ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

তৃণলতা সেন

নিমাই সরকার

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ১৮ জুলাই ২০২৪

তৃণলতা সেন

তৃণলতা সেন

কী খুঁজছো তুমি মা?
নারী এদিক ওদিক তাকায়। অতঃপর একটি চেয়ারের ওপর হাত ভর করে থামে। 
কখন থেকে সে হাঁটছে হাঁটছে আর হাঁটছে। এ হাঁটার যেন শেষ নেই। কঠিন এক ঝামেলায় পড়েছে নারী। এই অবস্থায় কেউ দাঁড়াবে না তার পাশে। তৃণলতা জানে ওকেই ওর সমস্যার সমাধান করতে হবে। 
মুখে রাজ্যির ক্লান্তি। কিছুটা আড়ষ্টতা তার মুখে। আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সে সরব হয়। 
না কিছু খুঁজছি না। আমি আমার প্রাপ্য চাই। ক্যান্সার আমার মধ্যে বাসা বেঁধেছে।
হাসপাতাল দাবি করে, আমি মৃত। হ্যাঁ, আমি এ যাত্রায় ওদের কথা মেনে নিয়েছি। তবে গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। 
এতক্ষণে এক নাগাড়ে কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলেন বিচারক ইন্দ্রজিৎ। এবার গোল শব্দটিতে বিশেষ মনোযোগ আসে তাঁর। 
আমি জানিয়েছি, তরুণী বলে, আমি নারী তাতে কি! নারীকে আলাদা করা রীতিমতো অপমানজনক। এবার বুঝি শক্ত নিরেট হয়ে ওঠে তরুণী। স্পষ্ট করেই বলেছি, আমার মৃতদেহ সমাহিত করা যাবে না। তুমি কী বলবে হে ধর্মপুত্র! ইন্দ্রজিৎ নারীর চোখের তেজেই মাপতে থাকেন এ কথার অর্থ। 
ঘাস জুতা পায়ে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে কালো শাড়ি। কপালে টিপ। শাঁখা পরা হাতে গাড়িটি ঠেলে নিয়ে তরুণী চলছে। এরই ফাঁকে তার এই আর্জি।
সার্জিক্যাল ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে তরুণীর। এই সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞান বাঁচাতে পারেনি তাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর তার কোনো অশ্রদ্ধা নেই। তার আপত্তি নারীকে ছোট করার প্রশ্নে। নারী-দেহ সংরক্ষণ করার আইন নাকি এই মুলুকে নেই। তরুণী শূন্যে তার ডান হাত ছোড়ে। পৃথিবীর ওপর যত ক্ষোভ আর অভিমান নারীর। 
তৃণলতা সেদিন হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ায়। আরও ভেতরে বড় ঘরটায় হাসপাতাল পরিচালক বসা। ওখানে যেতেই ওই ঘরে বসা অন্য ডাক্তারেরা তাদের বসার চেয়ার বদলায়। পথের বিলি কেটে সে হাসপাতাল পরিচালকের কাছে পৌঁছায়। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। ফাইল বের করে পরিচালক অন্য জায়গা থেকে শুরু করেন। বিবরণীতে লেখা, ওষুধে প্রতারণা। পড়তে থাকেন, ঘটনাটা ঘটেছে হাসপাতালে আসার আগেই।
তরুণী সম্পর্কে কালই বলা হয়েছে, অবস্থা ভালো নয়। ধীরলয়ে যেন লেখাগুলো অস্পষ্ট তাই কষ্ট করে পড়ে যান পরিচালক। ডাক্তাররা স্কুলের একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো কথাগুলো শুনছেন। পরিচালক বলেন, তাহলে ওষুধ প্রতারণার ব্যাপারটিতো আর হাসপাতালের ওপর বর্তায় না!
এখনকার উদ্বেগ নারীর শরীরের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে। রোগীর কি হলো, সেটা বলুন। চরম অস্বস্তি ফুটে ওঠে তরুণীর মুখে, ডাক্তার! কিছুটা ধীর লয়ে পরিচালক বলেন, হাসপাতাল সবসময় তার সর্বোচ্চ চেষ্টাটি করে যায়। নারীর ধৈর্য ধরে না। আবারো তার মুখে একই শব্দ উচ্চারিত হয়, ডাক্তার! 
 নিঝুম অতীতে চলে যায় তরুণী। ভাবে, একদা সে স্কুল থেকে ইনজেকশন নিয়েছিল। সে নয় শুধু, তার অনেক ছাত্রীও। নগরের একটি ভ্রাম্যমাণ সংস্থা থেকে এই আয়োজনটি করা হয়েছিল। তারা ভ্যাকসিনের নাম করে টাকা নিয়েছে। এদের অনেকেই ভুগছে এখন ওদের দেওয়া মিথ্যে ওষুধের কুফলে। ভেজাল সব জায়গায় ভেজাল! তারপর পরিচালকের দিকে মুখটি এনে বলে, আমার দেহের অবস্থা কি সেটা বলুন!
আমরা সেটা নিয়েই বসেছি। পরিচালক কী যেন বলতে চেয়েও বললেন না! এমন অবস্থায় নারী বলে, কী হতে যাচ্ছে ডাক্তার! 
শবটা ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়েছে। যেন কিছুই হয়নি, আঠারো মাসে বছর এমনিভাবে বলে যান পরিচালক।
না ডাক্তার, সেটা হতে পারে না, কোনোভাবেই নয়। নারীর চিৎকারে ঘরের সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। এবার তড়িঘড়ি করে পরিচালক বলে যান, মৃতদেহ হাসপাতালে রাখা যায় না। অতিরিক্ত সময়ে ভাড়া বেড়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি পারো সেটা নিয়ে যাও! পরিচালক অন্যদিকে মুখ ঘোরান।
চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। গ্রামের প্রতিষ্ঠান। একদিকে নতুন শিক্ষাক্রম অন্যদিকে আলাদা পদ্ধতি। অভাব সাজ সরঞ্জামের, স্বল্পতা শিক্ষকের। কী হবে ওই শিক্ষার্থীদের? কিভাবে এগোবে স্কুল? নারী পরিষ্কার হয়ে যায়, তাকে চির বিদায়ের সনদ দেওয়া হচ্ছে, চির বিদায়।
কী আর করবে তরুণী! কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলার আগেই পরিচালক তাঁর বাজখাই মেজাজ ধরে রাখতে পারেন না, ঠাস ঠাস কণ্ঠ তাঁর। অযথা জটলা পাকাচ্ছ কেন! তুমি কি হাসপাতাল, চিকিৎসা বিজ্ঞান মানো নাকি এর সবকিছুতে গায়ের জোর খাটাতে চাও! 
নারীর মুখে তথোদিক প্রকম্পন। তা হলো কি করে? তরুণী সুনির্দিষ্ট করে বলে, তোমরা হাসপাতালের কার্য বিবরণী না দিয়ে বাইরের ওষুধের বিষয়টি সামনে এনেছো। নারী গলায় ঢোক গেলে।
তোমাদের এখান থেকে তোমরা কি আমার এই দেহকে মৃত ঘোষণা করছো? 
তা করতে পারো তবে মৃতদেহ সমাহিত করতে পারবে না। না। আস্তে অথচ কঠিন মুখে বলে যায় তরুণী। এখানেই সংরক্ষিত থাকবে এই সব। 
এসবের তোয়াক্কা না করে পরিচালকের নির্দেশে সনদ প্রস্তুত হয়ে আসে। সংখ্যার পাশাপাশি টাকার অঙ্ক লেখা তাতে। একি? এতো কেন? আবারো নারীর চিৎকার। তোমরা কি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিচ্ছো? নিজেকে কিছুটা বাগে নিয়ে প্রায় তখনই বলে, দাও... এ দিন যে তোমাদের। 
নারী, তুমি বুঝতে পারছো না এটা হাসপাতাল।
তরুণী রাগ করে মৃত দেহের বাক্সটি ধরে সামনে ঠেলা দেয়। বলে, আচ্ছা দেখা যাক। 
একদা সে ছিল শান্ত। সেই মেয়েটিই এখন চটপটে তেজোদীপ্ত। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে থাকতে হয় সদা তৎপর। সে এখন যুদ্ধ জারি রাখে। এরই মধ্যে তার কাছে জিজ্ঞাসা মৃত দেহের। এখন কী হবে! মৃত্যুই কি সই নাকি অন্যকিছু ভাববার আছে! তরুণীর সাফ কথা। তার দেহকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণ করতে হবে। তাতে আগামীর পৃথিবী হয়তো তার প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটুকু করতে পারবে।
পরিচালক এতক্ষণ কিছুটা চুপ ছিলেন। এটা কি তাঁর পরাজয়? কিন্তু এই আপাত হার সহ্য করতে পাওে না হাসপাতালের অন্যরা।
একজন একটু এগিয়ে বলে, মরলে স্বর্গে যাওয়া যায় কিন্তু হাসপাতাল তো স্বর্গ নয়। এখানে সেবার মূল্য দিতে হয়।
সেবা? সেবার মূল্য কি এতো? পুনর্বার টাকার অঙ্কটির ওপর দিয়ে চোখ বুলায় তরুণী।
হাসপাতাল কর্মী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সেটা থামিয়ে পরিচালক বলেন, সবাই ব্যবসা করে। শিক্ষা অফিসের আধিকারিকরা মুদ্রা ছাড়া ফাইল চালায় না। এবার কর্মী বলে, তাহলে হাসপাতাল সে সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন?
হাসপাতাল, সেখানকার সেবার মূল্য বুঝি এতো? নারী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। 
এখানে তো আর বিনা পয়সায় কেউ চিকিৎসা করবে না, পাশের অন্য জন বলে।
কথা সত্যি। তরুণী বলতে ছাড়েনি। রোগী বাঁচলে বাহবা, মরলে কাড়ি কাড়ি টাকা। 
পরিচালকের রাগের মাত্রাটি তখনো কমে না। তিনি সনদটি সামনে ঠেলে দেন।
তারপর নারীর আপাদমস্তক দেখে নেন। তুমি না মৃত। এত কথা বলছো যে ...! পরিবেশ থ খেয়ে যায়। 
নারীর প্রতি অবমাননা সমাজের ভাঁজে ভাঁজে। শরীর দুর্বল, চর্মরোগ বাসা বেঁধেছে। মুখে স্বাদ নেই। ওষুধ প্রতারণার শিকার হয়ে সে তখন বিপর্যস্ত।
একজন স্কুল টিচারের জন্য এমন অবস্থা স্বাভাবিক বুঝি! তৃণলতার গা কাঁপে।
একটা কথা, তোমরা কি হাসপাতালকে স্বর্গের চেয়ে অধিকতর ভালো বলে ঘোষণা করতে চাচ্ছ? তরুণী হাসে, সাইন বোর্ডের উদ্দেশে তর্জনী উঠিয়ে সে বলে, ওখানে কি লেখা আছে তা?
নারী! 
তরুণী বলে, স্বাধীন মুলুকে রাজা রানীকে নিয়েও বিদ্রƒপ করা যায়। কিন্তু তোমরা সেখানে মহাশক্তিমান। হাসপাতাল নিয়ে কিছু বললে খড়গ নেমে আসে। 
হাসপাতাল পরিচালক অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। কী অবাক করা কা-! ন্যূনতম শিষ্টাচার নেই। বলতে বলতে মধ্য বয়সের এই তরুণ দাঁড়িয়ে পড়েন। অন্য হাতে ডান হাতের জামার দস্তানা ওপরে উঠতে থাকে। কাচের গ্লাসে এসব দেখছেন অন্যরা। তবুও তরুণী দমে না। তার মুখের শিরাগুলোর নীল দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 
তাহলে ওই শিল্পকর্মের গল্প বলি। এখানকার অনেকেই হয়তো সেটা জানবে। একটু দম নেয় সে। যেন কিছুই হয়নি এমনি তার মতো করে শুরু করে তরুণী। মধ্য এক আমলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সামনে টেবিল। সেখানে নগ্ন নারীর দেহের ওপর ছড়িয়ে রাখা ক্ষীরসা পাটিসাপটা। টেবিল ঘিরে বসে থাকা একদল পুরুষ খাচ্ছে তা। ওই নারী নামী এক নাট্যাভিনেত্রী। ওই অফিসেই চাকরি করেন, তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন ওই আমলা। 
অন্যদিকে টেবিলের ডানদিকে নিচে দেখা যায় আমলার স্ত্রী চন্দ্রমুখীকে। তিনিও এক বিচারকর্তা। রাজাকারের প্রতীক স্বস্তিকা ঘষে ঘষে তুলছেন। তাঁর বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাজাকার আর আল শামস সম্পৃক্ততার। চন্দ্রমুখী স্বীকার করতে চাননি। পরে তদন্তের আদেশ দেন তিনি নিজেই। অভিযোগও প্রমাণিত হয়। সেটা মূল কথা নয়। শিল্পকর্মে অতীত লুকানোর চেষ্টার উপস্থাপন মোটেই পছন্দ হয়নি চন্দ্রমুখীর।
নারী! পরিচালক দ্বিতীয়বার জ্বলে ওঠেন।
তরুণী অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেয়ালের দিকে। সবাই আশ্চর্য হন। এই চিত্রেরই তাহলে এই ব্যাখ্যা!
তরুণী কপালের টিপটি ভালো করে বসায়। একইসঙ্গে চশমাটা ঠিক করে নেয়। এবার পরিচালকের চোখ পড়ে ওইদিকে।
আচ্ছা, সত্যি করে বলোতো তুমি কি জীবিত নাকি... শেষ হয় না কথা। 
শক্ত করে টিপ পরছি তাই? তৃণলতার চোখে জল আসে। নারীর কপালে টিপটাও সহ্য হয় না ওদের। কী এক অবস্থা! টিপ পরব কি পরব না তাতো ওদের দেখার কথা নয়। তরুণীর অভিযোগ গোটা পুরুষ জাতির বোধের বিরুদ্ধে। তাদের বিশ্বাস এবং ভুল চর্চা সহ্য করে না তরুণী।
টিপ যে বাঙালি নারীর সাজের অংশ। এটা তো অনুক্রমে এসেছে। এই টিপ আমার মা পরেছে, আমি পরেছি, আমার কন্যাও পরবে। চেয়ারে এক পুলিশকে দেখে নারী। টিপ পরা নিয়ে কথা উঠেছিল একবার।
হ্যাঁ নারী কপালে টিপ পরে। যখন মন বলেছে পরেছে। কিন্তু বাড়িতে, পাড়ায়, শহরে, অফিসে, বন্ধু মহলে, একটাই কথা! মেয়েটা সবদিক থেকে ভালো, তবে টিপটা না পরলেই হয় ! বাসে বসে আছে, পাশের সিটের মহিলা অচেনা, বললেন, টিপ পরেছো? তয় লাল কেন, একটা কালো ছোট টিপ পরতা!
মুখ্য শিক্ষক ডেকে বললেন, তৃণলতা এতো বড় টিপ পরেন, না নিষেধ করছি না, একটু ছোট পরলেই পারতেন। পরের দিন অবশ্য আরও বড় টিপ পরেছিল তরুণী। 
মেয়েটি বাঙালি সংস্কৃতির সব অনুষ্ঠান করে। সব জায়গায় দেখা যায়, তো তাতে কি? রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে তরুণী। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ওর ঘরে অনুষ্ঠান হয়। আগেও হয়েছে। ওর ঠিকানা জানতে চাইলে প্রতিবেশীরা বলে ঐ যে হিন্দু মেয়েটি? এমন কথায় তার আপত্তি আছে। তাইতো ওসব কথায় ওর মন ছোঁবে না, ও যে বাঙালি।
পরিচালক, পুলিশ সবাই সরব হন।
দেয়ালে সাঁটা ছবি। তরুণী আঙুল দিয়ে দেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থীর মুখ। তারা প্রথম ব্যাচে পড়াশোনা করেছেন। বিখ্যাত দিনের কথা মনে করিয়ে নারীর তর্জনীটি ওখানেই স্থির করে। তাঁদের সবার কপালে টিপ। কয়েক মুহূর্ত হাতে নিয়ে তরুণী বলে, আর আজ বুঝি ভিন্ন কাল! পরিস্থিতি আলাদা!
এখানেই যদি পৌঁছুতে হবে তাহলে কিসের জন্য এত লড়াই? কার জন্য এত সংগ্রাম? 
কত কথা ওর বুকের মধ্যে!
দেশের কোন আইনে লেখা আছে টিপ পরা যাবে না!বিষয়টা অন্য দশ নারীকে ভাবায়। তৃণলতা চিন্তা করে তারও দশগুণ।
 তরুণী টিপ্ নিয়ে একবার উচ্চকণ্ঠে বলেছিলো, পারলে ঠ্যাকা। 
দাঁত কিড়মিড় করে পরিষ্কার উচ্চারণে সেদিন বলতে বাঁধেনি, হাত মুচড়ে দেব। স্বকণ্ঠে ঘোষণা দিচ্ছি এমন করে জানিয়েছিল, এটা আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। ওদের কি লজ্জা আছে তাতে? 
 কথা শেষ হয় না। এক পর্যায়ে চেয়ার থেকে উঠে পরে নারী। বলি ও মশায় কপালখানা আমার, টাকা আমার, টিপও আমার।
পরক্ষণেই বসে আঁচল কোলে নিয়ে বলে, আমার সংস্কৃতি আমার আপদ, আপনার জ্বলে ক্যান? এ্যাঁ, এ্যাঁ, সম্বিত ফিরে পায় তরুণী। 
এবার সনদটা দলা মোচা করে বাক্সে রেখে এক কাড়ি টাকা ফেলে তরুণী নিজের দেহ নিয়ে সামনে এগোয়। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের জুতা আগেই ছিঁড়ে গেছে। 
নারী, লাশটা তুমি এইভাবে টেনে বেড়াচ্ছো কেন? একটু শক্ত করে ধরো! 
এও তাঁর ওপর আরেক ধরনের অত্যাচার। (এরপর ১৩ পৃষ্ঠায়)
ঠেলা গাড়িটা এদিক ওদিক যাচ্ছিলো। ঠিক করতে পারছিলো না, কোন দিকে যাবে!                        
যা বলছি তাই করো! 
কী বলছে বাবু, বুঝতে পারে না।
কয় যুগ এই শব ধরে ধরে বেড়াচ্ছে এই দেহ তার!
তৃণলতা সে সময় শাশুড়ির সঙ্গে কাজ করতো। সন্তান জন্মের পাঁচ মাস পর ভূস্বামী তাকে ডেকে পাঠাল। অঞ্চলে জমিদাররা শূদ্র সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিল। ওরা বিশাল বাড়ি আর অনেক জমির মালিক। এখানে তারা কাজ করতো। 
জমিদারের বিশ বছর বয়সী স্ত্রীও কয়েক সপ্তাহ আগে সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু শিশুটি পর্যাপ্ত পরিমাণে মায়ের বুকের দুধ পেত না। এ কারণে সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য তৃণলতাকে ডেকে নিয়ে আসা হয়। এভাবে ভূস্বামীর সন্তানকে বেশি দুধ খাওয়ানোর জন্য তার নিজের সন্তান ক্ষুধার্ত থাকত।
তারা এ জন্য উচ্চবাচ্য করতে পারতো না। না বলার সুযোগই ছিলো না। তেমনটি হলে ওদের ওপর এমনকি যৌন নির্যাতনও চলে আসতো। যার সাক্ষাৎ ভুক্তভোগী তৃণলতা নিজে। 
ভূস্বামীরা এই তাদের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে ভাবে। তার শরীরে যা কিছু আছে তার মালিক তারা। এমনকি সন্তানের জন্য রাখা বুকের দুধও ওদেরটা বলে ভাবে ওরা।
প্রতিবাদ হয়েছে। তবে তার ফলটা ভালো নয়। তৃণলতার শরীরই তার সাক্ষর। সেই চিহ্ন নিয়ে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে তরুণী। সেতো আসলেই মৃত।
আমরা দলিত। আমরা অস্পৃশ্য। কিন্তু আমাদের বুকের দুধ গ্রহণ করতে দ্বিধা নেই। এ সময় জমিদাররা বিরক্ত হয় না। এতে তাদের ইজ্জত যায় না। কিংবা আমাদের নারিত্ব নিতেও তাদের বাঁধে না।
এই যে আমার সম্প্রদায়ে প্রসবের সময়ে কোনো মায়ের মৃত্যু হলে আমরা স্বেচ্ছায় বুকের দুধ খাওয়াই। এটা আমার দায়িত্ব-স্নেহবোধ। কিন্তু এরা তো জোর চালায়। এটা গোলামগিরি। তরুণীর সহ্য হয় না। দাঁতে দাঁত চেপে সে কেবল মেনে নেয়। 
জমিদার সন্তানকে খাওয়াতে যাওয়ার আগে নিজের সন্তানকে খাওয়ানো নিষেধ ছিল। না হলে নির্যাতন। চটপট বেতের বাড়ির শব্দ পায় নারী। আঃ আঃ করে আর্তনাদ করে। ওরা চায় না নারী নিজের বুকের দুধ অস্পৃশ্য শিশুকে খাওয়াক। ওদের শিশু নাকি অস্পৃশ্য! তরুণী শাড়ির আঁচলটি ওপরে টেনে নেয়।
নিজের সন্তানকে ক্ষুধার্থ রাখা কি কষ্টের নয়? কিন্তু উপায় ছিল না। এ বাবদ এক বস্তা শস্য দিত। যখন তাদের বাড়িতে পৌঁছাত তখন এক টুকরো সাবান দেওয়া হতো। গোয়ালঘরের কাছ থেকে গোসল করে যেত সে। এমন আচরণ কোনো মানুষ মানুষের সঙ্গে করে না। 
এদের সঙ্গে এমন আচরণ করাকে ভূস্বামীরা জন্মগত অধিকারের চেয়ে কম মনে করেনি। শুদ্ধ আর পবিত্র ওদের নারী। আর ওদের অধিকারের পণ্য আমরা। উচ্চ বর্ণের নারীদের দ্বারাও আমরা দলিত। তাই না তবে কী? অথচ তারাও নারী তারাও মা হয়েছেন। এই আমরা আয় করি পরিবারে সহযোগিতা করবো বলে। কিন্তু তাও করতে পারিনি। স্বামীর দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমার সন্তান বাড়িতে ক্ষিধেয় কাঁদতো। অন্যদিকে দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম ঘরে। 
আঁচলে মুখ মুছে নারী। 
সবার ধারণা ছিল আমাদের নারীদের বুকের দুধ পুষ্টিকর। উচ্চবর্ণের মানুষ আমাদের অপবিত্র এবং নোংরা বলে অপমান করেছে। কিন্তু তারা আমাদের বুকের দুধ তাদের সন্তানের জন্য চেয়েছে। তারা বলেছে তাদের শ্বাস নেওয়া বাতাস আমরা দূষিত করছি। অথচ তারা আমাদের শরীর তাদের শিশুদের সংস্পর্শে আসুক তা চেয়েছে। কী বৈপরীত্য! ধিক ধিক!
কী করুণ দৃশ্য! এই আমরা গোয়াল ঘরে কাজ করতাম। তবে ওদের ঘরের সবকিছুই আমরা জানি। অবশ্য কখনো অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে চাইনি। তারও কারণ আছে। ওদের যৌনতার প্রশ্রয় কেন আমরা দেব? ওরা জানে না এই আমরাও ঈশ্বরের সন্তান। 
আর ওরাইবা সে মর্যাদা দেবে কেন? তরুণী নিজের হাতের শাঁখা আঙ্গুল বরাবর বাইরের দিকে টানে। 
আমাদের ওপর প্রকৃতি নাখোশ, স্বয়ং ঈশ্বরও। আমরা যে ওদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। এর ফল ও সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছি, কাজ হারিয়েছি। অন্য কোনো ভূস্বামীও এই অবস্থায় কাজ দেয়নি। আমাদের আর মূল্য কি? আমরাতো মড়া। 
আমরা বুকের দুধ দেওয়া থেকে শুরু করে অন্য কাজগুলো করেছি। তবে শুধু যে জিম্মি হয়ে তাও নয়। ভালোবাসা থেকেও করেছি। কিন্তু ওরা ভালোবাসার মূল্য দেয়নি। আর এ অভিযোগ শুধু নিজের জন্যই তুলবো কেন? উচ্চ বর্ণের ওই পরিবারগুলোর নারীরাও এই রোগে ভুগেছে। দেয়ালে কান পাতলে এখনো ওদের নারীর কান্না শোনা যায়। নারী ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। 
তার বিরাম নেই। তরুণীর চোখ দুটো বিস্ফারিত। প্রায় কাছ থেকেই কে যেন বলে উঠলো তাকে। কেমন চলছে তোমার তৃণলতা সেন! লম্বা টান তার কণ্ঠে। 
কে গো তুমি, বনলতা সেন বলে আমার কুশল জানতে চাচ্ছ? তরুণী অন্য নামের সঙ্গে নিজেরটিও গুলিয়ে ফেলে। তাইতো তৃণলতা বললেও তার কানে বাজে বনলতা। 
তৃণলতা চলে অবিরাম। নিযুত বছর ধরে সে চলছে পথ। ঘুরে ঘুরে আবার এসেছে এখানে সে। বলে, এই একরকম আছি। ক্যান্সারে ওরাতো মেরেই ফেললো। তরুণী উত্তরটি দেয় তারও চেয়ে লম্বা স্বরে। কিন্তু আমারতো মড়ার ইচ্ছে ছিল না। বাধ্য হয়েই মরতে হচ্ছে।
তাহলে তুমি কি বাঁচতে চাওনা মা? মায়া ভরা চোখ নিয়ে এবারও নারীকে মা বলে ডাকলেন ইন্দ্রজিৎ।
আমাকে জীবিত রাখার সাধ্য ওদের নেই। কারোর নেই। সে সুযোগ ওরা নষ্ট করে দিয়েছে। যেখানে ওষুধে ভেজাল মেশানো হয় কিংবা ওষুধের নামে চলে মিথ্যার ব্যবসা সেখানে টিকে থাকা যায় না। 
কিছুটা উদাসীনতা তার চোখে মুখে। তরুণী দীর্ঘ শ্বাস নেয়। বলে, হাসপাতালও প্রকৃত অর্থেই স্বর্গ হওয়ার কথা ছিলো, হলো না। তাহলে বলতেই হয়, অন্তত চলতি সময়ে বেঁচে থাকা নিরর্থক। সুস্থ সবল এই তরুণী। তার আছে সাহস, আছে শক্তি। আছে জয় করবার একটি মুখ। বিচারক এইভাবেই বোঝেন। তুমি তৃণলতা। তুমি আছো সবার মাঝে। তুমি আছো বিটপী লতায়। একদমে অনেকখানি বলে যান ইন্দ্রজিৎ।
না তোমাকে মরতে দেওয়া যাবেনা। ডাক্তার ডাকবো। মা আমার, এই পৃথিবী তোমাকে চায়। বিচারক সহযোগিতা চেয়ে ঘন্টা বাজান।
আমি মরতে চাই না। যদিও আমি জানি যে, আমি মরতে চলেছি। আর শোন বিচারক, শোনো হে পৃথিবীর সন্তান, তুমি যা চাইবে, তা হবে না। বরং আমার অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে। আমার মা-ই কেবল আমার মৃত দেহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
একটু ধৈর্য ধরো! দেখো বিবেচনা করে কোনটা তোমার জন্য ঠিক! বিচারক অনুরোধ করে কথাগুলো যেন দেয়াল ফুঁড়ে আসছিলো।
আমার মৃতদেহ সমাহিত করতে পারবে না। নারীর চোখে এবারও জল আসে, সে জলে আগুন জ্বলে। এ সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাকে বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু একশ বছর পরের বিজ্ঞান পারবে কিনা, তাতো বলা যায় না। বিজ্ঞানের কথা ভাবায় বিচারককে। ইতোমধ্যে তৃণলতার মা বাবা চলে এসেছেন বিচারালয়ে।
মা চোখের জল মোছেন। বাবা ভাবেন কন্যার ইচ্ছা এবং কল্যাণের কথা। 
এমন অবস্থায় বিচারক আর কীইবা করতে পারেন?

নিমাই সরকার : প্রবাসী, প্রকৌশলী, কথা সাহিত্যিক

×