ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

অরণ্যে নির্জন ঝরাপাতা

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

প্রকাশিত: ০১:০২, ১২ জুলাই ২০২৪

অরণ্যে নির্জন ঝরাপাতা

অরণ্যে নির্জন ঝরাপাতা

নামের সঙ্গে জীবনের একটা যোগাযোগ আছে। এই যোগাযোগের ব্যাপারটা বাবা জানলে আমার নাম কি নির্জন রাখতেন?  নামটা কেন রেখেছিল বাবা প্রশ্নটার উত্তর আমি পাইনি। নামে কিছু এসে যায়  না যদিও এমনটাই জানতাম কিন্তু এই নামের কারণেই সম্ভবত অকারণ এই গভীর অরণ্যে বসে আছি, যেখানে কেউ কোনোদিন আসেনি এবং কেউ কোনোদিন আসবেও না। 
আমি যেখানে বসে আছি সেখানে কি এখন রাত নাকি দিন বোঝার উপায় নেই। এত গভীর আর ঘন সব গাছ, যাদের নাম শহরে বড় হওয়া আমার জানার কোনো সুযোগ নেই সেখানে শিকড়ের কাছে বসে সূর্যের সন্ধান করা যায় না। 
সূর্যের সন্ধান করতে আমি চাচ্ছিও না। এই গভীরভাবে বসে থাকা আমাকে এতটাই ক্লান্ত করে তুলেছে যে এক পা হেঁটে কোথাও যেতে মন চাইছে না। 
মানুষ কেন খারাপ থাকে? মানুষের ঐ খারাপ থাকার পেছনের যত কারণ তার সবগুলো কারণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আজকের এখানে এসে বসেছি, থেমেছি। আমার ভালো লাগার কথা। ধ্যানে বসে নতুন কিছুর সন্ধান পাওয়ার কথা। তারপরও আমার ভালো লাগছে না। 
গাছের ঘনত্বের চাপে যেখানে হাত ঠিকভাবে নাড়ানোই দায় সেখানে বসে বসে ডায়েরি লিখছি। লেখার কারণ সময় কাটানো, লেখার কারণ আমি ধ্যানে বসতে পারছি না, লেখার কারণ এই ডায়েরিটা যদি আমার মতো কারও হাতে কখনো যায়, সে যেন একলা বোধ না করে।  
আমি যে এখানে এলাম, এখানেই আসতে চেয়েছি সারাজীবন, এটা এমন একটা জায়গা যার কথা কেউ জানে না, হয়তো কল্পনা করে, হয়তো স্বপ্ন দেখে কিংবা দেখে না, না দেখে, না জেনে তাদের জীবন পার করে ফেলে, আমি সেই জায়গায় বসে আছি, যদিও আমি এর বাস্তব অস্তিত্ব স¤পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম না।
আমার মনে হতো কিংবা আমি চাইতাম আমি এমন কোনো জায়গায় চলে যাবে যেখানে আশপাশে কোনো প্রাণের চিহ্ন থাকবে না, নাম না জানা অনেক অনেক বড় গাছ থাকবে, তার মাঝ দিয়ে হাঁটাচলার বুনো পথ। একটা ছোট্ট ঘরের কথাও ভাবতাম, বনের মাঝে হঠাৎ ফাঁকা জায়গা কিন্তু আকাশ দেখা যায় না, পাতা ছড়িয়ে আলোর পথ বন্ধ করে রাখবে এমন। আমি ঠিক তাই পেয়েছি। 
আমি চাইতাম আমার ক্ষুধা লাগবে না, আমার চুমুর প্রতি তৃষ্ণা থাকবে না, শরীরের প্রতি আকর্ষণ থাকবে না, আমি তাই পেয়েছি। কেন চেয়েছি? কারণ সুখকে স্থায়ী করতে চেয়েছিলাম। আমরা জানি, চাহিদাই তৈরি করে কষ্ট। যদি চাহিদা না থাকে, যদি এই মেকানিক্যাল পৃথিবীতে ছুটে চলা না থাকে, তবে ঐ সুখকে আজীবনের মতো নিজের করে নিতে আর ঠেকাবে কে? 
আমি কি এখন সুখী?
সম্ভবত না। সুখের সঙ্গে ভালো লাগার স¤পর্ক আছে। আমার এখন ভালো লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে আমার নাম নির্জন কেন রাখা হলো? বন্ধুরা অবশ্য আমাকে এড়িয়েই চলত। পাগলও বলত। এ কথা সত্যি আমি পাগল না হলেও বোকা ছিলাম। না হলে এসব ফ্যান্টাসির কথা কি মানুষকে বলে বেড়াতাম? 
ভার্সিটিতে আমার নামও ছিল একটা। দ্য সেক্সলেস ম্যান। আমি যৌনতা থেকে মুক্তি চাইতাম কিন্তু যৌনতা আমার প্রিয় ছিল। পাতার সঙ্গে স¤পর্কের পর সেক্স আরও প্রিয় হয়ে ওঠে। অথচ তারপরও বন্ধুদের কাছে আমি ছিলাম সেক্সলেস ম্যান। ওরা আমাকে কত ভুলটাই না জানত!

দুই
পাতার সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বিচ্ছিরি একটা জায়গায়। নর্দমার পাশে। পাতা রিকশা থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমি তাকে সাহায্য করেছিলাম। পাশেই একটা ক্লিনিকে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলাম। দেখতে খুব সাধারণ। একটা জিন্স আর ফতুয়া। ফতুয়াটা ফুল হাতা। আর শরীরটা বেশ নরম। সম্ভবত মেয়েদের শরীর এরকমই হয়। আমার খুব একটা পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, পরের অভিজ্ঞতাও নেই। 
পাতা বলেছিল, আপনাকে ধন্যবাদ। 
কেবল ধন্যবাদ?
কথাটা বলে আমি নিজেকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। নিজেকে এরকম শাস্তি আমি প্রায় দিতাম। যখন ভুল কিছু করে ফেলতাম তখন হাত কাটতাম। আমার হাতে অনেক কাটা দাগ। ফুলহাতা শার্ট ছাড়া তাই বের হই না। মা অবশ্য আমাকে টিটকারি দিতে ছাড়ে না এজন্য। পাতাকে কথাটা বলে ফেলার পর মনে হচ্ছিল এবার হাত অল্প করে কেটেও শাপমোচন হবে না, পুরো হাতটাই কেটে ফেলতে হবে। তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছিল ডান হাত কাটা যাবে না। তাহলে মাস্টারবেশন করে আরাম পাওয়া যাবে না। বাম হাতে শক্তি একটু কমই থাকে। কিন্তু আমার আর হাত কাটা লাগেনি। কারণ কথাটা শুনেই পাতা হেসে ফেলেছিল। মনে হচ্ছিল, বৃষ্টির পর দুপুরের রোদ উঠেছে আর পাতা ক্রমশ সবুজ হয়ে উঠছে আরও। 
পাতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আর দুদিন পরই। আমরা বুফে খেতে গিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, বাফেট। পাতা আমাকে শুধরে দিয়েছিল। বুফে খেয়ে ওক ওক করে বমি করে ফেলল পাতা। এমন বমি আমি দেখিনি কখনো। সবুজ রঙের। কিছুক্ষণ পর অবস্থা দাঁড়াল এমন যে রেস্টুরেন্টের ফ্লোর পুরো হয়ে উঠেছিল সবুজ।    
পাতা নাম দেখেই কি তোমার বমিও সবুজ?
আমার এই কথাটা বলার সঙ্গে পাতা হেসে ফেলেছিল আর ওর বমি থেমে গিয়েছিল। 
পাতা বলেছিল, আমার নিপলের রঙও সবুজ। দেখবে?
কাল দেখি? আমার বাসায়? একটু খেয়েও দেখলাম? 
তিন.
এখানে সেখানে ঘুরে, ত্রিশ সেকেন্ডের সেক্স থেকে ত্রিশ মিনিটে উত্তীর্ণ হয়ে, সবুজ থেকে আরও সবুজ হয়ে আমি পরের রাস্তায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। বাসায় বলার খুশিই হয়েছিল সবাই। কারণ পাতার বাবার পরিচয় আমি মিথ্যা দিয়েছিলাম। অনেক বড় একটা ফ্যামিলির একমাত্র মেয়ে, এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। তবে শুরুতে কেউ বিশ্বাস করেনি। এমনকি পাতাকে নিয়ে যাওয়ার পরও না। পাগল, কোথাকার!
এরপরও পাতাকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। পাতাও আমাকে। 
তোমাকে এবার একটা চাকরি দেখতে হবে নির্জন। 
আমি হেসে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, তুমি জানো তো আমার স¤পর্কে। কত বিত্ত বৈভব আমাদের, 
আমাদের প্রয়োজন হবে না। 
পাতা বলেছিল, প্রয়োজন হবে। চলো আমরাও একটা রেস্টুরেন্ট দিই। 
পাতার প্রস্তাব আমার পছন্দ হয়েছিল। শহরের সবচেয়ে পশ এলাকায় যেখানে সব বিদেশের দূতাবাস সেখানে আমরা একটা ডুপ্লেক্সে বাসা কিনে ফেললাম। ওপরে একপাশে আমরা থাকব। আর নিচে রেস্তোরাঁ। দুদিকে ওঠার পথ আলাদা থাকবে। দেশ সেরা আর্কিটেক্ট আজকা ঈশিতাকে দিয়ে ডিজাইন করানোর সিদ্ধান্ত নিই। 
নাম কি দেওয়া যায়? 
পাতা বলল, নির্জন ঝরাপাতা। 
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের রেঁস্তোরার নাম দিয়েছিলাম নির্জন ঝরাপাতা। 
ভেতরে অরণ্যের ছবি এঁকে দিয়েছিলাম যেন যারা খেতে আসবে তাদের মনে হয় একটা বনে বসে 
আছে। 
ব্যবসা জমে যেতে সময় খুব একটা লাগল না এবং আমরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সেক্স, বিকেলে একবার এবং রাতে একবার। পাতার সঙ্গে আমার এদিক দিয়ে এতো মিল ছিল যে, আমাদের ভেতরে সমস্যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না। পাতাকে বললাম, এবার চলো বিয়েটা সেরে ফেলি। 
বাসায় জানাতে হলো। বাসায় জানত আমি পাতার সঙ্গে থাকি। এটা নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল না। বাবার ভাষায়, বড়লোকের ছেলেদের এমন নানা খেয়াল থাকে, কিন্তু তাই বলে বিয়ে? বাবা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিতে চাইলেন। পাতার কাছে এসে সব খুলে বললাম। ও বলল, মন খারাপ করো না।
তোমার বাসায় সমস্যা নেই তো?
পাতা খুব আনমনা হয়ে উঠেছিল। যেন সত্যি সত্যি ঝরে পড়ে যাবে। খুব মৃদু স্বরে বলেছিল, আমার 
কোনো সমস্যা নেই নির্জন। 
চার.
বাবা আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। মা অল্প যাও আদর আপ্যায়ন করতেন, বাবার কারণে সেটাও করতে চাইতেন না। 
কী একা একা বসে থাকিস, বন্ধু নেই, এরকম কেন তুই? বড় ভাই বলত। 
আগেই বলেছি বন্ধুরা আমাকে কি বলত। সুতরাং অর্থের ভেতরে ডুবে থাকলেও সুখ আমার ছিল না। আমি খুঁজে বের করেছিলাম, আমি যদি তাদের কাছে প্রাপ্তির প্রত্যাশা না রাখতাম, তবে জীবনটা আমার এভাবেই চলে যেত সুন্দর একটা শান্ত লেকের মতো। 
পাতাকেও ওরা আমার হতে দেবে না। ভাইয়া বলেই বসল আবার বাড়িতে ডেকে, তোকে মোহিত কামালের কাছে নিয়ে যাই। আগে মানুষ বলত পাবনায় পাঠাবে, আর এখন বলে মোহিত কামালের কথা। ব্যাপারটা হাস্যকর। আমাকে তার কাছে নিতে হবে কেন? 
ওদিকে আমি আরেকটা নতুন বাসা নিয়েছি। রেস্তোরাঁর বাসাটার প্রাইভেসি প্রায় নষ্ট হয়। পরিচিত লোকজন এলে যখন তখন ডেকে পাঠায়। পাতাকে নতুন বাসায় রেখে এসেছিলাম। 
পাতাকে গিয়ে বলার পর ও কেঁদে উঠল। কী গভীর করুণ কান্না! আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকলাম। 
কিছুই করতে পারছিলাম না। সান্ত¡না কিভাবে দিতে হয় আমি ঠিক জানি না। শেখানো হয়নি, আর হাতে কলমে শেখার সুযোগও হয়নি। 
আমি কী করলাম, আমি পাতাকে নগ্ন করে ফেলতে চেষ্টা করলাম। মনে হচ্ছিল, আদর পেলে ওর ভালো লাগবে। আর সঙ্গে সঙ্গে পাতা আমাকে ছিটকে দূরে ফেলে দিল। মন খারাপ করে আমি বের হয়ে এসেছিলাম। নির্জন ঝরাপাতায় গিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে আবার ফিরব, এটাই ছিল সিদ্ধান্ত। কিন্তু যেতে পারলাম না। খুব জ্যাম। জ্যাম আমার সহ্য হতো না। বাড়ি ফিরে পাতাকে আর পেলাম না। পাতা যেন এখানে কোনোকালেই ছিল না। আমার বাসাটা শূন্য হয়ে পড়ে আছে। যে বাসাটা আমি আর পাতা মিলে কিনেছিলাম মাসখানেক আগে।

পাঁচ.
পাতাকে আমি কোথাও আর পেলাম না। হারিয়ে গেছে। বাবার অনেক ক্ষমতা। নিশ্চয় পাতাকে সে মেরে ফেলেছে। থানায় মামলা করতে চাইলাম। ওরা ধরে আমাকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। 
ডাক্তার বলল, পাতা নামে কেউ কখনো ছিল না। 
আমি হেসেছিলাম। 
বাবার এত ক্ষমতা দেখে আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম যদিও। একটা মানুষকে পৃথিবী থেকে এভাবে মিলিয়ে দেবে? 
পাতা কি সত্যি কেউ ছিল না? 
আমাকে নানা ড্রাগ দেওয়া হচ্ছিল। কখনো খেতাম, কখনো খেতাম না। কিন্তু পাতা কি সত্যি কেউ ছিল না, এই ভাবনা আমাকে সুস্থির থাকতে দিচ্ছিল না। পাতার হারিয়ে যাওয়ার চাইতে, পাতার না থাকার সম্ভাবনাই আমাকে শেষ করে দিচ্ছিল।  রেস্টুরেন্টটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 
তখনই আমার মনে হচ্ছিল আমি আমার ড্রিমল্যান্ডে কেন চলে যাচ্ছি না? 
তারপর একদিন ঘুম ভেঙে দেখি আমি সত্যি ড্রিমল্যান্ডে চলে এসেছি। আমি চাইলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে কিংবা তার পরদিন কিভাবে এখানে চলে এলাম সেটা আমি বলতে পারব না। অরণ্য। একা। ক্ষুধা, যৌনতাবিহীন আমাকে শুরুতে খুব উপভোগ করেছি। কিন্তু এখন আমার এভাবেও ভালো লাগছে না। বাড়িতে ফিরতে চাইছি, সেটাও পারছি না। এই ডায়েরিটা যদি কোনোদিন কারও হাতে পৌঁছে যায় তবে চেষ্টা করবেন এই জায়গায় না আসতে। আমি জানি না আদৌ এটা আপনাদের পাঠানো যাবে কিনা। 
এদিকে পাতা ঝরে ঝরে আমাকে ঢেকে দিচ্ছে। আর লিখতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। শত শত সবুজ পাতার ভেতরে, সব অনুভূতি হারিয়েও পাতার জন্য আমার খুব কান্না পাচ্ছে।

×