ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

মরুর দেশ মিসর

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২২:২৬, ২৫ জুলাই ২০২৪

মরুর দেশ মিসর

মরুর দেশ মিসর

কায়রো থেকে ঘণ্টা দুয়েক উড়ে ভোরের দিকে পৌঁছেছি আসোয়ানে। এখান থেকে আবু সিম্বেলের দূরত্ব প্রায় তিন শ’ কিলোমিটার। যাওয়ার একমাত্র উপায় সড়ক পথ। সাহারার বুকচিরে পথ গেছে সোজা। কখনো সামান্য আঁকাবাঁকা। তবে পুরোটাই সমতল। গাইড, গাড়ি আগে থেকেই রেডি। তাই ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মিটিয়ে সোজা গাড়িতে। 
গাইড য়াহমেদ ছ’ ফুটের মতো লম্বা। বয়স পঞ্চাশের ওপর হবে। বাদামি গায়ের রং। পোশাকে পারিপাট্য নেই। চালচলনেও স্মার্টনেস নেই ততটা। জীবন-জগত সম্পর্কে তেমন আগ্রহ আছে বলেও মনে হয় না। জীবিকা নির্বাহের জন্যই কাজটা করা, বোঝা যায়। তবে কাজে ফাঁকি নেই। তথ্য আছে তার কাছে প্রচুর। ওটা সাপ্লাই করাকেই সে তার কর্তব্য মনে করে। গর গর করে কথা বলে যায়। টকিং মেশিন বা ইনফরমেশন বক্সও বলা যায় ওকে। গাড়িতে উঠে আবু সিম্বেল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে প্রায় এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে দিল। ব্যাস, ইনফরমেশন ডেলিভারি শেষ।

এবার একেবারে চুপ। কায়রোর গাইড আবির হাম্মাদ স্মার্ট তরুণী। নিজের দেশ সম্পর্কে যেমন বলত আমাদের দেশ সম্পর্কেও জানতে চাইত। এর এসবের বালাই নেই। বারো সিটের মাইক্রোবাসে য়াহমেদসহ যাত্রী আমরা পাঁচজন। আর সামনের দুসিটে দুজন চালক। ইউরোপের মতো এখানেও দূর যাত্রায় দুজন চালক। একজন চালায় অন্যজন বসে থাকে। দুই ঘণ্টা পর পর ডিউটি বদল। 
গাড়িতে আপাতত নৈশব্দ নেমেছে। কায়রো থেকে দুই ঘণ্টার ফ্লাই হলেও সারা রাতই কেটেছে প্রায় নির্ঘুম। সন্ধ্যায়  পিরামিডে ‘সাউন্ড অ্যান্ড লাইট’ দেখে হোটেলে ফিরতে প্রায় দশটা। আসার পথে রাতের খাবার খাওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা সব ট্যুর অপারেটরের। মিসরের স্থানীয় খাবার খাওয়ালো এক রেস্তোরাঁয়। গ্রিল করা বড় পাখি।  সবজির সালাদ। সঙ্গে লুচির চেয়ে একটু বড় আকারের তেল ছাড়া রুটি। লুচি না বলে ছোট তন্দুরের মতো বললে বেশি ঠিক হয়। ভেবেছিলাম এ পর্যন্তই। দুপুরের খাবার দেরিতে খেয়েছি।

এই আমাদের জন্য যথেষ্টর চেয়ে বেশি। হলে কি হবে কর্তৃপক্ষ তা মনে করে না। সুতরাং একের পর এক আসতে থাকে ভেড়া, গরু ও মুরগির তিন রকম। সবজি, ডাল, মাছ রাইস। কয়েক রকমের সস তো টেবিলে আছেই। ‘রান্নাঘরে আরও’ কত কি আছে সৈয়দ মুজতবা আলীর আব্দুর রহমান থাকলে হয়তো বলতে পারতো। সামান্য খেয়ে কিছু প্যাক করে নেই। রাত দুটোয় হোটেল থেকে বেরোতে হবে। তখন কারও খিদে পেলে খাবে। বাকি খাবার পড়ে রইল রেস্তোরাঁর টেবিলে। কিন্তু হায়! মাঝ রাতে কারোরই আর খিদে পায়নি। প্যাকেটের খাবার প্যাকেটেই রইল। আমরা ছুটি এয়ারপোর্টের উদ্দেশে।
আত্মপ্রচারের মতো শোনালেও প্রসঙ্গত বলি, মিসর ভ্রমণটা আমাদের অনেক দিনের পরিকল্পনা এবং অর্থ সঞ্চয়ের সমন্বয়। আর দশটা ভ্রমণের মতো নয়। মানবসভ্যতার উন্মেষের দেশ মিসর। সভ্যতার ইতিহাস শুরুর সেই অধ্যায় দেখায় কোনো বাধা যাতে না থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় পড়াশোনা ও প্রস্তুতি যেমন ছিল তেমনি আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য ‘পাঁচ তারকা’ মানের ব্যবস্থাও ছিল। পাঁচ তারকা হোটেল, ‘নাইল ক্রুসিং’য়ে ‘পাঁচ তারকা’ জাহাজ। সার্বক্ষণিক গাড়ি। আলাদা আলাদা গাইড। সব ব্যবস্থা ঢাকা থেকেই করা হয়েছে। নইলে ওই বিশাল মরুর দেশ, উত্তর থেকে দক্ষিণ- ছুটোছুটি করা বেশ মুশকিলও হতো। 
এমত আয়োজনের জন্য কায়রো এয়ারপোর্টে নামার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাভেল এজেন্সির প্রতিনিধি মোহাম্মেদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হই। যেন বাংলাদেশ থেকে আমরা চার ভিআইপি পৌঁছে গেছি তার দেশে। ওর এজেন্সির সুনামেরও ব্যাপার আছে। মিসরের প্রথম সারির তিন এজেন্সির মধ্যে ওরটা এক নম্বর। সুতরাং আচার ব্যবহার আদব-কায়দাও তেমনই হতে হবে। তবে নিঃসন্দেহে মানুষ হিসেবে মোহাম্মেদ যাকে বলে ‘ভালোমানুষ’ তাই। করপোরেট জগতের মুখোশ মানুষ নয়।

বিনয়ী, বন্ধুবৎসল হাসিখুশি ভদ্রলোক। কিছু মানুষ দেশকাল নির্বিশেষে মানুষের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে জন্মায়। একে দেখে তাই মনে হয়। যেন কতকালের চেনা আপনজন। পাসপোর্ট, ভিসাগুলো ওর হাতে দেওয়া ছাড়া এয়ারপোর্টের বিরক্তিকর আনুষ্ঠানিকতার কোনো কিছুই করতে হয়নি। ঝাড়া হাত পায়ে সোজা গাড়িতে। 
তার আগেই অবশ্য দ্বিতীয় মোহাম্মেদ হাজির। গাড়ি নিয়ে এসেছে হোটেলে পৌঁছে দিতে। মোহাম্মেদ ট্রাভেল এজেন্সির মাঝারি গোছের কর্মকর্তা। চটপটে, স্মার্ট। নানা বিষয়ে কথা বলে আমাদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। এক ঘণ্টার পথ, যেন বোর না হই। চার সদস্যের জেন্ডার ব্যালান্সড ট্রাভেল টিমের পুরুষ সদস্য দুজনার কারও নামের আগে মোহাম্মদ নেই। নারী দুজনার আউটফিটেও বিশেষ ট্রেড মার্ক নেই।

মোহাম্মেদ সম্ভবত দ্বিধায় পড়ে। সরাসরি জিজ্ঞেস না করে আলাপ চালিয়ে যায়- ‘মিসরে সাড়ে নয় কোটি জনসংখ্যার নব্বই ভাগ মুসলমান। উই আর সুন্নি মুসলিমস। সুন্নিদের নামের আগে মোহাম্মদ থাকা সুন্নত। তার এ তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেও ইচ্ছে করেই ওই পয়েন্টে না গিয়ে আমরাও নিজ দেশের আকার আয়তন জনসংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলি। সেও আর ওদিকে যায় না। শুধু জানায়, সুন্নি মুসলমানের বাইরে তার দেশে খ্রিস্টান এবং অন্য আরও কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। তা আমরাও বলি বিভিন্ন ধর্ম এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের কথা। কথায় কথায় হোটেলে পৌঁছাই। হোটেলের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা মোহাম্মেদই সম্পন্ন করে। আমরা লবিতে বসে থাকি। 
হোটেল তো নয় বিশাল সমুদ্র। ঢুকতেই ফারাও দ্বিতীয় রামসিসের ছাদ ছোঁয়া বিশাল পাথরের মূর্তি। ছত্রিশ তলা হোটেল। কত যে তার রুম, স্যুট, কত ইউনিট, হলওয়ে তা ভালো করে বুঝতে শুধু ওখানে থাকার জন্যই আরেকবার যেতে হয়। আমরা পড়েছি চব্বিশ তলায়। ওখান থেকে শহরের মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া নীলনদ দেখা যায়। আকাশের তারা ও রাস্তার মানুষ দেখা যায়। এই নীলনদের পাড়ের মানুষেরাই এক সময় বিশ্বাস করত নীল ওই আকাশে আছে এ রকম আরেক নদী। এ নদীতে যেমন তারা নৌকায় পারাপার করে মৃত্যুর পর আকাশ নদীর ওপারের জীবনে পৌঁছাতেও লাগে এ রকম নৌকা। বিশেষ ধরনের নৌকা বানাতো তারা। ইজিপসিয়ান মিউজিয়ামে আগের সেই নৌকার বেশ কিছু রেপ্লিকা আছে। 
নদীর মতোই শান্ত ধীর এ অধিবাসীরা নক্ষত্রের গতি দেখে বছর গোনা শুরু করেছিলেন। তারাই হিসাব কষে বের করেছিলেন সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে পৃথিবীর তিন’শ পঁয়ষট্টি দিন লাগে। প্রাচীন লিখন রীতিও তাদের আবিষ্কার। চিত্র-লেখ বা হায়রো গ্লাইফিক বর্ণমালায় লিখতেন তারা। প্যাপিরাস থেকে কাগজের আবিষ্কারকও তারা। 
নীল নদের নি¤œাংশ বা অববাহিকা অঞ্চলের অধিবাসীদের আবিষ্কার বা নিদর্শনের বেশিরভাগই পলি মাটির নিচে চাপা পড়লেও ইতিহাস ও নৃতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন নীল নদের এ অঞ্চলের সভ্যতাই অধিকতর প্রাচীন ও প্রগতিশীল। কিন্তু এ যাবত পাওয়া আদি নিদর্শনগুলোর বেশির ভাগই উদ্ধার হয়েছে দক্ষিণ মিসর থেকে। তাই মিসর কাহিনীর শুরু দক্ষিণাংশ থেকে ধরা হয়। 
নীল নদ নিয়ে ছোট বেলায় শোনা টুকরো টুকরো কাহিনী নীল আকাশের ওই তারাদের মতো মনে ভিড় করে। ফেরাউনের  অত্যাচারে জর্জরিত মুসা নবী মানুষের কল্যাণ চেয়ে সব অত্যাচার নীরবে সয়েছেন। শেষ লড়াইয়ে জিতে যাওয়ার বিস্ময়কর দৃশ্য এখনো মনে গেঁথে আছেÑ ফেরাউন তার বাহিনী নিয়ে তেড়ে আসছে, লাঠি হাতে মুসা নবী একা এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। নীল নদের পাড়ে এসে এক মুহূর্ত হতবিহ্বল। কি করে পার  হবেন এ বিশাল নদী! ওদিকে শত্রু প্রায় ঘাড়ের কাছে।  লাঠি হাতে নামেন নদীর কিনারে। কি আশ্চর্য! লাঠির স্পর্শে নদীর পানি দুইভাগ হয়ে মাঝখানে তৈরি হয় রাস্তা।

নবী তরতর করে হেঁটে ওপারে পৌঁছে যান। তাকে অনুসরণ করে ফেরাউনও সে পথে নামে। মাঝ পথে আসতেই নদী আবার আগের রূপে ফেরে। অত্যাচারী ফেরাউন সদল বল ডুবে মরে নীল নদের পানিতে। জয় হয় মুসা নবীর। সেই নীল নদের দেশ, ফেরাউনের দেশ, মিথ আর ইতিহাসের মিসরে এসে পড়েছি! অতীত আর বর্তমান অথবা কল্পনা এবং বাস্তবের মিশেল অভিভূত করে।
ওল্ডটেস্টামেন্টের কাহিনীও এই নীল নদ, মুসা নবী আর ফেরাউন অর্থাৎ ফারাওকে নিয়ে। শুরু অনেকটা আমাদের ভারতীয় সনাতন ধর্মের ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’র মতো। কেনান প্রদেশ থেকে প্রচুর হিব্রু ধরে এনে দাস বানিয়েছিল ফারাওরা। তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চলত। একদিন দৈববানী হয় ফারাওদের অত্যাচার রুখবে যে আজ তার জন্ম হবে হিব্রুদের ঘরে। সেখানে সেদিন যে শিশুটির জন্ম হয় ফারাও এর অভিযানের ভয়ে তার মা বড় পাত্র করে তাকে নীল নদে ভাসিয়ে দেয়।

ভাসতে ভাসতে শিশু যে ঘাটে ভেড়ে সেখানে সখীদের নিয়ে জলকেলি করছিলেন ফারাওয়ের নিঃসন্তান বোন। শিশুকে দেখে মমতায় বুকে তুলে নেন। রাজপ্রাসাদে সবার চোখের মণি হয়ে বাড়তে থাকে সে ফারাওয়ের বোনের ছেলে বা ভাগ্নে হিসেবে। এই শিশুই মোজেস বা মুসা। যৌবনে পৌঁছলে তার অনেকরকম গুণ প্রকাশ পেতে থাকে। সেসঙ্গে রূপও। এক সময় তিনি নিজের আসল পরিচয় জেনে যান। শুরু হয় ফারাওয়ের সঙ্গে বিরোধ। বিদ্রোহীদের নিয়ে তিনি ফিরে যান কেনান প্রদেশে।

সেখানে তুর পাহাড়ের চূড়ায় সদা প্রভু তাকে দশটি নির্দেশ দেন। যা ‘টেন কমান্ডমেন্ট’ নামে পরিচিত। এ কাহিনী নিয়ে হলিউডে অস্কার জয়ী একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, যে ফারাওয়ের সঙ্গে মুসার বিরোধ ছিল সেই ফারাওই দ্বিতীয় রামসিস যার টেম্পেল আমরা দেখতে যাচ্ছি। রাতের নীল নদের দিকে তাকিয়ে এসব কত কি মনে হয়! ধীর-শান্ত বয়ে চলেছে নীল। 
ইতিহাস বলে, সেই আদিকাল থেকেই নীল নদের প্রকৃতি শান্ত। ইরাকের দজলা ও ফোরাতের মতো উদ্দাম অস্থির নয়। দক্ষিণের আবিসিনিয়া অঞ্চলের পাহাড়ে নীল নদের উৎপত্তি। এরপর উত্তরে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার বয়ে গিয়ে মিশেছে ভূমধ্যসাগরে। নীল নদের প্রবাহ অনুুযায়ী মিসর উর্ধাংশ এবং নি¤œাংশ বা দক্ষিণ ও উত্তরে বিভক্ত।
কায়রো এবং আলেক্সান্দ্রিয়া ছাড়া সম্ভবত বাকি প্রায় পুরো অংশ  উর্ধাংশ বা দক্ষিণ মিসর। দক্ষিণের পাহাড়ে উৎপত্তি বলে এ অংশ মিসরের উর্ধাংশ হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ মিসর আফ্রিকার মরু অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণের শুরুতে ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামে ম্যাপ সামনে নিয়ে গাইড আবির আমাদের মিসরের ভূগোলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল প্রথমে।
উৎস থেকে উত্তরে বয়ে যেতে যেতে ভিন্ন ভিন্ন ছয় জায়গায় ছ’টি প্রপাত সৃষ্টি করেছে নীল। প্রথম প্রপাত সৃষ্টি হয়েছে এ্যালিফেন্টাইন নামে এক জায়গায়। এর উত্তরে সাহারা মরুভূমি। সাহারার পূব দিকের উপত্যকার নাম মিসর। মিসর শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করলে আবির বলেছিল ‘রক্ষাকর্তা’।  প্রফেটস সান। যে রক্ষা করে। আর প্রাচীন মিসরের ‘আসিরিস মিথ’-এ মিসরকে ‘ভূমি’ কল্পনা করা হয়েছে। সূর্যদেব ‘রে’ কন্যা মিসরকে বিয়ে দিয়েছিলেন পুত্র ফারাওয়ের সঙ্গে। মিসর বা ভূমিকে সব ধরনের সংকট ও ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষার দায়িত্ব ফারাওয়ের। 
একই দেশের দুই অংশ হলেও উত্তর ও দক্ষিণের মানুষের মধ্যে চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। মূলত দুই অংশেই বিদেশী অনুপ্রবেশের জন্য। আফ্রিকার মরু অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ অংশের সংযোগ থাকায় সুদানের ব্যবসায়ীরা নদী পথে মিসরীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেন করত। দক্ষিণ মিসরের এ এলাকা সুদানের সঙ্গে বাণিজ্যের জলপথ হয়ে উঠেছিল। উত্তর মিসরে সেমেটিক অনুপ্রবেশ ঘটেছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে।

ভূমধ্যসাগর ও এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত উত্তরে অনুপ্রবেশকারীরা এসেছে বদ্বীপের দুদিক থেকে। পূবদিক থেকে সেমেটিক, পশ্চিম দিক থেকে লিবিয়ানরা। প্রাচীন মিসরের ভাষায়ও সেমেটিক প্রভাব ছিল। এই বিদেশী অনুপ্রবেশের জন্য সম্ভবত উত্তর ও দক্ষিণ মিসর পরস্পরের সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠ ছিল তার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল বাইরের অধিবাসীদের সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে বৈষম্য ও রেষারেষিই প্রকট ছিল। 
মিসরের সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত বিবরণ পাওয়া গেছে খ্রিস্ট জন্মের তিন হাজার চারশ’ বছর আগের। ইতিহাসের শুরু ধরা হয় সেখান থেকে। ইতিহাসের কালপর্ব মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ হয়েছেÑ প্রাচীন রাজ্য, সামন্ত যুগ এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের যুগ।  
‘কেমব্রিজ এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি’ (ঈধসনৎরফমব অহপরবহঃ ঐরংঃড়ৎু) কে ভিত্তি করে জেমস হেনরি ব্রেস্টেড, হলো প্রমুখ ইতিহাসবিদ এ কালবিভাজন করেছেন। প্রখ্যাত প্রতœতাত্ত্বিক ফ্লিল্ডার্স পেট্রি অবশ্য মিসরীয়দের গ্রহ নক্ষত্রের আবর্তনের হিসেবে বর্ষ গণনার উল্লেখ করে খ্রিস্ট জন্মের পাঁচহাজার পাঁচশ’ ছেচল্লিশ বছর আগে থেকে শুরু করে মিসরের ইতিহাসের কালপঞ্জী রচনা করেছেন।

কিন্তু বেশিরভাগ ঐতিহাসিক  ব্রেস্টেড এবং হলোর কেমব্রিজ এনসিয়েন্ট হিস্ট্রিভিত্তিক কাল গণনাকে সমর্থন করেন এবং অধিকতর নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ মনে করেন। এখানকার ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সব যুগের শাসকরা নিজেদের কীর্তি অমর করার জন্য বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন রেখে গেছেন। প্রাচীন রাজ্যের নিদর্শন পিরামিড। তার পরের সামন্ত যুগের নিদর্শন পাহাড় কাটা সমাধি-মন্দির। আর সাম্রাজ্য যুগের নিদর্শন বিশাল মন্দির ও পাথরের মূর্তি। 
প্রাচীন মিসর নিয়ে গবেষণা করার জন্য ‘মিসর তত্ত্ব’ বা ইজিপ্টোলজি নামে পড়ালেখার একটি আলাদা বিষয় (ঝঁনলবপঃ) ই চালু আছে। এসব ভাবতে ভাবতে আর আহরিত বিদ্যা ঝালিয়ে নিতে নিতে ঘুমে জাগরণে কেটে যায় রহস্যময় মমির দেশের প্রথম রাত।
পরদিন ব্রেকফাস্ট শেষে বেরিয়ে দেখি গাইড আবির হাম্মাদ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার গত রাতের সেই য়াহমেদ। মিসরে মোহাম্মেদ আর য়াহমেদ নাম দুটো খুব কমন। কায়রো এয়ারপোর্টে প্রথমে যে আমাদের  অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তার নাম মোহাম্মেদ। হোটেলে নিয়ে যেতে এসেছিল যে তার নামও মোহাম্মেদ। তার ড্রাইভারের নাম ছিল য়াহমেদ। এখনকার গাইড য়াহমেদ, ড্রাইভারদের একজনের নামও য়াহমেদ।

য়াহমেদ আর মোহাম্মেদের চক্কর! হোটেল লবি, রাস্তা, মার্কেট সবখানে এ নাম দুটোই বেশি কানে বেজেছে। শব্দ দুটো আমাদের বেশি পরিচিত, সে জন্যও হতে পারে। আমাদের দেশেও বেশিভারগ মানুষের নামের আগে পরে মোহাম্মদ, আহমেদ থাকে। ওরা হয়তো নামের প্রথম অংশ অথবা শেষাংশ ধরে ডাকে। তাই য়াহমেদ মোহাম্মেদের এতো ছড়াছড়ি। আবিরের সঙ্গে মিউজিয়াম পিরামিড প্যাপিরাস হোসেনিয়া মসজিদ ইত্যাদি দেখে রাতে রওনা আসোয়ানের উদ্দেশ্যে। এখন আছি এই নতুন গাইড য়াহমেদের তত্ত্বাবধানে। রিলে রেসের মতো।

×