল। কিছু হবে না জেনেও খুব সিরিয়াস মুখ নিয়ে পরীক্ষা দিতে যাবার জন্য বেরিয়েছে। রিকশা ডাকতে যাবার সময় তার চোখ হঠাৎ মার্বেলের মতো স্থির হয়ে উঠে। সে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে-
- তুমি? কেমন আছো?
সাজিদ অর্পাকে আপনি সম্বোধন করতো তা ভুলে গেছে। 
অর্পা উত্তর দেয়- ভালো আছি। চাকরির পরীক্ষা নাকি?
- ওই দিচ্ছি আর কি। কিছু হবে টবে না। যতদিন বয়স আছে দিয়ে দেখি। 
অর্পা চুপ করে আছে। সাজিদ আবার বলে-
- তোমরা এখন কোথায় থাকো? আমি গ্রাম থেকে ফিরে এসে দেখি তোমরা চিলেকোঠাটা ছেড়ে চলে গেছো। 
অর্পা সাজিদের কথার উত্তর না দিয়ে বলে- আমার মেয়ে। এ বছরই স্কুলে দিলাম। 
- বাহ। খুব মিষ্টি। তোমার মতো ফুটফুটে হয়েছে দেখতে। কী নাম ওর?
- বর্ষা। 
- বেশ সুন্দর নাম। আচ্ছা শোনো, আমার পরীক্ষার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি। ভালো থেকো। 
অর্পা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। বেস্ট অব লাক বলে মেয়েকে নিয়ে রিকশায় উঠলো। 
সাজিদের সময় থেমে গেছে। কোনোমতে রিকশায় উঠার পরই মাথায় বর্ষা শুরু হয়েছে। রিকশা চলছে, এর সঙ্গে সাজিদের মাথায় ঝড় শুরু হয়েছে। ঝাউয়ের বনে ঝড় হলে যেমন শব্দ হয়, তেমন শব্দ হচ্ছে। 
- মামা কোথায় যাবেন?
রিকশাওয়ালার কথায় ও বাস্তবে ফিরে আসে। 
- যাব না কোথাও। 
সাজিদ পদ্মার পাড়ে এসে বসেছে। কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না। কেবল মনে হচ্ছে, নিজের ভেতর ঢুকে কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে আসতে, যে বাস্তবতায় বর্ষা তাদের মেয়ে।

×