ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

সালমান রুশদির সর্বশেষ উপন্যাস ‘ভিক্টোরি সিটি’

ঈমাম হোসাইন

প্রকাশিত: ০১:১২, ১২ জুলাই ২০২৪

সালমান রুশদির সর্বশেষ উপন্যাস ‘ভিক্টোরি সিটি’

সালমান রুশদি

ভিক্টোরি সিটি বিশ্বনন্দিত লেখক সালমান রুশদির সর্বশেষ সাহিত্যকর্ম। কথাসাহিত্যের একটি বাস্তব আর উর্বর মস্তিষ্কের চিন্তাপ্রসূত এক কীর্তি, যা পরিচয়, ক্ষমতা এবং ঐতিহ্য এবং শুভ পরিবর্তনের মধ্যে সংগ্রামের জটিলতাগুলোকে খুঁজে বের করে। দক্ষিণ ভারতের একটি ঋদ্ধ শহরের পটভূমিতে রচিত উপন্যাসটি বেশ কজন ব্যক্তির জীবনের প্রাণবন্ত এবং বিশদ সময়চিত্র উপস্থাপন করে। সূক্ষ্ম গদ্য এবং নিপুণ গল্প বলার অলৌকিক কৌশলের মাধ্যমে রুশদি উপন্যাসে একটি পরাবাস্তব এবং স্বপ্নের মতো পরিবেশ তৈরি করেছেন যা একই সঙ্গে লোভনীয় এবং ভয়ঙ্কর, অলৌকিক এবং দৈনন্দিনের সারমর্মকে একই সমগ্রের দুটি অংশ হিসেবে ধারণ করে।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পাম্পা কাম্পানা একজন অলৌকিক কর্মী, ভাবুক এবং কবি, যার দৃষ্টিশক্তির মর্মান্তিক গতি সে যা চায় তা করতে সক্ষম হয়েছে। এই অনুভূতি বইটির সারমর্মকে ধারণ করে। কারণ রুশদি মিথ, স্মৃতি, ইতিহাস এবং কল্পনাকে এক কামুক এবং সুরেলা কল্পভূমিতে বুনেছেন। তার চরিত্রগুলো জটিল এবং কৌতূহলপূর্ণ। প্রত্যেকেই একটি কল্পনাপ্রবণ বিশ্বে তাদের আপন জায়গা খুঁজে পেতে লড়াই করে।

তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে রুশদি সামাজিক শ্রেণিগুলোর মধ্যে শক্তির গতিশীলতা ও ভারসাম্য, সেই সঙ্গে নিপীড়িত এবং অধিকার বঞ্চিতদের সংগ্রামের অন্বেষণ করেন।
ভিক্টোরি সিটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো এর জাদুকরি বাস্তবতার ব্যবহার। রুশদি এই সাহিত্যিক উপকরণকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে একটি স্বপ্নময় এবং পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করেছেন যা মন্ত্রমুগ্ধ এবং আবার অস্থির, চঞ্চল উভয়ই। এই পদ্ধতিটি রুশদিকে উপন্যাসের থিমগুলোকে একটি অনন্য এবং সৃজনশীল উপায়ে অন্বেষণ করতে দেয়, পাঠকদের তাদের চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে তাদের নিজস্ব উপলব্ধি নিয়ে প্রশ্ন করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। 
উপন্যাসটি ২৪৭ বছর বয়সী ভাববাদী পাম্পা কাম্পানা দ্বারা লেখা একটি মহাকাব্য ‘জয়পরাজয়’কে বিশদভাবে বর্ণনা করে। পাম্পা কাম্পানাÑ একজন জ্ঞানী মহিলা, কিংমেকার এবং গল্পকার যিনি অন্ধ হওয়ার আগে অনেক রাজবংশকে ছাড়িয়ে গেছেন। অবশেষে বিসনাগা রাজবংশের ওপর তার মহাকাব্য জয়পরাজয় শেষ করার পরে তিনি ২৪৭ বছর বয়সে মারা যান এবং উপন্যাসের শুরু হয় তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে । পাম্পা মারা যাওয়ার আগে পা-ুলিপিটিকে একটি মাটির পাত্রে লুকিয়ে রাখেন ‘ভবিষ্যতের বার্তা’ হিসাবে। যাতে অজ্ঞাত কোনো কথক এটিকে ৪৫০ বছর পরে খুঁজে পেতে পারেন? এবং সত্যি তাই হয়েছে।
নয় বছর বয়সী পাম্পা তার মা রাধা কাম্পানাকে অন্য শত শত নারীর সঙ্গে অগ্নিতে আত্মাহুতি দিতে দেখেছিলেন যখন তাদের রাজ্য আক্রমণকারীদের দ্বারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং রাজার মাথা দিল্লির সুলতানের কাছে পাঠানো হয়েছিল। অনাথ মেয়েটি বনে হারিয়ে যাওয়ার সময় দেবী পার্বতী তাকে অলৌকিক ক্ষমতা অর্পণ করেন। দেবী তাকে বলেন যে, সে এই ক্ষমতাগুলো ব্যবহার করবেন ‘নিশ্চিত করার জন্য যে এই পদ্ধতিতে আর কোনো মহিলাকে পুড়িয়ে ফেলা হবে না, এবং পুরুষরা নতুনভাবে মহিলাদের বিবেচনা করা শুরু করবে, এবং আপনি আপনার সাফল্য এবং ব্যর্থতা উভয়ের সাক্ষী হওয়ার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ বছর বেঁচে থাকবেন।’
শুরুর কয়েকটি পৃষ্ঠা একটি আশ্চর্যজনক গল্পের মঞ্চ তৈরি করে। পাম্পা হুক্কা এবং বুক্কাকে কাল্পনিক বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। পাম্পা যখন সাবধানে তার চরিত্রগুলোকে বেছে নেয় এবং তাদের অনন্য ব্যাকস্টোরি দেয়, তখন শহরটি যোদ্ধা থেকে শুরু করে প্রাসাদ প্রহরী এমনকি অ্যাটর্নি পর্যন্ত সমস্ত কিছুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নারীরা। এখানে কথাসাহিত্য এবং ইতিহাস একে অপরের সঙ্গে সরাসরি মতবিরোধে লিপ্ত। লেখক উল্লেখ করেছেন, গল্পগুলো ইতিহাসের চেয়ে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকি তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
উপন্যাসটি বিসনাগা সাম্রাজ্যের একটি অনন্য চিত্রনাট্য উপস্থাপন করে, যার উৎপত্তি ১৪শ’ শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতে যখন দেবতা অধ্যুষিত এ অঞ্চলে পাম্পা কাম্পানা মন্ত্রমুগ্ধ বীজ থেকে জন্মায়। এর ইউটোপিয়ান বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও বিসনাগা সাম্রাজ্য মানব মূর্খতা দ্বারা জর্জড়িত। রাজাদের মধ্যে ঘন ঘন যুদ্ধ এবং রাজবংশীয় দ্বন্দ্ব, সতীদাহের স্থায়ী প্রথা এবং ধর্মীয় নিপীড়নের সময়কাল যা পাম্পা কাম্পানাকে অবশেষে নির্বাসনে বাধ্য করে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু স্বাধীনতা ও এর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং মরণশীলদের বোঝানোর চেষ্টা যে নিপীড়নের চেয়ে বন্ধুত্ব শ্রেয় এবং বিশ্বাসের চেয়ে জাদু গ্রহণযোগ্য।

রুশদি লেখার শৈলী হিসেবে জটিল থিম এবং ধারণাগুলোকে প্রকাশ করার জন্য সাহিত্য উপকরণ এবং প্রতীকের ওপর জোর দেন।  উপন্যাসটিতে সাহিত্যিক কৌশলগুলোর মধ্যে প্রতীকবাদ এবং কল্পনাপ্রসূত লেখার পাশাপাশি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাবলীর পরোক্ষ উল্লেখ রয়েছে। বইটির পটভূমি বিজয়নগর নামক বাস্তব রাজ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যেটি ১৪ থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতে বিদ্যমান ছিল এবং এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট একে হাপ্মি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যে দুই ভাই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেনÑ হরিহর এবং বুক্কা।

উপন্যাসে তাদের নাম হুক্কা এবং বুক্কা দেওয়া হয়েছে। বিখ্যাত পর্তুগিজ অভিযাত্রী ডোমিঙ্গো পেস, যিনি বিজয়নগর সাম্রাজ্য পরিদর্শন করেছিলেন, পাম্পার গোপন প্রেমিকও বটে। উপন্যাসে তার নাম  ডোমিঙ্গো নানস হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রুশদি নারী স্বাধীনতার ইতিহাস ও উত্থানকে ক্ষূণœ করার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তার আগের কাজগুলোতে নারী চরিত্র ও দেহকে নানা দৃষ্টিকোণে ব্যাখ্যার জন্য নিন্দিত হয়েছেন। অথচ ভিক্টোরি সিটি উপন্যাসে স্পষ্টভাবে নারীদের জন্য সমতা এবং স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়েছেন।

এতে হয়ত রুশদি তার নারী বিষয়ে অতীত দর্শন থেকে চিন্তাগত ভাবে ফেরার চেষ্টা করেছেন। সতীদাহ প্রথা, অবলা, ডাইনি তকমা থেকে নারীকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনি সমঅধিকার প্রাপ্ত নারী-পুরুষ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন।
 কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারে যে জাদুকরী বাস্তববাদের ধারাটি শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আসলে জাদু বাস্তবতার ব্যবহার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়েছে, বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিবেশিত হয়েছে। মিডনাইটস চিলড্রেন এবং দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের মতো উপন্যাসগুলোতে, জাদুকরী বাস্তববাদ ব্যবহার করা হয় পরাবাস্তবের অনুভূতি তৈরি করতে এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা অন্বেষণ করতে।

দ্য এনচানট্রেস অব ফ্লোরেন্স-এ রুশদি মুঘল সাম্রাজ্যের একটি প্রাণবন্ত প্রতিকৃতি তৈরি করতে কথাসাহিত্যের সঙ্গে জাদুবাস্তবতাকে মিশ্রিত করেছেন। বহু সংস্কৃতির দেশ ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা গত প্রায় দুই হাজার বছর ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। আলোচ্য ভিক্টোরি সিটি উপন্যাসে নারীর ক্ষমতায়ন, সব ধর্মবর্ণজাতের মানুষের একত্রে বসবাস সম্ভব কখনো হয়নি। ঔপন্যাসিক রুশদি পৌরাণিক, আর অতিপ্রাকৃত শক্তির আশ্রয়ে এক শান্তির রাজ্য বানালেন, যেখানে নারী-পুরুষ সমানে সমান। লেখকসৃষ্ট রাজ্যের বিবরণ থেকে বুঝা যায়, এটি ফতেহপুর সিক্রি নামের একটি অঞ্চল যেখানে হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থান করতেন।

ফলে লেখকসৃষ্ট বিসনাগা রাজ্য আর ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজ্য মিলে গেলেও মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়, হচ্ছে। বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এ ভারতে দেবতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে কল্পনায় বিশনাগা রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও বাস্তবতা পুরাটাই উল্টো। ভিক্টোরি সিটিতে বর্ণিত সব চরিত্র পাঠকমহলে স্থায়িত্ব পাবে, মনে রেখাপাত করবে, তা বলা মুশকিল। সবচেয়ে বড় কথা, ২৪০০ পদ দিয়ে রচিত জয়পরাজয় কাব্যের রচয়িতা পাম্পা কাম্পানা মানুষের কাছে অমর সৃষ্টি হিসেবে টিকে থাকবে কিনা, তা বলাও অসম্ভব।

যেমনিভাবে পাঠকমহলে আজও টিকে আছে ওথেলো, ডক্টর ফস্টাস, রোমিও জুলিয়েট, হেমলেট, ইয়াগোর মতো কালজয়ী চরিত্রগুলো। তাই বলা চলে, ভিক্টোরি সিটি উপন্যাসটি কালোত্তীর্ণ হবে, চরিত্রগুলো বিশেষ করে পাম্পা কাম্পানা অমরত্ব লাভ করবে, তা কাল-মহাকালই বলতে পারবে।

×