ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

একের ভেতরে তিন

মনোজিৎকুমার দাস

প্রকাশিত: ০১:১৪, ১২ জুলাই ২০২৪

একের ভেতরে তিন

অ্যাভিনিউ পার হয়ে

বাবলী হকের লেখা ‘অ্যাভিনিউ পার হয়ে’ বইটি পড়ে খুব ভালো লাগল। লেখাগুলোতে মুন্সিয়ানার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি পূর্বে দুটো উপন্যাস লিখেছেন। অ্যাভিনিউ পার হয়ে তৃতীয় গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে ছোটগল্প, রম্যগদ্য ও ভ্রমণকথা সন্নিবেশিত হয়েছে। তিনটি বিভাগে ১৪টি রচনা অন্তর্ভুক্ত। সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিভাগের মেলবন্ধনে গ্রন্থটি বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। 
প্রথমে ছোটগল্পগুলোর উপর আলোকপাত করতে চাই। গ্রন্থে সুপ্রাণু হরণ, আঁধারে একা, নিঃশব্দ কড়া নাড়ে, এমএলপিনাক-৬, কোয়ারেটিন- গল্পগুলোতে প্রেম ভালবাসা, দ্রোহ, নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র অঙ্কন করেছেন। বর্তমানকাল পর্বে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে একাকিত্ব, নৈরাশ্য, হতাশা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির চিত্র গল্পকার বাস্তবতার আঙ্গিকে গল্পের আকারে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘সুপ্রাণু হরণ’। ভবিষ্যৎ নেই জেনেও সুপ্রাণু অসম লড়াইয়ে নামে। লক্ষ্মীবালা তার স্বামীকে বাঁচাতে ও অনাগত সন্তানের সুরক্ষার জন্য সহোদরকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। টিকে থাকার খাতিরেই লক্ষ্মীবালা এটা করে।
এই গল্পে বাবলী হক লক্ষ্মীবালার ভাই প্রভাংশু, স্বামী সুপ্রাণুর অস্তিত্বের লড়াইয়ের গল্প শুনিয়েছেন। পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে এই আশায় শান্তিবাহিনীর সুপ্রাণুরা অস্ত্র জমা দিয়েছিল। ঘর-সংসার করার জন্য সুপ্রাণু ভালোবেসেই লক্ষ্মীবালাকে বিয়ে করে। কিন্তু লক্ষ্মীবালার দাদা প্রভাংশু চাকমা অস্ত্র জমা দেয় না। সেনাবাহিনীর সঙ্গে শান্তিবাহিনীর একাংশ গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। শান্তিবাহিনী গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে দ্বিধা বিভক্ত।

লক্ষ্মীবালার পেটে সন্তান, তখন সেনাবাহিনী সুপ্রাণুকে ধরে নিয়ে যায়। লক্ষ্মীবালা স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য আকুল হয়। স্বামী ফিরে আসবে এমন আশাতেই প্রহর গোনে। লেখক গল্পটিকে গভীর দরদ দিয়ে অপূর্ব ভাষায় বর্ণনা করেছেন, চরিত্র চিত্রায়ণে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
দ্বিতীয় গল্প ‘আঁধারে একা’। লেখক বাস্তব ও জাদুবাস্তবের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তার গল্প বলার ধরন অসাধারণ। কোভিড-১৯ করার গ্রাসে মানুষের জীবন প্রায় থেমে গেলেও প্রকৃতি কিন্তু সমানতালে এগিয়ে চলছিল। বৃক্ষলতা, নদ-নদী থেমে কিন্তু ছিল না। এই চরম আঁধারের মাঝেও প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা এগিয়েই চলেছিল। পাশাপাশি বাস করা দুটো বাড়িতে কিন্তু চরম দুর্যোগের মাঝেও দুটো প্রাণের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। লেখক তানভীর ও টিয়ার অব্যক্ত প্রেমের কথা তুলে ধরেছেন অসাধারণ ব্যঞ্জনায়। 
‘নিঃশব্দ কড়া নাড়ে’ নস্টালজিক প্রেমের গল্প। ইমন একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে ভালোবাসত রুহি নামের তরুণীকে। দুজনের ভালোবাসার সূত্রপাত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকে। মুক্তিযুদ্ধ তাদের প্রেমকে পরিণতি দিতে পারে না। স্বাধীনতার ২৫ বছর পরে তাদের দেখা হয়। ইমনকে পেয়ে রুহি তার জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মাঝে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
বাবলী হক গল্পগুলোতে সরাসরি গল্প তুলে ধরেননি, এটা তার বিশেষত্ব। তার লেখা গল্প পড়ে পাঠককে ভাবতে হবে। সমসাময়িক বিষয়ের উপর লেখা। 
এই গ্রন্থের রম্যগদ্য হলো- সলিটারি থেকে মিলিটারি, ঘড়ির কাঁটা লম্বা হাত, কল অন এ হাতে খড়ি, ভাবি ক্লাবের সমুচা, সর্পরাজ্যের দাম্পত্য, শীতকালের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। 
বাবলী হকের এই গ্রন্থের শেষ অংশে ভ্রমণকথা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভ্রমণকাহিনীগুলো হলো- নেপালের জনপদে কয়েকদিন, ফুকেট থেকে ফি ফি আইল্যান্ড, কানাডার ডায়েরি : মহামারির বিড়ম্বনা, জয়পুর : একদিন এক রাত। লেখক এই জায়গাগুলো ভ্রমণ করে শুধু যা দেখেছেন তা বলেই শেষ করেননি। ওই সমস্ত স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। পাঠক ভ্রমণকাহিনীগুলো পড়ে ওই সমস্ত স্থানে যেতে উদ্বুদ্ধ হবে।
বাবলী হক ছোটগল্প পড়ে উপলব্ধি করা যায় তিনি ভবিষ্যতে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখবেন। আশা করি, এরপর তিনি গ্রন্থগুলোকে আলাদাভাবে প্রকাশ করবেন। একই গ্রন্থ তিনটি বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করায় গ্রন্থের মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করি।

×